শনিবার ৯ নভেম্বর, ২০২৪


সরস্বতীর লীলাকমল যেসময়ের মেয়েদের কথা বলছে, রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা তখন সাহিত্যের আকাশের মধ্যগগনে। বিশ্বকবির তিন মেয়ে। তাঁরাও পেয়েছিলেন বাবার সাহিত্যিক বোধ। কিন্তু তিনজনের মধ্যে দু’ জনের অকাল প্রয়াণ কিছু সাহিত্যিক অনুষঙ্গস্তব্ধ করে দিল। আজ বলি রবি ঠাকুরের তিন মেয়ের কথা।

ছোটগল্পের অনেক কিশোরী চরিত্র বিয়ের পর বাবার কথা ভেবে মনকেমন করে। সে নিরুপমা হোক বা হৈমন্তী! শব্দের প্রাচীর ভেদ করে অনুভূতির আলো ফেললেই দেখা যাবে এক বুভুক্ষু পিতৃহৃদয় গল্পের আনাচে কানাচে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। সে কি মাধুরীলতা, রেণুকা আর মীরার বাবা? কথায় কথায় আজ বলি রবীন্দ্রনাথের মেয়েদের গল্প।

দুই ছেলে রথীন্দ্রনাথ আর শমীন্দ্রনাথের কথা এক প্রান্তে রেখে আজ তিনটি মেয়ে ও তাদের বাবার কথা অল্প শব্দের তুলিতে গল্প হয়ে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি।

বড় মেয়ে মাধুরীলতা তথা রবীন্দ্রনাথের বেলিবুড়ি কেমন ছিলেন? অনেকটা ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের মিনির মতো। প্রথম সন্তান! তাই বাবার ভালোবাসা বড় আবেগে জড়িয়েছিল তাকে। ঠাকুরবাড়ির মেয়ে! কিন্তু স্কুলে যাননি মাধুরীলতা। বাড়িতে লেখাপড়া করেছিলেন। সিস্টার নিবেদিতার কাছে মেয়ের শিক্ষার বিষয়ে পরামর্শ নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। গান, সাহিত্য এমন কি নার্সিং পর্যন্ত শিখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রতিভাবান বাবা যখন শিলাইদহের নির্জনতায় একের পর এক সৃষ্টি করেই চলেছেন, তখন মায়ের সঙ্গে মাধুরীলতার মনও হাঁপিয়ে উঠত, বিখ্যাত বাবাকে অবলীলায় বলতেন তিনি, ‘তোমার একলা মনে হয় না, কেন না তুমি ঢের বড় বড় জিনিস ভাবতে, আলোচনা করতে, সেগুলোকে নিয়ে একরকম বেশ কাটাও! আমরা সামান্য মানুষ, আমাদের একটু গল্পগুজব মানুষজন নিয়ে থাকতে এক একসময় একটু আধটু ইচ্ছে করে।’
রবীন্দ্রনাথ লেখার ভুবনে যতই প্রগতিশীল ভাবনার প্রকাশ করুন না কেন, মেয়েদের বিয়ে দিয়েছিলেন অতি অল্প বয়সে। সে বাবা দেবেন্দ্রনাথের অর্থের উপর নির্ভরশীলতার কারণেই হোক আর কবির খেয়ালিপনা —যাই হোক না কেন। মাধুরীলতার জন্য পাত্র নির্বাচিত হলেন কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর মেধাবী পুত্র শরৎ। কিন্তু রীতিমতো বরপণ দিয়ে বিয়ে দিতে হয়েছিল মাধুরীলতার। এই আক্ষেপ পরে করেছেন রবীন্দ্রনাথ। মাধুরীলতার সৌন্দর্য, গৃহিণীপনার কথা না হয় নাই বললাম, তাঁর সমাজ সংস্কারক রূপটি অবশ্যই উল্লেখযোগ্য।

একসময় কিছুদিন শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমে ছোট ছোট ছেলেদের পড়াতেন তিনি। মজঃফরপুরে লেডিস কমিটির সম্পাদিকা ছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ‘চ্যাপম্যান বালিকা বিদ্যালয়’। ঘোড়ার গাড়ি চড়ে মেয়েদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে শিক্ষার আলো দেখাতে চেয়েছিলেন অসূর্যম্পশ্যা মেয়েদের। ছোটোগল্পও লিখেছেন মাধুরীলতা। মৃণালিনী দেবীর লেখা অসমাপ্ত রামায়ণের কাজও করছিলেন তিনি। কিন্তু জীবন বড় জটিল। তাই জোড়াসাঁকোয় থাকাকালীন মনোমালিন্যের কারণে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল মাধুরীলতার। তারপর আবার যখন বাবার হাত মুঠিতে ভরে বলতে পেরেছিলেন, ‘গল্প বলো’— তখন মাধুরীলতার একত্রিশ বছর বয়স, শরীরে বেঁধেছে যক্ষারোগ, মৃত্যু এসে দাঁড়িয়েছে শিয়রে। প্রতিদিন মরণাপন্ন মেয়েকে গল্প শোনাতে যেতেন যে নিরুপায় বাবা, একদিন তিনি সিঁড়ি থেকেই ফিরে গেলেন, প্রিয়কন্যার প্রাণবন্ত মুখ আর কোনওদিন দেখতে পাবেন না বলে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৯: ভারতের বিপ্লবী মেয়েরা এবং অন্তরে রবীন্দ্রনাথ

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ছাগল ক্ষুরি ও ধানি ঘাস

রবীন্দ্রনাথের আরেক মেয়ে রেণুকা ছিলেন অন্যরকম। ঠাকুরবাড়ির মেয়ে, অথচ সাজতে ভালোবাসতেন না। একরোখা, জেদি মেয়েটি যেন ছিলেন এক উদাস সন্ন্যাসী। সব বিষয়ে তাঁর গভীর বিরাগ। চুল বাঁধা ছিলো তাঁর সবচেয়ে অপছন্দের কাজ। হতে পারে কালে কালে এই মেয়েও ঠাকুরবাড়ির এক দার্শনিক হয়ে উঠতে পারতেন, কিন্তু মাত্র এগারো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ খুঁজে নিয়ে এলেন সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য নামের একটি মেধাবী পাত্র। মৃণালিনী দেবীকে ডেকে বললেন, ‘রাণীর বিয়ে ঠিক করে এলুম–ছেলেটিকে আমার বড়ো ভালো লেগেছে ছোটবৌ, যেমন সুন্দর দেখতে, তেমনি মিষ্টি অমায়িক স্বভাব। রাণীটা যে জেদী মেয়ে, ওর বর একটু ভালোমানুষ না হলে চলবে কেন?’

রেণুকা ওরফে রবি ঠাকুরের আদরের রাণী কিন্তু এই বিবাহ খুশি মনে মেনে নেয়নি। বিয়ের অনুষ্ঠান নিঃশব্দে করে চলেছিলেন বটে! কিন্তু মনে মনে গৈরিক সন্ন্যাস নিয়েই পৃথিবীতে এসেছিল যে মেয়ে, সে হারিয়ে গেল সব বন্ধন ছেড়ে। মা মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর কয়েক মাসের মধ্যেই চিরদিনের মতো হারিয়ে যায় অভিমানী রেণুকা। শরীরে বাসা বেঁধেছিলো যক্ষ্মারোগ। চেষ্টা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। হাজারিবাগ আর আলমোড়ায় হাওয়াবদল, ডাক্তার, ওষুধ, মেয়েকে সময় দিয়ে কবিতা শোনানো— সবকিছুই ব্যর্থ হয়। মৃত্যুর ঠিক আগে, রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন রেণুকা, ওঁ পিতা নো’ সি বলতে। আসলে বাবাই ছিলেন তাঁর একমাত্র ভরসার জায়গা। তাই বাবার হাত ধরেই জীবনের শেষ দরজাটুকু পার হতে চেয়েছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের আরেক মেয়ে অতসীবালা তথা মীরা দেবীর লেখা স্মৃতিকথায় রেণুকার সম্পর্কে জানা যায়। ওঁ পিতা নো’ সি শুনে যে মেয়ে পৃথিবীর বাস উঠিয়েছিলেন, তাঁর বাবার মনের আদরের সিংহাসনে নিত্য আসা যাওয়া ছিল তাঁর।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৯: শাসক বেকায়দায় পড়লেই প্রতিপক্ষকে সন্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদিও রাজনীতিতে সে সব মানা হয় না

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৫২: পুলক রাখিতে নারি (কেল)

দীর্ঘজীবনে কষ্ট এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর সামনে। জীবনের পথে সেই দুঃখকে অতিক্রম করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন আপ্রাণ। কিছু কিছু মানুষ থাকে, যাদের সব থেকেও ঘর থাকে না। সেইসব অনিকেত মানুষদের একজন মীরা দেবী। একের পর এক মৃত্যু যখন আছড়ে পড়ছে রবিঠাকুরের সংসারে, তখন এই ছোট মেয়েটি কখনো জ্ঞানদানন্দিনী, কখনও মাধুরীলতা কখনও রাজলক্ষ্মীদেবীর কাছে। শেষ পর্যন্ত তাঁর ঠিকানা হয় শান্তিনিকেতনের ‘মালঞ্চ’। বেশ বিদূষী ছিলেন মীরা। মৃণালিনী দেবী ছিলেন যখন, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মীরাকে নিজের পুত্রবধূ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মণ বংশের নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে মীরার জন্য পছন্দ করলেন। মীরার বিবাহিত জীবন সুখের হল না। দাম্ভিক স্বামীর সঙ্গে ঘর করতে পারলেন না মীরা। পুত্র নীতিন্দ্র আর কন্যা নন্দিতাকে নিয়ে মীরাদেবী একলাই কাটালেন জীবন।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৩: বেলুড়মঠে শ্রীমায়ের অভিনন্দন

রবীন্দ্রনাথও নগেন্দ্রনাথকে বোঝাতে পারেননি কোনওভাবেই। তাঁদের বিচ্ছেদের আগে রবীন্দ্রনাথ নগেন্দ্রকে লিখেছিলেন, ‘তোমাদের পরস্পরের সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন হয়ে যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে সেটা আমার পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর। যদি এর কোনো প্রতিকারের সম্ভাবনা থাকতো আমি চেষ্টা করতুম। কিন্তু জিনিসটা এমন যে লেশমাত্র জোর খাটে না— তাছাড়া এরকম সম্বন্ধের মধ্যে একটুও জোর খাটানোটা আমি কোনোমতেই উচিত বলে মনে করি নে। এমন অবস্থায় তোমাদের নিষ্কৃতি দেবার পক্ষে আমার দ্বারা যা করা সম্ভব আমি তা করতে বাধ্য।’ শোনা যায়, বিয়ের রাতে মীরা দেবীকে গোখরো সাপ ছোবল দিতে গিয়েছিল। মীরার জীবনের যন্ত্রণা দেখে রবীন্দ্রনাথ অনেক দুঃখে রথীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, ‘আজ আমার মনে হয় সে সাপ যদি ওকে তখন কাটত তাহলে ও পরিত্রাণ পেত।’
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮২: খটকা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

এরপর মীরাদেবী দুই সন্তানের মৃত্যুও দেখবেন। নিজের কষ্টকে প্রকাশ করেন নি কখনো জীবনের পথে। একদিন লিখে ফেললেন ‘স্মৃতিকথা’। আশ্চর্যভাবে সেই স্মৃতিচারণায় স্বামী নগেন্দ্রের কোনও উল্লেখ নেই। চিত্রা দেব এই প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘মীরার মন থেকে তিনি একেবারেই মুছে গিয়েছিলেন।’ হয় তো তা নয়। অভিমানী মুখচোরা মেয়েটি জীবনের সবচেয়ে বড়ো কষ্টের নামটা স্মৃতিকথাতেও এড়িয়ে গেলেন। নগেন্দ্রকে নির্বাসন দিলেন নিজের সৃজনের পৃথিবী থেকে।

রবীন্দ্রনাথ স্নেহশীল বাবা ছিলেন। কিন্তু আবেগের বশে তিনটি মেয়ের বিয়ের বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। মাধুরীলতা, রেণুকা আর মীরার জীবন অত দ্রুত সাতপাকে না জড়ালে হয়তো একজন শিক্ষয়িত্রী, একজন দার্শনিক আর এক লেখিকাকে খুঁজে পেতাম আমরা। এই আক্ষেপ রবিঠাকুরের সাহিত্যে লুকিয়ে আছে। কিন্তু সমাধানের পথ তিনি নিজের হাতেই বন্ধ করেছিলেন।

সরস্বতীর লীলাকমল খুঁজে চলেছে এমন মেয়েদের, যারা জীবনের পথে আরো একটু সময় বা সুযোগ পেলে হয়তো বড় লেখক হতে পারতেন। বিশেষ করে রেণুকা। তবে মাধুরীলতা আর মীরার লেখা রয়েছে বাংলা সাহিত্যে। সেইসব লেখা একটি সময়ের দলিল।

ঋণ স্বীকার
ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, চিত্রা দেব
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content