মা সারদা।
দুপুরের নিস্তব্ধতা ভেঙে আওয়াজ আসে, সব্জি নেবে গো সব্জি। ভ্যান ঠেলে ঠেলে নিয়ে চলে এক শীর্ন দেহি মহিলা। ক্লান্ত দুটি চোখ। মাথায় একটা টুপি। ভ্যান ভরা মরসুমি সব্জি। নাম দীপা বিশ্বাস। কোভিডের সময় থেকে বাজার উঠে এসেছিল বাড়ি বাড়ি। পুরুষদেরই সব্জি ফেরি করতে দেখেছি এতদিন কল্যাণীতে।
দীপার থেকে সব্জি কিনতে একদিন তাই জিজ্ঞেস করলাম। এমন কঠিন এক কাজে কীভাবে এল সে। চরম অভাব থেকে বার হওয়ার পথ পাচ্ছিল না সে একসময়। তাই সংসারের হাল ধরতে সব্জির ভ্যান নিয়ে দোরে দোরে ঘোরে। ও ভ্যান চালাতে পারে না। ভারী সব্জি ভর্তি ভ্যান ঠেলে নিয়ে ফেরি করে। স্বামী ও দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসার। দারিদ্রের কারনে ছেলে এক আত্মীয়র বাড়িতেই মানুষ হয়। মেয়ে অল্প বয়সেই বিয়ে করে ফেলেছে প্রায় বেকার এক ছেলেকে। তাকেও একটু আধটু সাহায্য করতে হয়।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৬: বৎসল্যরসে মা সারদা
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৯: সুন্দরবনের পাখি: টুনটুনি
দীপা প্রায় বাধ্য হয়েই এ পেশা নিয়েছে। পাশে কেউ থাকবে না জেনে ও। তবে এখন তার স্বামী সব্জি এনে ভ্যানে গুছিয়ে দেয় ভোরবেলা। দীপার দিন শুরু হয় ভোর তিনটেয়। রাঁধাবাড়া করে সকাল সকাল বেরোয়। সারাদিন ফেরি করে।
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৪: পরবর্তী পদক্ষেপ
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৩: দেবেন্দ্রনাথ হয়েছিলেন ‘কল্পতরু’
তিনবছর ধরে শুরু করেছে এ কাজ। পড়াশুনো শেখেনি। হিসেব করতে থতমত খেত। ভ্যান চালাতে পারে না, হিসেব পারে না…তবে এ কাজ নিল কেন? সে গল্প শুনে স্তম্ভিত হলাম। কোভিডের সময় স্বামীর রাজমিস্ত্রির কাজ চলে যায়। সব্জি বিক্রি করে সংসার চালাবে ঠিক করে। দু-একদিন করার পর তার এ কাজে মন লাগে না। রোজই বিরক্তি, অশান্তি। দোরে দোরে অপেক্ষা, সারাদিন ফেরি করা, এসব তার দ্বারা হবে না। সাফ জানিয়ে দিল দীপাকে।
আরও পড়ুন:
গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৯: আসছে আমার পাগলা ঘোড়া
গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১১: কাঁটার মুকুট
তারপর একদিন ভ্যান ভরা সবজি বিলিয়ে দিতে শুরু করল। দীপা ছুটে এসে বাধা দেয়। এমন করলে খাবে কি? নিজেই এ কাজ করবে বলে এগিয়ে আসে। আগে পিছে না ভেবে কাজে ঝাঁপিয়ে পরে। প্রথম প্রথম অসুবিধে হয়েছিল হিসেব না জানার জন্য। কিছু পুরুষ ক্রেতা বেশি জিনিস নিয়ে কম পয়সা দিত। উল্টো পাল্টা বুঝিয়ে দিত। আবার আশ্চর্য ভাবে কোনও কোনও গৃহবধূ বেরিয়ে এসে তাকে রক্ষাও করেছেন। প্রতিবাদ করেছেন ওকে ঠকানোর জন্য। এমন ভাবেই তার পথ চলা শুরু হয়েছিল।
এরপর স্বামীও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।এখন কেনা কাটা স্বামী করে । দীপা কল্যানির বি-টু এর (B2) বিস্তৃত অঞ্চলে সকাল থেকে বিকেল ভ্যান ঠেলে ঠেলে দোরে দোরে সব্জি বেচে। প্রথম প্রথম ভরসা করে অনেকেই কিনত না।
এরপর স্বামীও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।এখন কেনা কাটা স্বামী করে । দীপা কল্যানির বি-টু এর (B2) বিস্তৃত অঞ্চলে সকাল থেকে বিকেল ভ্যান ঠেলে ঠেলে দোরে দোরে সব্জি বেচে। প্রথম প্রথম ভরসা করে অনেকেই কিনত না।
আরও পড়ুন:
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৬: আলাস্কার আকাশে অহরহ ব্যক্তিগত বিমান ওঠানামা করে
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪১: রবীন্দ্রনাথ ও ব্রজেন্দ্র কিশোর
এছাড়া কম্পিটিশন এর বাজার। আগের থেকে অনেক সব্জিওয়ালা আছে। তাদের সঙ্গে থেকে নিজের জায়গা করে নিতে অনেকটা সময় লেগেছে তার। হিসেব পত্র ও শিখতে সময় লেগেছে। কিছু গচ্চাও গিয়েছে। পড়াশুনো না শিখে ও দিব্যি মুখে মুখে হিসেব করে ফেলে দীপা। সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত দৃষ্টি। কিন্তু সেখানে জয়লাভের দৃঢ়তা। আছে স্বপ্নও। একখানা নিজের বাড়ি করার। দীপার ম্লান মুখে হাসির ঝিলিক দেয় নিজের বাড়ির কথা বলতে গিয়ে।
* ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।