শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

দয়াময়ীকে মনে পড়ে? ঘর-গেরস্থালির খুঁটিনাটির একটুকরো আঁচলে বেঁধে সংসার করতে এসেছিল যে মেয়েটি! কিন্তু সংসার রক্ত-মাংসের মানবজীবন থেকে সরিয়ে এনে তার স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল ‘দেবী’র আসনে। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, কথা বলছি প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রচিত ছোটগল্প ‘দেবী’ অবলম্বনে সত্যজিৎ রায়ের নির্মিত চলচ্চিত্র ‘দেবী’র কেন্দ্রীয় চরিত্র দয়াময়ীকে নিয়ে। পাশাপাশি আরেকটি চলচ্চিত্রের কথাও এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় ভীষণভাবে, মনোজ ভট্টাচার্য নির্মিত ‘ডাইনি’। এই ছবিও এক নিতান্ত সাধারণ গৃহবধূর রক্তমাংসের মানবী থেকে মানবাতীত ‘ডাইনি’ হয়ে ওঠার গল্প বলে। দেবী হোক বা ডাইনি, উভয়েই তো দুই রক্তমাংসের জীবন্ত নারীকে অতিমানবীয় এক অজানা যাত্রাপথের দিকে ঠেলে দেওয়ার গল্প বলে। দেবী থেকে ডাইনি—বহুযুগ ধরেই নারীর উত্তরণ থেকে অবতরণের পথ এই পরিসীমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, সে দয়াময়ীর দেবীত্বে উত্তরণ তার ইচ্ছানুযায়ী হোক নাক নয়নতারার ‘তারা ডাইনি’তে অবতরণ তার ইচ্ছানুগহোক বা নাই হোক, তার খবর কেই-বা রাখে? তবে একথা সঠিক যে বাস্তব সমাজ দয়াময়ীদের ইচ্ছার খবর না রাখলেও বহুদিন ধরেই ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতারা তাদের মনের ঘরে উঁকি দিতে চেয়েছেন, আর বিশ্বায়ন পরবর্তী ভারতীয় চলচ্চিত্রে যে আলাদা করে নারীদের নিয়ে কথা বলতে চাওয়ার প্রচেষ্টা যথেষ্ট বেড়েছে তা দীপা মেহতা নির্মিত ‘ফায়ার’ চলচ্চিত্রের ‘সীতা’ এবং ‘রাধা’, মণিরত্নম নির্মিত ‘দিল সে’-এর ‘মেঘনা’ অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরি নির্মিত ‘পিঙ্ক’ চলচ্চিত্রের ‘মিনাল আরোরা’ বা বিকাশ বেহল নির্মিত ‘কুইন’এর ‘রানি’দের মতো চরিত্রগুলির দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যায়। কিন্তু রুপোলি পর্দার বাইরে বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে এখনও কজন মানুষ নারীর অন্তরমহলে উঁকি মারার পরিসর পান? পর্দার বাইরে এরকমই কিছু স্বনির্ভরাদের অন্তরমহলে উঁকি মারার চেষ্টা করেছিলাম, নিতান্ত কৌতূহলবশেই। একথা জানার খুব ইচ্ছে ছিল যে যথাযথ আর্থিক স্বনির্ভরতা থাকার পরেও ‘নারী’ এই পেজমার্কের বাইরে বেরিয়ে একজন নারী ঠিক কতটা ব্যক্তিমানুষ হিসাবে নিজেদের জীবনকে পরিচালনা করার স্বাধীনতা পান আজকের দিনে দাঁড়িয়েও।

রুমা মিদ্যা, শিক্ষিকা

কথা হয়েছিল উলুবেড়িয়া নিবাসী স্কুল শিক্ষিকা রুমা মিদ্যার সঙ্গে। ‘চাকুরিরতা হওয়া সত্ত্বেও নিজের জীবনের সমস্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কতটা স্বাধীন আপনি?’ প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষিকা জানান, আর্থিকভাবে স্বাধীনতা থাকলেও নিজের জীবনের সমস্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা সংসারে থেকে অর্জন করা খুবই কঠিন। ‘আমাদের সময় স্বামীরা হয়তো এটা ঠিক ভাবতে পারতেন না যে নিজেদের জীবনের সিদ্ধান্ত আমরা নিজেরাই নেব।’ স্পষ্টতই জানালেন শিক্ষিকা। আরও বললেন, সংসারের শান্তি রক্ষার্থে আমরা মেনেও নিই কারণ শান্তিটা বড়ই প্রয়োজনীয়, পাশাপাশি জোরের সঙ্গে একথাও বললেন যে আজকের দিনে অধিকাংশ পুরুষই মহিলাদের দিকে উদারতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন, তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সম্মান জানাচ্ছেন। এই নিদর্শন যে প্রকৃতপক্ষেই উদার শিক্ষার ফল সেকথা বলাই বাহুল্য। বন্ধুদের সঙ্গে পরিবার ছাড়া বেড়াতে যান কি না জানতে চাওয়ায় রুমাদেবী জানান যে, ‘না, আজকের দিনে অনেক মহিলার এই স্বাধীনতা থাকলেও তাদের সময়ে এমনটা করার কোনও জায়গা ছিল না।’ একই প্রশ্নের উত্তরে ঠাকুরপুকুর নিবাসী, শিক্ষিকা কাকলি মজুমদার জানান যে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটা ছাড় থাকলেও বন্ধুদের সঙ্গে আলাদা করে বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ সেভাবে হয় না সংসারের চাপের কারণেই। দুই নারীরই নিজস্ব সময়ে সময় কাটানোর প্রিয় সঙ্গী হল গল্পের বই। রুমা মিদ্যা আরও বললেন, ‘দেশ বিদেশের সিনেমা দেখতে, নিজের কথা লিখতে বড় ভালো লাগত, কিন্তু সময় পাই কোথায়!’
স্বাধীন বলে মনে হয় নিজেকে? উত্তরে কাকলি মজুমদার যথেষ্ট জোরের সঙ্গেই বলেন, ‘আমি নিজের জায়গায় যথেষ্ট স্বাধীন।’ কিন্তু স্বাধীনতার অর্থকে যেন বড় সুন্দর করে সাজিয়ে দিলেন বাংলার শিক্ষিকা রুমা মিদ্যা৷ বললেন, ‘স্কুলের গেটটা পেরোলেই আমি স্বাধীন কারণ ওখানে আমি কেবলই রুমা, আমার নিজের অর্জন করা পরিচয়ে আমি বাঁচি ওখানে। কারওর স্ত্রী বা কারওর মা হিসাবে নয় ওখানে সবাই আমাকে রুমার পরিচয়েই জানে।’

কাকলি মজুমদার, শিক্ষিকা

আসলে আমরা মেয়েরাই হয়তো নিজেদের স্বাধীনতা পুরুষের কাছে বন্ধক রাখতে বড় ভালোবাসি, নচেৎ অধিকাংশ ক্ষেত্রে কেনই মহিলাদের কথা বলার জন্য সবথেকে বড় প্রতিকূলতা হয়ে ওঠেন মহিলারা নিজেরাই।?পুরুষকে বন্ধুভাবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে, সহজভাবে পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রেও বাধা আসছে মহিলাদের তরফ থেকে এমন নিদর্শনও প্রায়ই দেখা যায়। নিজেদের ডানা মুক্ত করার জন্য একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও মহিলাদেরই সবার প্রথমে আলোর দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। নারীর কথা নারী বলবে নিজেই আর এই বলার অভ্যাসই একদিন মুক্তমঞ্চে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষকে মুক্ত এক দূষণমুক্ত সতেজ পৃথিবীর নাগরিক হিসাবে এক মঞ্চে শামিল হওয়ার আহ্বান জানাবে।

Skip to content