বুধবার ৩ জুলাই, ২০২৪


আমাদের কলম ছুঁয়ে চলেছে বিভিন্ন সময়কার বাঙালি মহিলা লেখকদের। তাঁদের কলমের স্পর্শে স্থির হয়ে আছে সেই সময়কার সমাজ। আমরা দক্ষ অনুসন্ধানী চোখ নিয়ে ফোকাসে রাখছি সমাজে নারীর অবস্থান। ঠিক কতটা মিল, কতটা অমিল! আদৌ কি বদলেছে সমাজ? কেমন ছিল সেই সময়কার মেয়েদের মনস্তত্ত্ব?— এইসব প্রশ্নকে কলমের সূচীমুখে রেখে আজ রইল কৃষ্ণভাবিনী দাসীকে নিয়ে আলোচনা।

কৃষ্ণভাবিনী লিখেছিলেন এক ভ্রমণকাহিনি। বিদেশ ভ্রমণের ইচ্ছেপূরণ করেছিলেন তিনি। শব্দের আঁচড়ে প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন তাঁর প্রবাসকালের সম্পর্কে ব্যক্তিগত অভিমত। গল্প নয়, সত্যি কথা। তবে মেয়েদের গল্প, তাদের বুদ্ধিদীপ্ত চলন সবসময় পূর্ণতা পায় না। মেয়েদের জন্য জীবনের পথ বেশ জটিল। তখনও, এখনও। সেই কারণেই কৃষ্ণভাবিনীর প্রবাসজীবনের গল্প, তার পটভূমি বা উপসংহার মোটেই এখনকার পাঠকের মনের ঘরে খুব মানানসই হতে পারবে না। তবু কৃষ্ণভাবিনীর অক্ষরযাপন একটা অন্ধকার সময়ের দলিল এবং অবশ্যই মেয়েদের স্বাধীন মতপ্রকাশ এবং কলম ধরার প্রথম পর্যায়। কৃষ্ণভাবিনী সেই ‘আধুনিক নারী’— যে আধুনিকতা মনের মুক্তিকে নির্দেশ করে।
স্বামীর সঙ্গে বিদেশ গিয়েছিলেন কৃষ্ণভাবিনী। এইটিই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। কারণ তাঁর আগেও অনেক মহিলা বিলেত গিয়েছেন। সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই গিয়েছেন। যেমন: জ্ঞানদানন্দিনী, কমলমণি, মধুসূদনের পরিবার, ক্ষেত্রমোহিনী দত্ত, অরু দত্ত, তরু দত্ত, স্বর্ণলতা ঘোষ প্রমুখ নারী। এরপর বিলেত গেলেন কৃষ্ণভাবিনী। শোনা যায়, স্বামীর সঙ্গে বিদেশ গিয়েছিলেন বলে কৃষ্ণভাবিনীর পরিবার একঘরে হয়েছিল। তবে এমনটাও শোনা যায় কৃষ্ণভাবিনী নিজের সন্তানকে শাশুড়ির কাছে রেখে বিদেশ গিয়েছিলেন। তবে গল্পটা অত সহজ ছিল না। কৃষ্ণভাবিনী স্বামীর সূত্রেই লেখাপড়ার আলোয় আলোকিত হয়েছিলেন।

কৃষ্ণভাবিনীর আমলে ব্রাহ্ম মেয়েরা এবং সচেতন পারিবারিক পরিমণ্ডলের মেয়েরা লেখাপড়া শুরু করে দিয়েছেন। হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তখনও সেভাবে শুরু হয়নি। কিন্তু অন্দরমহলে বই পড়া এবং বিদ্যাচর্চার রেওয়াজ তখন শুরু হয়েছে। কৃষ্ণভাবিনী এইসব আধুনিকতা থেকে অনেক দূরের বাসিন্দা ছিলেন। কৃষ্ণভাবিনী মুর্শিদাবাদ জেলার চোয়ার গ্রামের মেয়ে। তথাকথিত নারীশিক্ষার পৃথিবী থেকে বেশ দূরত্ব রাখতেন কৃষ্ণভাবিনীর পিতৃপরিবার। স্ত্রীশিক্ষা আর লোকাচারের মধ্যে পরস্পর বিপরীত সম্পর্ক বজায় ছিল তখন বেশিরভাগ বাঙালি পরিবারে। কৃষ্ণভাবিনীর লেখক হওয়ারই ছিল। সেই কারণেই হয়তো দেবেন্দ্রনাথ দাস নামের এক ব্রাহ্ম তরুণের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বহুভাষাবিদ পণ্ডিত দেবেন্দ্রনাথ সিভিল সার্ভিসের ছাত্রদের পড়াতেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩: কৈলাসবাসিনী দেবী, অন্তঃপুরের বিপ্লব এবং মহিলা প্রাবন্ধিক

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৭: আস্তাবলে সহিসদের রাখি পরাতে রবীন্দ্রনাথ ছুটে গিয়েছিলেন

তিনি একজন অধ্যাপক ছিলেন, একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাও করেছিলেন। তাঁর স্ত্রী হিসেবে কৃষ্ণভাবিনীর মানসিক পরিবর্তনটা আশ্চর্যরকম। সন্তানকে রেখে স্বামীর সঙ্গে বিলেতযাত্রার সিদ্ধান্তটিও খুব বৈপ্লবিক। ১৮৮২ সালের ২৬ সেপ্টম্বর প্রথম বোম্বাই তারপর ইটালি, সুইৎজারল্যান্ড, ফ্রান্স হয়ে তাঁরা লন্ডনে পৌঁছে যান। কৃষ্ণভাবিনীর অন্তর্দৃষ্টির উদয় হওয়ার পর থেকেই তাঁর ইচ্ছে ছিল বিদেশ ভ্রমণের। স্বাধীনতার আস্বাদ পাওয়ার জন্য তাঁর মনের দুটো ডানা ছটফট করে উঠছিল। কৃষ্ণভাবিনী লিখেছিলেন—
‘বহুদিন হতে হৃদয়ে আমার ,
গোপনে রয়েছে এক আশালতা,
দেখিবার তরে প্রিয় স্বাধীনতা,
যাইব যে দেশে বসতি উহার।
যাইব তথায় স্বাধীনতাদেবী,
বিরাজে যেথায় প্রতি ঘরে ঘরে…’


বিলেতে গিয়ে কৃষ্ণভাবিনীর বুঝি মনে হয়েছিল, ‘এলেম নতুন দেশে।’ নারী পুরুষের এমন বন্ধুত্ব, এত সহমর্মিতা, নারী শিক্ষা, নারী স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ রূপ তাঁর মনে আজন্মলালিত সংস্কারগুলির পরিবর্তন শুরু করে দিয়েছিল। কৃষ্ণভাবিনী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। কিন্তু শিক্ষার আলোয় আলোকিত ছিলেন। তাই তিনি লিখতে শুরু করলেন নিজের জীবনের নতুন অভিজ্ঞতাগুলি! যা ভারতীয় মেয়েদের জীবনে রূপকথার চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না।

কৃষ্ণভাবিনীর লেখার ব্রিটেনের পরিবেশ সম্পর্কে দীর্ঘ মুগ্ধ বর্ণনা আছে। তার মধ্যে ইংলন্ডের গ্রামজীবন, শহুরে আদবকায়দা, পার্লামেন্ট, পত্রপত্রিকা সব ছিল। রাস্তার ফেরিওয়ালাদের বর্ণনা করতেও তিনি ভোলেননি। তাঁর লেখায় সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল তাঁর পর্যবেক্ষণ। অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তিনি বিলেতের জীবনযাত্রাকে প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন। বিলেতের মেয়েদের দিকে ছিল তাঁর কৌতূহলী দৃষ্টি। স্ত্রী পুরুষের সহজাত বন্ধুত্ব তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ‘সতীত্ব’ ধারণাটির উপর ভিত্তি করে ভারতীয় এবং অভারতীয় নারীদের তুলনা আসে যায়। অনেকসময় বিদেশিনীদের সতীত্ব নিয়ে প্রশ্নও তুলত ভারতীয় সমাজ। অজানা ভয় কাজ করত ভারতীয় মেয়েদের মনে। হয়তো কৃষ্ণভাবিনীর মনেও। কিন্তু তাঁর পর্যবেক্ষণ তাঁর ধারণা বদলে দেয়।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৬: ভয়ের না ‘অভয়ের বিয়ে’

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৪: শ্যামপুকুরে ঠাকুর

কৃষ্ণভাবিনী লেখেন, ‘…এদেশে যাহারা সতী আমার মতে তাহারাই প্রকৃত সতী, কারণ একেবারে পুরুষের মুখ না দেখিয়া বা পুরুষের সহিত না মিশিয়া অনেকে সতীত্বের গৌরব করিতে পারেন বটে,কিন্তু যাহারা পুরুষের মধ্যে থাকিয়া, পুরুষের সহিত সমভাবে বেড়াইয়া ও আলাপ করিয়া নিজেদের অমূল্য ধর্মরত্নকে না হারান, তাহারাই যথার্থ প্রশংসা পাইবার যোগ্য।’ তবে কৃষ্ণভাবিনী নিজের অপছন্দের কথাও লিখেছেন। যেমন ইংরেজ নারীদের পোশাক, প্রণয়ঘটিত বিবাহ, রোগা চেহারা পছন্দ হয়নি তাঁর।

সাত আট বছরের বিলেত প্রবাস কৃষ্ণভাবিনীকে সত্যই ‘আধুনিক স্বাধীন নারী’ বানিয়ে তুলেছিল। নিজের মনকে অনেকটাই স্বাধীন করতে পেরেছিলেন তিনি। তাঁর অমূল্য অভিজ্ঞতাগুলি নিয়েই পরে ১৮৮৫ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত হয় ‘ইংলন্ডে বঙ্গমহিলা’। তখনও পর্যন্ত গ্রন্থাকারে আর কোনও লেখকের বাংলা ভ্রমণকাহিনি প্রকাশিত হয়নি। কৃষ্ণভাবিনীই প্রথম।

রবীন্দ্রনাথের ইউরোপ প্রবাসীর পত্রও তখন পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলাসাহিত্যে ‘বঙ্গমহিলা প্রণীত’ এই লেখা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। এই বইতে কৃষ্ণভাবিনী ইংলন্ডের নারীমুক্তি আন্দোলনের পক্ষে লিখেছিলেন। ‘পাঠিকা’ শব্দের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বোঝাতে চেয়েছিলেন মেয়েরা এই বই পড়ুক তা তিনি চান। ব্যক্তিগত আবেগ নয়, একটি ভিন্ন সমাজ তাঁর লেখার বিষয়। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।

মেয়েদের শিক্ষা, নারী মুক্তি, অন্দরমহল থেকে মেয়েদের মুক্তি— এই সব বিষয় তিনি পাঠকের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। তাঁর মত সকলে খোলা মনে মানতে পারেনি। ক্যালকাটা রিভিউ পত্রিকায় তীব্র সমালোচনা হয়েছিল তাঁর লেখার। পুরুষতন্ত্র আর কীই বা করতে পারত? পুরুষতন্ত্র কিন্তু নারীমনেও শিকড় মেলে। তখনকার সমাজের মূল সমস্যা ছিল এইটিই। ইংলন্ডে বঙ্গমহিলা প্রকাশের পরেও তিনি আরও অনেক লেখা লিখেছেন। স্বামীর প্রেরণা ও সাহায্যও পেয়েছেন।
আরও পড়ুন:

শ্রীরামকৃষ্ণের প্রিয় শিষ্যের দর্শন তো রোজ পাওয়া যাবে না/২

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক

ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা। ‘স্ত্রীলোক ও পুরুষ’, ‘বিলেত-ভেল্কি’ ইত্যাদি প্রবন্ধ খুব গুরুত্বপূর্ণ। তখন স্ত্রীশিক্ষা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মতামত খুব সদর্থক ছিল না। কৃষ্ণভাবিনী রবীন্দ্রনাথের প্রতিকূলে মত রেখেছিলেন ‘সাহিত্য’ পত্রিকায়। রবীন্দ্রনাথও তর্কযুদ্ধ করেন। এইভাবে কৃষ্ণভাবিনীর লেখা এগিয়ে চলে। তবে সেইযুগের একটি মেয়ে সব সংস্কার কাটিয়ে উঠবে তা আশা করা ভুল। কৃষ্ণভাবিনীও মেয়েদের স্বনির্ভর হওয়া বা অর্থ উপার্জনের পক্ষে মত রাখতে পারেননি।

পরে তাঁর জীবনে পরিবর্তন আসে। অল্পদিনের ব্যবধানে স্বামীপুত্র দু’জনকে হারিয়ে কৃষ্ণভাবিনীর লেখা ও ভাবনা স্তব্ধ হয়ে যায়। রক্ষণশীল হয়ে ওঠেন তিনি। কঠোর বৈধব্য পালন করেন। বিধবা আশ্রম গড়ে তোলেন। একটি আধুনিক মেয়ের মনে আবার যেন পুরনো সমাজ ভর করে। মেয়েদের মনের মুক্তির পথ তৈরি করে দিয়ে কৃষ্ণভাবিনী নিজেই যেন হারিয়ে গেলেন কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের আঁধারে। শুধু রয়ে গেল তাঁর বই। বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য নিদর্শন।

সহায়ক বই
নারীপ্রগতির একশো বছর, রাসসুন্দরী থেকে রোকেয়া, গোলাম মুরশিদ
ইংলন্ডে বঙ্গমহিলা, কৃষ্ণভামিনী দাসী
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত এবং পরীক্ষায় আসবে না তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content