অরুণা, রত্না ও দীপিকা।
কয়েকদিন খুব ঠাকুর বাড়ির গল্প জমেছে। সে জমুক। আসলে উনিশ শতকের মহিলা লেখকদের গল্প করতে বসে তো ঠাকুর বাড়ির মেয়েদের কথা বলতেই হবে। তাঁরাই তো মহিলা কলমচিদের কলম এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। তাই আজকের কথকতাও রইল ঠাকুরবাড়ির তিনটি মেয়েকে নিয়েই। হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পূর্ণিমাদেবীর মেয়ে ছিলেন প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী। ঠাকুরবাড়ির রান্না নিয়ে তাঁর বইটি রন্ধনরসিকদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। তিনি ছিলেন লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার সহধর্মিণী। অত্যন্ত মেধাবী আর গুণী দম্পতির চারটি মেয়ে—সুরভি, অরুণা, রত্না ও দীপিকা। সুরভি অকালপ্রয়াণ হয় সাড়ে পাঁচ বছর বয়সে। আজ প্রজ্ঞাসুন্দরীর এই তিনটি মেয়ের গল্প বলি। অমন কৃতি বাবা-মায়ের সন্তান হিসেবে এই তিন কন্যেই ছিলেন গুণবতী। বাবা-মা কয়েক বছর সম্বলপুরে থাকতেন।
তিন বোন কলকাতায় মাসির বাড়ি থাকতেন। ডায়েশেসন স্কুলে লেখাপড়া এবং সঙ্গীত সংঘে গান শেখা—তাঁদের মধ্যে আলাদা ব্যক্তিত্ব তৈরি করেছিল। অরুণা খুব ভালো গাইতেন এবং অনেক গানের স্বরলিপি তৈরি করেছিলেন। বাংলা ও অসমিয়া দুই ধরণের গানের স্বরলিপিই তৈরি করেছিলেন তিনি। তাঁদের বাবা লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া স্বনামধন্য অসমিয়া সাহিত্যিক ছিলেন। তাঁর ঠাকুরবাড়ির সঙ্গীত ও শিল্পচর্চায় খুব উৎসাহ ছিল। আশুতোষ চৌধুরীর বাড়ি ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ অভিনয় হয়েছিল, অরুণা সেখানে সেজেছিলেন বনদেবী। তাঁর বাবা দস্যু সেজেছিলেন। আবার পরে আরেকবার ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ অভিনয় করা হয়। তখন অরুণা সরস্বতী সেজেছিলেন। তাঁর দুই বোন রত্না এবং দীপিকা সেজেছিলেন বনদেবী। বিয়ের আগে অরুণার এই প্রতিভার আলো সকলের কাছে প্রকাশিত হচ্ছিল। কিন্তু বিয়ের পর বরোদায় শ্বশুরবাড়ি চলে যান তিনি। অরুণা তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। তখনকার দিনে তা বেশ বড় বিষয়। অথচ রক্ষণশীল শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে অরুণার এইসব প্রতিভার প্রকাশ আর হল না। দুঃখজনক হলেও সত্যি!
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৬: কল্যাণী—অন্দরমহলের সরস্বতী
ত্রিপুরার রাজ পরিবারে হোলি উৎসব
পরের বোন রত্নাও ছিলেন বেশ প্রতিভাময়ী। সঙ্গীত এবং অভিনয়ে ছিল তাঁর দক্ষতা। এস্রাজ এবং পিয়ানো বাজানো শিখেছিলেন। তিনি ছিলেন বহুভাষাবিদ। বাংলা, অসমিয়া এবং ইংরাজি—এই তিনটি ভাষাতেই সমান দক্ষ। তাঁর বিয়ে হয়েছিল আসামের অভিজাত এক পরিবারের ছেলে রোহিণীকুমার বরুয়ার সঙ্গে। তিনি ছিলেন বিদ্যোৎসাহী। রত্নার শিল্পচর্চা তাই একইভাবে চলছিল। অসমিয়া ভাষায় রত্না আত্মজীবনী লিখেছিলেন। সেখানে ছিল রবীন্দ্রনাথ, বিধানচন্দ্র রায়ের প্রসঙ্গ । একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন প্রজ্ঞাসুন্দরী এবং লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়াকে নিয়ে। রত্না ডিব্রুগড়ে অনেক ধরণের সেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পাশে পেয়েছিলেন রোহিণীকুমারকে। নারী, শিশু ও সেনাবাহিনীর মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন নিজের সেবাপরায়ণ সত্তাকে। আসামের চাবাগান পরিদর্শন ও ভারত সরকারকে তাদের দুরবস্থার কথা জানানোর কাজেও নিযুক্ত ছিলেন রত্না।
আরও পড়ুন:
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৫: ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪০: স্বভাবে অনন্য সুন্দরবনের বাঘ
দীপিকা ছিলেন খুব ভালো ছাত্রী। ডায়েশেসনের শিক্ষয়িত্রীরা তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। ঠাকুরবাড়ি, বাবা মায়ের স্নেহছায়া, বিদ্যাচর্চা, শিল্পচর্চা, বিলাস, বৈভব —সবকিছুকে অতিক্রম করে এক আশ্চর্য বোধ কাজ করল তাঁর মনে। তাঁর বৈরাগ্য এল। স্কুলের সন্ন্যাসিনী শিক্ষয়িত্রীদের মতো জীবন বেছে নিতে চাইলেন তিনি। মেয়ের এই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের সিদ্ধান্তে খুব আহত হয়েছিলেন তাঁর বাবা লক্ষ্মীনাথ বরুয়া। বাবা ও মেয়ের পত্র অনেক বিনিময় সত্ত্বেও দীপিকা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন।
আরও পড়ুন:
ঠাকুরবাড়িতে দোলে আসত নাচিয়ে, নাচের তালে তালে হত আবিরের আলপনা
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৮: অভিভাবিকা মা সারদা
দীপিকা ১৯৩৫ সালে সন্ন্যাস নিয়েই তিনি বিদেশে যান। চার্চ অফ ইংল্যান্ডে পড়াতেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ করে চার্চ অফ ইংলন্ডের এই শাখাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কনভেন্ট থেকে তাঁদের সংসারে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ আসে। কিন্তু সিস্টার দীপিকা ফিরলেন না। বেছে নিলেন সেবার পথ। তিনি বলতেন— my soul is hungry! পূর্বাশ্রমের জন্য মনখারাপ করত কীনা জানা নেই। তবে সন্ন্যাসিনী এইমেয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, ‘লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া, দি ম্যান অ্যান্ড দি ফাদার’! সারাজীবন সেবার পথেই ছিলেন তিনি। শুধু শেষজীবনে চেয়েছিলেন, মৃত্যুর পর তাঁকে যেন দাহ করা হয়। কিন্তু তাঁর সেই ইচ্ছে পূর্ণ হয়নি। হয়তো সিস্টার দীপিকা খালি পায়ে অনন্তের পথে হেঁটে গিয়েছেন। শেষকৃত্যের ভঙ্গিটি সেখানে মূল্যহীন।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪১: সুন্দরবনে বাঘে-মানুষে সংঘাত
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩১: আমার মতে, তোর মতো কেউ নেই
ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের জীবন আলো আঁধারের মতো রহস্যময়। দূর থেকে যা হিরের চমক, কাছে গেলে তার ধারটুকুও বেদনা দিয়েছে হয়তো। অরুণা, রত্না এবং দীপিকা বিখ্যাত বাবা মায়ের সন্তান। ভিন্ন ভিন্ন কক্ষপথে তাঁদের জীবন গড়িয়ে চলেছিল। রয়ে গিয়েছিল কিছু বিদ্যাচর্চার স্মৃতি ও শিল্পচর্চা।কালের গর্ভে সবটকু হারিয়ে যায়নি। গান, রান্না, ছবি আঁকা — এইসবের লিখিত দলিল তৈরি করে গিয়েছেন প্রজ্ঞাসুন্দরীর মেয়েরা। উনিশ শতকের গুণী মায়ের গুণী তিনকন্যা।
ঋণ স্বীকার
● ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, চিত্রা দেব
ঋণ স্বীকার
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।