রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


বিখ্যাত পরিবেশবিদ তুলসী গৌড়া।

বলা হয় গাছগাছালির মধ্যে থাকলে তাদের কথোপকথন শোনা যায়। সুবিখ্যাত পরিবেশবিদ তুলসী গৌড়ার ক্ষেত্রে এই কথাটা বোধহয় সবচেয়ে সত্যি। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, এটা কীভাবে সম্ভব হয়েছে তিনি নিজেও জানেন না, তবে তিনি অরণ্যের ভাষা বলতে এবং বুঝতে পারেন। ১৯৪৪ সালে কর্ণাটকের অঙ্কোলা তালুকের হোন্নাল্লি গ্রামের হালাক্কি সম্প্রদায়ভুক্ত আদিবাসী পরিবারে তুলসী গৌড়ার জন্ম। ছোট থেকেই গাছগাছালির মধ্যে বেড়ে ওঠা, তাই পরিবেশের সঙ্গে তাঁর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক।
এমনিতেই দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্য ইকো-ট্যুরিজম, পঁচিশেরও বেশি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং পাঁচটি ন্যাশনাল পার্কের জন্য খ্যাত। সেই রাজ্যের বাসিন্দা তুলসী গৌড়া মাত্র বার বছর বয়স থেকে নিরলসভাবে তিরিশ হাজারেরও বেশি গাছ লাগিয়েছেন যার মধ্যে ওষধি গাছ আছে তিনশো রকমের। কর্ণাটকের বন দফতরের স্বেচ্ছাসেবকের কাজও করেছেন তিনি।
আরও পড়ুন:

দশভুজা: তিনিই সারস্বত সাধনার প্রতিরূপা সত্যিকারের দশভুজা

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১: আমি ‘কেবলই’ স্বপন…

মাত্র দু’বছর বয়সে তিনি তাঁর বাবাকে হারান। বাবার মৃত্যুর পর নিজের মা ও বোনের সঙ্গে তিনি স্থানীয় নার্সারিতে শ্রমিকের কাজ করতে শুরু করেন। তাই স্কুলে যাওয়ার সুযোগ কখনও হয়নি। এই নার্সারিতে কাজ করতে করতেই তাঁর গাছপালার প্রতি ভালবাসা জন্মায়, কিন্তু তাঁদের আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রথা অনুযায়ী ১০-১২ বছর বয়সে তুলসীর গোবিন্দে গৌড়া নামক এক বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহ হয়। তবে এই বিবাহ তাঁর জীবনে পৃথক কোনও মাত্রা কখনও যোগ করেনি।

তুলসী।

তাঁর জীবনের ৩৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি তাঁর মায়ের সঙ্গে কর্ণাটক বনদপ্তরের অধীনে উত্তর কন্নড় জেলার হোন্নাল্লি গ্রামের মাস্তিকাট্টি রেঞ্জে অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করে গিয়েছেন। এই রেঞ্জে ক্রমাগত বনসৃজনের যে প্রচেষ্টা সেখানে বন বিভাগের আগাসুর নার্সারিতে তুলসী অক্লান্তভাবে পরিশ্রম করতেন। শুধু বনসৃজন নয় সাধারণভাবে উদ্ভিদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা, বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও বীজ সংরক্ষণে তাঁর অসাধারণ দক্ষতার কারণে তিনি বনবিভাগের একজন স্থায়ী কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত হন এবং একটানা পনেরো বছর তিনি ওই পদে বহাল থাকেন। মোট ষাট বছর তুলসী স্থায়ী ও অস্থায়ী কর্মচারী হিসেবে কর্ণাটকের বনবিভাগের হয়ে কাজ করে গিয়েছেন। শুধু বনসৃজন নয় চোরাগোপ্তা শিকার এবং দাবানল মোকাবেলায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৮: জীবনে উন্নতি করতে হলে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গেই আপনাকে থাকতে হবে

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৪: কিশোরের শুধু কণ্ঠই নয়, তাঁর অভিনয় ক্ষমতাকেও গানের নেপথ্যে সুকৌশলে কাজে লাগাতেন পঞ্চম

উদ্ভিদবিদ্যা অনুযায়ী প্রত্যেক প্রজাতির গাছের একটি মাতৃগাছ থাকে। তাঁর অন্যতম গুণই হল, যে কোনও প্রজাতির গাছের মাতৃগাছ (Mother Tree) তিনি খুঁজে বের করতে সক্ষম। এই মাতৃগাছেরা মাটির নীচের নডের মাধ্যমে চারাগাছ এবং বীজ থেকে বেড়ে ওঠা কচি অঙ্কুরগুলোকে নাইট্রোজেন ও নিউট্রিয়েন্টস সরবরাহ করে থাকে। গৌড়া তাঁর অনায়াস দক্ষতায় অঙ্কুরোদগমের সময় মাতৃগাছ থেকে বীজ সংগ্রহে সক্ষম। যদিও এই প্রক্রিয়া খুব জটিল কিন্তু তিনি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই কাজ করতে জানেন। তাঁদের হালাক্কি আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিশ্বাস অনুযায়ী মাতৃতন্ত্র প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত এবং তাঁরা তাঁদের অঞ্চলের ভূমি সংরক্ষণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তুলসী।

প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণে তাঁর অবদানের কারণে এবং কর্ণাটক বনবিভাগে বীজ উন্নয়ন (seed development) এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তুলসী গৌড়াকে পুরস্কারে, সম্মানে ভূষিত করা হয়। ১৯৮৬ সালে তিনি ‘ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী বৃক্ষমিত্র পুরস্কার’ (IPVM) লাভ করেছিলেন। এই পুরস্কার সাধারণভাবে পতিত ভূমি উন্নয়ন এবং বনসৃজনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করা হয়। ভারত সরকারের পরিবেশ ও বনমন্ত্রক ১৯৮৬ সালে প্রথম এই পুরস্কার প্রদান শুরু করে এবং সেই বছরেই তুলসী এই পুরস্কারে সম্মানিত হন। এরপর ১৯৯৯ সালে তুলসী গৌড়াকে কর্ণাটক রাজ্যের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘কর্ণাটক রাজ্যোৎসব পুরস্কার’ প্রদান করা হয়। কর্ণাটক রাজ্যের যেসব নাগরিকের বয়স ষাট বছরের বেশি, তাঁদের ব্যক্তিগত কৃতিত্বের জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হয়। সেই বছর পরিবেশ সংক্রান্ত কাজের জন্য যে দুইজন প্রবীন নাগরিককে এই পুরস্কার দেওয়া হয় তার মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২২: স্টেরয়েড বড় ভয়ঙ্কর ওষুধ?

ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-৫: চেয়ারে বসতে গিয়ে নজর গেল বিছানায়, দেখি সেই পুতুলের সবুজ চোখ দুটো আমাকে দেখছে

এরপর ২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি ৭১তম প্রজাতন্ত্র দিবসে ভারত সরকার তাঁর সারা জীবনের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তুলসী গৌড়াকে ভারতবর্ষের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারে ভূষিত করেন। ২০২১ সালের ৮ নভেম্বর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের হাত থেকে তিনি এই পুরস্কার গ্রহণ করেন। পুরস্কার নেওয়ার সময় তুলসী খালি পায়ে, নিজেদের সম্প্রদায়ের চিরাচরিত পোশাক আর পারম্পরিক গয়নায় হাজির হয়েছিলেন। দেখে মনে হচ্ছিল, ঠিক যেন এক অরণ্যচারী মানুষ আর এই ঘটনায় আলোড়িত হয়েছিল সমগ্র ভারত। এই অনুষ্ঠানে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী-সহ বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। তুলসী গৌড়ার সারল্য ও সাফল্যকে প্রধানমন্ত্রী ‘সাধারণ মানুষের জয়’ আখ্যা দেন।

২০২১ সালের ৮ নভেম্বর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করছেন তিনি।

এত জনপ্রিয়তার পরেও তাঁর জীবনাচরণে কোনও পরিবর্তন হয়নি। তিনি আজও কর্ণাটকের এক কুঁড়েঘরে দিনযাপন করেন। কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই উদ্ভিদ সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান যেমন বিস্ময়াবহ তেমনই তিনি তাঁর সেই জ্ঞানকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে আগ্রহী। এক লাখের ওপরে গাছ তুলসী তাঁর রাজ্যে লাগিয়েছেন বলে মনে করা হয়। উত্তর কন্নড় জেলার নাগরাজ গৌড়া, যিনি হালাক্কি জনজাতিদের নিয়ে কাজ করে থাকেন, তিনি বলেন গৌড়া তাঁদের সম্প্রদায়ের গর্ব। যে তিনশোরও বেশি ওষধি গাছ তুলসী তাঁর গ্রামে লাগিয়েছিলেন তা গ্রামের মানুষদের বিভিন্ন অসুস্থতার সময় কাজে এসেছে। স্থানীয় মানুষের তুলসী আজ্জি, ‘বৃক্ষদেবী’ তিনি শুধু গাছপালাই নয় তাঁর সম্প্রদায়ের মহিলাদের অধিকার রক্ষায়ও সমান সোচ্চার। বিশ্ব পরিবেশ দিবসে এই মহীয়সী তাই সর্বাগ্রে স্মরণীয় ও বরণীয়।
* ড. বিদিশা মিশ্র (Bidisha Misra), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। বিদিশা বাঙালি নৈয়ায়িক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য্যের গ্রন্থ কাব্যবিলাসের উপর গবেষণা করেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের পত্রিকায় তাঁর শোধপত্রগুলো প্রকাশিত হয়েছে।

Skip to content