প্রতিভা দেবী।
ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা ছিলেন রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী। ঠিক এমনটাই ছিলেন প্রতিভা দেবী, রবীন্দ্রনাথের সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথ আর নীপময়ীর বড় মেয়ে। বেথুন স্কুলে পড়াশুনা, গুণী সঙ্গীতজ্ঞদের কাছে গান এবং সেতার শিখেছিলেন প্রতিভা। ভাই হিতেন্দ্রনাথের সঙ্গে ‘বিদ্বজ্জন সভা’য় সেতারও বাজিয়েছেন। কিন্তু প্রতিভার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্মীকি প্রতিভা’র সংযোগটাই অমরতা পেল। প্রতিভা তখন বেথুন স্কুল ছেড়ে ভর্তি হয়েছেন লরেটো হাউসে, তার বছর দুই পর ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ মঞ্চস্থ হল। রবীন্দ্রনাথ নিজে অভিনয় করলেন বাল্মীকির ভূমিকায় এবং প্রতিভা হয়েছিলেন সরস্বতী।
ইন্দিরাদেবী তাঁর স্মৃতিকথায় এই প্রসঙ্গে মজাদার ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উৎসাহ ছিল দেখার মতো। তাঁর কথা বলতে গিয়ে ইন্দিরা দেবী লিখছেন, ‘জ্যাঠামশায়ের একটু অভ্যেস ছিল হঠাৎ হঠাৎ ‘এই যে অমুক সাহেব’ বলে স্নেহভাজনদের পিঠ থাবড়ে দেওয়া। প্রথম বাল্মীকি প্রতিভার অভিনয়ের পরে প্রতিভাদিদি সরস্বতী সেজে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলে তিনি তাঁর পিঠ থাবড়ে ‘এই যে সরস্বতী সাহেব’ বললেন। ‘যতবারই’ বাল্মীকি প্রতিভা’ র অভিনয় হয়েছে ততবারই প্রতিভা সেজেছিলেন সরস্বতী। সাদা শোলার পদ্মফুলে শুভ্র সাজে অস্ট্রিচ পাখির ডিমের খোলা দিয়ে তৈরি বীণাটি হাতে নিয়ে বসেছিলেন তখন সকলে প্রথমে ভেবেছিলেন মাটির প্রতিমা। তারপর যখন দর্শক প্রতিভার মুগ্ধ কন্ঠ শুনলেন, যখন সরস্বতীর হয়ে বললেন প্রতিভা—‘এই নে আমার বীণা, দিনু তোরে উপহার—যে গান গাহিতে সাধ, ধ্বনিবে ইহার তার।’ —দর্শক মন্ত্রমুগ্ধ! এই মুহূর্তটুকু অমর হয়ে গেল নানা স্মৃতিকথায়। আজ ঠাকুরবাড়ির এই সরস্বতীর গল্প বলি।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৭: মৃণালিনীর চিঠি
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৯: সুন্দরবনের পাখি: টুনটুনি
গান নিয়ে অনেকরকম কাজ করেছেন প্রতিভা। তিনি স্বরলিপি রচনার সহজ উপায় আবিষ্কার করেছিলেন। বাল্মীকি প্রতিভা, কালমৃগয়ার স্বরলিপিও রচনা করেছিলেন নিজে। হেমেন্দ্রনাথ বলেছিলেন বলে তিনি ব্রহ্মসঙ্গীত ও হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের স্বরলিপি তৈরি করেন। জ্ঞানদানন্দিনী সম্পাদিত ‘বালক’ পত্রিকায় প্রতিভার স্বরলিপি প্রকাশ হতে থাকে একের পর এক। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা স্বরলিপিকে আরো সহজ ও সকলের পক্ষে বোধগম্য করে তুলেছিলেন প্রতিভা। এর আগে কোনো মহিলা স্বরলিপি তৈরি করতে এত উৎসাহী হননি।
‘পুণ্য’ পত্রিকার সূত্র থেকে থেকে জানা যায় এই স্বরলিপির সংখ্যা প্রায় তিনশো চারশো। এরপর এইসব গানগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বও নিলেন প্রতিভা। প্রকাশ্যে গান শেখাবার চেষ্টা শুরু করলেন। কাগজে কলমে গানের ক্লাস শুরু হল ‘গানের সহজশিক্ষা’ নামে। প্রতিভা বললেন, ‘গান মানুষের স্বাভাবিক।’ যত পরিণত হয়েছেন প্রতিভা, ততই সঙ্গীত সম্পর্কে তাঁর বোধ আরো গভীর হয়েছে। এরপর প্রতিভার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হল আনন্দসভা’ এবং ‘সঙ্গীত সংঘ’। ওস্তাদী হিন্দুস্তানী গান শেখাতেন প্রতিভা। তিনি কিন্তু সঙ্গীতজ্ঞ নিকলিনির কাছে পাশ্চাত্য সঙ্গীত শিখেছিলেন । মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে পিয়ানো উপহার পেয়েছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ নিজেও খুব ভালোবাসতেন প্রতিভার পিয়ানো শুনতে। বাঙালি মেয়েরা এবার স্বচ্ছন্দ গান শিখতে শুরু করল।
‘পুণ্য’ পত্রিকার সূত্র থেকে থেকে জানা যায় এই স্বরলিপির সংখ্যা প্রায় তিনশো চারশো। এরপর এইসব গানগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বও নিলেন প্রতিভা। প্রকাশ্যে গান শেখাবার চেষ্টা শুরু করলেন। কাগজে কলমে গানের ক্লাস শুরু হল ‘গানের সহজশিক্ষা’ নামে। প্রতিভা বললেন, ‘গান মানুষের স্বাভাবিক।’ যত পরিণত হয়েছেন প্রতিভা, ততই সঙ্গীত সম্পর্কে তাঁর বোধ আরো গভীর হয়েছে। এরপর প্রতিভার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হল আনন্দসভা’ এবং ‘সঙ্গীত সংঘ’। ওস্তাদী হিন্দুস্তানী গান শেখাতেন প্রতিভা। তিনি কিন্তু সঙ্গীতজ্ঞ নিকলিনির কাছে পাশ্চাত্য সঙ্গীত শিখেছিলেন । মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে পিয়ানো উপহার পেয়েছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ নিজেও খুব ভালোবাসতেন প্রতিভার পিয়ানো শুনতে। বাঙালি মেয়েরা এবার স্বচ্ছন্দ গান শিখতে শুরু করল।
আরও পড়ুন:
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪২: রবীন্দ্রনাথকে ‘ভারত ভাস্কর’ উপাধি দিয়েছিলেন রাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৪: আশ্রমের আনন্দময় পিকনিক
বাবা হেমেন্দ্রনাথের খুব আদরের ছিলেন প্রতিভা। হেমেন্দ্রনাথের গভীর মনোযোগ পেয়েছিলেন তিনি। কোনও ভাই বোন বা বন্ধুদের সঙ্গে সংযোগ ছিল না তাঁর। কপাট বন্ধ করে নিরলস সাধনায় মগ্ন থাকতেন তিনি। লরেটোর প্রথম হিন্দু ছাত্রী প্রতিভা। মেয়েদের জন্য তখন পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। তাই প্রথাগত ডিগ্রি না থাকলেও অনেক লেখাপড়া করেছিলেন প্রতিভা। সঙ্গীতচর্চাও তাঁর জীবনের অন্যতম সাধনা। বিদ্যোৎসাহিনী সভায় তাঁর গান আর সেতার শুনে মুগ্ধ হয়ে রাজা শৌরীন্দ্রনারায়ণ তাঁকে দিয়েছিলেন স্বরলিপির বই, রঘুনন্দন ঠাকুরের কাছ থেকে পেয়েছিলেন বিরাট এক তানপুরা। উনিশ শতকের মেয়েদের জন্য প্রতিভা খুলে দিয়েছিলেন এক দক্ষিণের জানালা। মেয়েদের অভিনয় ও গানের চর্চার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সেই আমলে কোনো উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরা গান বা অভিনয় করতে সাহস পেত না। প্রতিভা তাঁদের প্রেরণা হয়ে পথ দেখিয়েছিলেন। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’য় তাঁর অভিনয় সকলের মনে দাগ কেটেছিল। আর্যদর্শন কাগজে তাঁর অভিনয়ের প্রশংসা প্রকাশিত হয়েছিল—‘শ্রীযুক্ত বাবু হেমেন্দ্রনাথের প্রতিভা নাম্নী কন্যা প্রথমে বালিকা পরে সরস্বতীমূর্তিতে অপূর্ব অভিনয় করিয়াছিলেন।
আরও পড়ুন:
গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১১: কাঁটার মুকুট
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’
‘সাধারণী’ পত্রিকায় সমালোচক প্রতিভার অভিনয় প্রসঙ্গে লিখেছিলেন,‘ বঙ্গ কুল-কুমারী কর্তৃক রঙ্গবেদী এই প্রথম উজ্জ্বলীকৃত হইল। বঙ্গরঙ্গভূমির নবকলেবরের এই অভিষেক ক্রিয়ার প্রতিভা উপযুক্ত অধিষ্ঠাত্রী দেবী বটেন। তিনি সুকন্ঠা, গীতি নিপুণা, সতেজ নয়না এবং ধীর পদবিক্ষেপকারিণী। তাঁহার গীতাভিনয়ে দর্শকবৃন্দের অনেকে বিস্মিত এবং প্রীত হইয়াছিলেন। ‘সঙ্গীত বিষয়ক একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন প্রতিভা। তাঁকে সাহায্য করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ জ্ঞানদানন্দিনীর মেয়ে ইন্দিরা দেবী। পত্রিকার নাম ছিল ‘আনন্দ সঙ্গীত পত্রিকা।’ প্রাচীন সঙ্গীতশিল্পীদের জীবনের কথা প্রকাশ করতে লাগলেন প্রতিভা। রবীন্দ্রনাথ প্রতিভার মৃত্যুর পর বলেছিলেন, ‘সংগীত শুধু যে তাঁর কন্ঠে আশ্রয় নিয়েছিল তা নয়, এ তাঁর প্রাণকে পরিপূর্ণ করেছিল। এই মাধুর্যপ্রবাহ তাঁর জীবনের সমস্ত কর্মকে প্লাবিত করেছে।’ স্বরসন্ধিসহ কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি তৈরি করেছিলেন প্রতিভা। সংস্কৃত স্তোত্র,বেদগানের স্বরলিপি, ব্রহ্মসঙ্গীতের স্বরলিপি দক্ষ হাতে তৈরি করেছিলেন তিনি। সঙ্গীত ছিল তাঁর প্রাণের কেন্দ্রে। ধর্ম আর জ্ঞানতৃষ্ণার অপূর্ব যুগলবন্দী তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি ছিলেন বহুভাষাবিদ। তাঁর বক্তৃতামালা ‘আলোক’ নাম দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতাও লিখতেন তিনি। বিবাহ হয়েছিল সেই আমলের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব আশুতোষ চৌধুরীর সঙ্গে। তাঁর কাছ থেকেও প্রবল উৎসাহ পেয়েছিলেন প্রতিভা সব কাজে।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৪: দশরথপুত্র ভরত, এক ব্যতিক্রমী চরিত্র, বর্তমানের নিরিখে এক বিরলতম প্রজাতি
মুলো খেতে আপত্তি নেই, তা হলে তার পাতার কী দোষ করল? এই শাকের কত পুষ্টিগুণ জানেন?
জীবনে অনেক কিছু করার ছিল তাঁর। কিন্তু ছাপান্ন বছর বয়সে মৃত্যু হয় তাঁর। রয়ে যায় অনেক অসমাপ্ত কাজ!রয়ে যায় তাঁর বলা কথা—‘ভাল চিন্তা হৃদয়কে অধিকার না করলে ভাল হইবার দিকে অগ্রসর হওয়া যায় না। চিন্তার ভালমন্দ গতি আমাদের আচার ব্যবহারের গতি নিয়মিত করে। চিন্তা সংযত না হইলে আমাদের স্বভাব যথেচ্ছাচারী আর শিথিল হইয়া পড়ে। কিন্তু কাহার চালনায় এই চিন্তাকে আমরা সংযত করিতে পারি?কুপথ হইতে ফিরাইয়া লইতে পারি? সে সারথী কে? সে আর কেহ নয়—জ্ঞান। চিন্তাকে সুপথে পরিচালিত করিবার জন্য আমাদের জ্ঞানের শরণাপন্ন হইতে হইবে।’
সত্যিই সরস্বতী ছিলেন প্রতিভা, আজীবন সাধনা করে গিয়েছেন। সর্ব অর্থে তিনি ছিলেন ঠাকুরবাড়ির সরস্বতী।
ঋণ স্বীকার
● ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, চিত্রা দেব
● রবীন্দ্রস্মৃতি সংগ্রহ, ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী
সত্যিই সরস্বতী ছিলেন প্রতিভা, আজীবন সাধনা করে গিয়েছেন। সর্ব অর্থে তিনি ছিলেন ঠাকুরবাড়ির সরস্বতী।
ঋণ স্বীকার
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।