বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


মাতঙ্গিনী হাজরা ও বীণা দাস।

এখন ক্রান্তিকাল। সারা পৃথিবী প্রতিবাদী। অন্যায়ের স্পর্ধা যত বাড়ছে,জনসমুদ্র প্রতিবাদী তরঙ্গ হয়ে পথে নামছে। চিৎকার করে বলছে— জবাব চাই, জবাব দাও।’ নারী নিধনের হাঁড়িকাঠের ভিতর দিয়ে সভ্যতা এগোয় না। থমকে থাকে। তখন দুর্গার মতো নারীশক্তিকে এগিয়ে আসতে হয়। বিপ্লব আসে। এই বিপন্ন সময়ে দাঁড়িয়ে আজ সেই বিপ্লবী মেয়েদের কথা থাক সরস্বতীর লীলাকমলে, যারা একসময় পৃথিবী বদলে দিয়েছিল। সঙ্গে শব্দ হয়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

যদি বলি, রবীন্দ্রনাথ এক শক্তির নাম? অথবা বিপ্লবের? কতজন বিশ্বাস করবেন, জানি না! তবে, রবীন্দ্রনাথের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন, এমন বাঙালি বিরল! জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাঙালি জীবনের গল্পে জড়িয়ে আছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে সময় দিয়ে বিচার চলে না। তিনি অসীম, অনন্ত হয়ে বাঙালি জীবনের প্রাণভোমরা হয়ে যান। এই কথা অস্বীকার করার আর কোনো কারণ দেখি না।
যে সময়ের কথা বলবো, রবীন্দ্রনাথ তখন লিখছেন একের পর এক স্বর্ণলেখা। শুধু ড্রয়িংরুম বিলাসী প্রেমের অভিজ্ঞান নয়, তাঁর কলম অসির মতো খণ্ডন করছে বিধির বাঁধন ভেঙে ফেলা বিবেকহীন সভ্যতাকেও। তাঁর সাহিত্য লুকিয়ে রাখছে শব্দের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, যা বিপ্লবের জন্ম দেবে বাঙালির ঘরে ঘরে। বাংলার অনেক বিপ্লবী সন্তানের বুকের ভিতরের ঘুমন্ত আগুনকে আলোর জ্যোতিতে রূপান্তরের অন্তরালে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ—শব্দের অগ্নিকণা হয়ে।

রবীন্দ্রনাথ নিজেও ছিলেন নিয়মভাঙাদের দলেই। তাঁর সৃজনের ভুবনে তো ওই বেপরোয়া, নিয়মভাঙা তারুণ্যেরই জয়জয়কার। স্মৃতিচারণে লিখেছিলেন রবিঠাকুর জ্যোতিদাদার উদ্যোগে স্থাপিত স্বদেশী সভার কথা। কলকাতার গলির মধ্যে পোড়োবাড়ি! সেখানে বসতো গোপন বৈঠক। রহস্যে ঘেরা গোপনীয়তাই ছিল সেই সভার প্রাণ! দুপুরবেলা সকলকে ধোঁয়াশায় রেখে রুদ্ধ অন্ধকার ঘরে তাঁদের দীক্ষা হতো ঋকমন্ত্রে। খ্যাপামির তপ্ত হাওয়ায় আর উৎসাহের ঝোড়ো বাতাসে কিশোর রবিঠাকুরের কাজই ছিল উত্তেজনার আগুন পোহানো।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৮: নন্দিতা কৃপালনি— বিশ শতকের বিদুষী

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৪: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—গিরা শাক ও যদু পালং

পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই বিপ্লববাদকে সমর্থন করেছেন। ঋষি অরবিন্দের বন্ধু চারুচন্দ্র দত্ত তাঁর ‘পুরানো কথা— উপসংহার’ বইতে তাঁদের সহায়ক কিছু বড়ো মানুষের মধ্যে এক জগদ্বিখ্যাত সাহিত্যিকের উল্লেখ করেছিলেন। সম্ভবত সেই সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ! অনেক বিপ্লবী তরুণ তরুণীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পত্রালাপ হতো—এ এখন প্রমাণিত সত্য! বিখ্যাত বিপ্লবী সমিতি ‘অনুশীলন সমিতি’র সঙ্গেও রবীন্দ্রনাথের যোগসূত্র ছিল। জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁ লেনস্থিত শিবমন্দিরে অনুশীলন সমিতির একটি শাখা খোলা হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথের ছেলে রথীন্দ্রনাথের তখন ১৪/১৫ বছর বয়স। তিনি ওই সমিতির সদস্য ছিলেন। বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ একদিন এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছিলেন, ‘তোমরা যুবককর্মী, আমি কবিমানুষ। কবিতা লিখি গান করি। তোমাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তোমাদের মনকে জাগাবার জন্য কতকগুলি গান রচনা করব ও শোনাব।’ রবীন্দ্রনাথ মনের ভুবনের কারবারী। তাঁর কাজ ছিল শব্দের সোনার কাঠির স্পর্শে মনের ভিতরের ঘুমন্ত বিপ্লবী সত্তাকে জাগিয়ে তোলা। গান গাইতেন, ‘স্বদেশী সমাজ’ গড়ে তোলার পরিকল্পনা করতেন, দীনেন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে দিতেন বিপ্লবী তরুণদের কাছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

এমন একটা সময়ের কথা বলছি, যখন বাঙালির ঘরে ঘরে শুধু তরুণরা নয়, তরুণীরাও দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। প্রয়োজনে কারাবরণ এমন কি প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জনে প্রস্তুত থাকতেন। এ যেন রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা! স্নেহবলে মাতা, বাহুবলে রাজা! তাঁদের অন্তরেও শক্তি হয়েছিলেন রবি ঠাকুর। পরবর্তীকালে পাওয়া স্মৃতিচারণায়, পত্রের অংশে রবীন্দ্রনাথের সেই বিপ্লবী মনের হদিশ পাওয়া যায়, যে মন শব্দের পরশমণির ছোঁয়ায় জাগিয়ে তুলেছে আরও অনেক বিপ্লবমুখী হৃদয়কে। যাঁদের মধ্যে অনেক নারীও ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসের এলার মতো সত্যি ছিলেন কিছু বীরাঙ্গনা।

‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন’ মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন কল্পনা দত্ত। যাঁর মুক্তির জন্য রবীন্দ্রনাথ গভর্নরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। কল্পনা দত্তের বাবাকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘তোমার কন্যার জন্য যা আমার সাধ্য তা করছি।’ কল্পনা দত্ত মুক্তি পাওয়ার পর তাঁকে আশীর্বচন জানিয়ে আবার পৌঁছে গিয়েছিল রবিঠাকুরের পত্র। লীলা রায় ছিলেন ঢাকায় ‘দীপালী সংঘের প্রতিষ্ঠাত্রী। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধেও তিনি শান্তিনিকেতনের কাজের দায়িত্ব নিতে পারেননি। কারণ তিনি তখন ব্যস্ত দেশের কাজে। পত্র বিনিময় হয়েছে লীলাদেবী ও রবীন্দ্রনাথের।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬২: শ্রীমার দক্ষিণ ভারত থেকে প্রত্যাবর্তন

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৮: চরম শত্রুর সঙ্গেও মতের মিল হলে বন্ধুত্ব হয়, আবার মতের মিল না হলেই শত্রুতা

লীলা রায়ের কারাবাসের মুহূর্তে রবীন্দ্রসাহিত্য বন্ধু হয়ে তাঁর সঙ্গে ছিল। রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন— ‘আমার সে দিনগুলিতে যুঝবার শক্তি পেয়েছিলাম, আপনার কবিতা ও গদ্যগুলি থেকে। সমস্ত মন তখন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠেছিল। এমন অবস্থায়—এমন বন্ধুর প্রতি।’ লীলা রায় সম্পাদিত ‘জয়শ্রী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের লেখাও চেয়েছিলেন তিনি। Evolution ও progress সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মতামত, Fascism, Communism সম্বন্ধে বক্তব্য জানতে চেয়েছিলেন লীলা দেবী। রবীন্দ্রনাথ ‘জয়শ্রী’ পত্রিকায় ‘পরিবর্তন’ নামে একটি সংক্ষিপ্ত লেখা লিখেছিলেন।

তিরিশের দশকে কারাবরণ করছিলেন, দেশের জন্য প্রাণ দিচ্ছিলেন একে একে অগ্নিকন্যারা— বীণা দাস, উজ্জ্বলা রক্ষিত, শান্তি দাস, সুনীতি চৌধুরী, কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার আরও কতজন! কারাবাসের নির্জন ও নির্মম প্রহরে তাঁদের সঙ্গে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বন্ধুর মতো শব্দ হয়ে, দুর্জয় সাহস হয়ে। গল্পে, কবিতায়, গানে, নাট্যে কারাজীবনকেও মাধুর্যমণ্ডিত করে তুলেছিলেন এই নারীরা। শান্তি দাস ছিলেন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। ইন্দুসুধা ঘোষ ছিলেন চিত্রশিল্পী।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮২: খটকা

একবার পুজোর সময় তাঁরা ‘মালিনী’ অভিনয় করেন। শান্তি দাসের লেখা ‘অরুণ বহ্নি’ বই থেকে একথা জানা যায়। বর্ষায় হত ‘বর্ষামঙ্গল’। শাড়ি রং করিয়ে একরকম করে পরার রেওয়াজ তৈরি হয়েছিল অনুষ্ঠানে। শরতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘তপতী’। শান্তি দাস লিখেছিলেন, ‘আমাদের উপর রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ছিল সুগভীর। বিপ্লবী জীবনে ও কারাজীবনে আমরা তাঁর কাব্য থেকে পেয়েছি প্রেরণা ও আনন্দ, ক্লীবত্ব পরিহার করে বীর্যবত্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগ্রামে লিপ্ত হবার বাণী তাঁর কাছ থেকে আমরা পেয়েছি।’ একবার জেল থেকে পালিয়ে যাবার পরিকল্পনা করেছিলেন মহিলা বিপ্লবীদের একটি গোষ্ঠী। পাহারাওয়ালাদের জুতো খটাখট শব্দের দম্ভের উপরে উঁচু তারে বাঁধা থাকতো তাঁদের কণ্ঠ—‘ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে মোদের বাঁধন ছুটবে।’

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও লীলা রায়।

গীতার বাণী নয়, রবীন্দ্রনাথের শব্দ শক্তি দিতো এইসব নারীর প্রাণে। লীলা রায় দীর্ঘ কারাবাসে রবীন্দ্রনাথের ‘মহুয়া’ মুখস্থ করে কাটিয়েছিলেন। বীণা দাস হিজলি জেলে তাঁর কারাবাসের সময়েও রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়েছিলেন একই ভাবে। কর্তব্যের কথা স্মরণ করার সময়ও রবীন্দ্রনাথ!

‘পুনর্বার তুলিয়া লইতে হবে কর্তব্যের ভার যে পথে চলিতেছিনু আবার সেপথে যেতে হবে।’আবার অনেকে রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া শ্রেণীর পলায়নবাদী কবিও মনে করতেন। তর্ক জমে উঠতো তরুণী বিপ্লবীদের আলোচনায়।

তর্কে বিতর্কে, ভালোবাসায়, প্রেরণায় সে যুগের মেয়েদের বিপ্লবেও সামিল হয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। হয়তো তাঁর নিজেরই অজান্তে গানে,কাব্যে তরুণী বিপ্লবীদের সঙ্গে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিপ্লবের পায়ে পা মিলিয়ে চলা এক নিয়মভাঙা অমর সহচর! তরুণী বিপ্লবের অন্তরে প্রেমের মতো শুদ্ধ এক দৃপ্ত আগুনের নাম ছিল রবীন্দ্রনাথ। আজ সেইসব মেয়েকে কুর্নিশ জানাই যারা অন্যায়ের শাসন মানে নি। কঠিনন অত্যাচার সহ্য করেও শুধু দেশকে ভালোবেসে গিয়েছে। তাঁরা দেবীর অংশ, তিল তিল করে অন্তরের শক্তির বারুদ তাঁদের অন্তরে ছিল। তাঁরাই তিলোত্তমা।

ঋণ স্বীকার
রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার বিপ্লবী সমাজ, মঞ্জুশ্রী মিত্র
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content