সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


ছোটদের সঙ্গে।

‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ দীর্ঘ পথ ধরে এগিয়ে চলেছেন এক নারী। একা। অনেক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়েছেন। এখনও থামেননি। তবে সঙ্গে কিছু সহযোগী পেয়েছেন। তৈরি হয়েছে ‘সৃষ্টির পথে’ নামে সংস্থা।

প্রায় তিন দশক হতে চলল। যাত্রা শুরু করেছিলেন মধ্যমগ্রামের নূপুর ঘোষ। পারিবারিক সূত্রে অর্জন করেছিলেন মানবসেবার এক ব্রত। চাকরির সুবাদে ট্রেনে রোজ যেতে জুতো পালিশওয়ালা ছোট ছোট শিশুদের দেখতেন। কচি হাত কালি মাখা। শক্ত খসখসে। খালি পা। ধীরে ধীরে তাদের বোঝাতে লাগলেন স্কু্লে যেতে হবে। কাজটি সহজ নয়। কিন্তু অসম্ভবও হয়নি।
পথনাটিকা, সচেতনতা শিবির ক্রমাগত করে সবাইকে বোঝাতে লাগলেন স্কুলে যাওয়ার গুরুত্ব। গর্ব করে নূপুর বললেন যে, এখন লোকাল ট্রেনে একটি ও শিশু জুতো পালিশওয়ালা নেই। মধ্যমগ্রামে স্কুল করেছেন পথশিশুদের জন্য। নিজে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাতে কাজ করতেন। তাই অনেক প্রারম্ভিক অভিজ্ঞতা ছিল।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-৯: পুর-হিতায় সংস্থিতা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৫: রবি ঠাকুরের বড় মেয়ে— যিনি লেখক হতে চেয়েছিলেন!

ব্যক্তিগত জীবনে ইতিমধ্যে নেমে এসেছে এক বিপর্যয়। একমাত্র পুত্র পায়ে পেরেক বিঁধে ইনফেকশন হয়ে মারা যায় ২০১০-এ। পুত্রহারা মা সমস্ত ছোট ছোট স্কুলছুট পথশিশুদের মা হয়ে উঠেছেন। বিয়াল্লিশ জন পথশিশুকে নিয়ে ছেলের স্মৃতিতে গড়েছেন সৃষ্টির পাঠশালা। সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারে। শুধু স্কুল বা পড়ার ব্যবস্থা করেই থেমে থাকেনিনি। শিশু নির্যাতন, পাচার ইত্যাদির বিরুদ্ধেও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এ কাজে সহায়তা পেয়েছেন পুলিশের।

চলো পাল্টাই।

রাত-বিরেতে এরকম কোনও ঘটনা শুনলেই ছুটে যান ঘটনা স্থলে। পুলিশের সঙ্গে। উদ্ধার করে আনেন নিগৃহীতাকে। তারপর তাকে যথাস্থানে ফিরিয়ে দেওয়া বা কোনও হোমে নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা করেন। তার নিজের জীবন ও বিপন্ন হয়। ভয় দেখানো হয়। কিন্তু দমে যাওয়ার মেয়ে নন নূপুর। যে লড়াই শুরু করেছিলেন ১৯৯৬ সালে আজ তার অনেক শাখা প্রশাখা। নানারকম কর্মকাণ্ড চলে। মহিলা নির্যাতনের বিরুদ্ধেও কাজ করেন। বেশ কিছু ঘটনা বললেন যৌন নির্যাতনের। শিউরে ওঠার মতো। পাঁচ বছর, তিন বছর এ সব বয়েসের শিশু কন্যাকে ধর্ষণের। দোষীকে শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত থামেননি।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-২: রাজমালা অনুসারে রত্ন মাণিক্যের পিতা হলেন ডাঙ্গর ফা, তিনিই ধর্ম মাণিক্য

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৯: সুন্দরবনের ব্যাঘ্র-ইতিহাস

নানারকম সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান, বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র, বেসিক কিছু আত্মরক্ষার শিক্ষা, প্রাথমিক শিক্ষা এ সবের ব্যবস্থা ও করেছেন। সরকারি কোনও অনুদান পাননি। তবে অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। এছাড়া শুধু আর্থিক সাহায্য করতে ইচ্ছুক লোকেদের জন্য একটি প্রকল্প আছে। স্পনসর শিপ। কেউ ইচ্ছে করলে কোনও একটি বাচ্চার পড়াশুনোর দায়িত্ব নিতে পারেন। আবার পড়াশুনো বা অন্যান্য দায়িত্ব ও একসঙ্গে নিতে পারেন। আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী। পথশিশু, স্কুল ছুটদের স্বনির্ভর করাই উদ্দেশ্য।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮২: রবীন্দ্রনাথ সাহেব-শিক্ষকদের কাছেও পড়েছেন

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৭: শ্যামাসুন্দরী দেবীর লোকান্তর গমন

নিজের কাজের স্বীকৃতি মিলেছে কিছু পুরস্কারে। এত রকমের কাজ কীভাবে করেন তিনি? কোথা থেকে পান এ অনুপ্রেরণা, এ শক্তি। জিজ্ঞাসা করেছিলাম। নূপুর তাঁর ছেলেমেয়েদের প্রতিষ্ঠিত দেখে গরবিনী। সেখান থেকেই তাঁর কাজের সত্যিকারের পুরস্কার, অনুপ্রেরণা। লম্বা হিসেব দিলেন ছেলেমেয়েরা কে কোথায় কত বড় বড় চাকরি করছে। তবে এতবড় কর্মকাণ্ডে আর্থিক টানাটানি লেগেই থাকে। সঙ্গে জেগে থাকে আর ভালো আরও বড় করার ইচ্ছে। শিশুদের স্কুলে দুটো করে বিস্কুট দিলে কি হয়? মন চায় ওদের আরেকটু খাবার দিই। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন নূপুর।
* ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content