রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


বাস্তুশাস্ত্রে বিভিন্ন প্রকারের ভূখণ্ডের বর্ণনা করা হয়েছে৷ সাধারণত দুটি অংশে তা ভাগ করা হয়েছে৷
১. ভূমির বিভিন্ন দিকে উঁচু অথবা নিচু স্থান৷
২. আকারের ভিত্তিতে৷
প্রথমোক্ত ঢালু ভূখণ্ড সম্পর্কে জানার আগে আমাদের বিভিন্ন দিকের ভূমির উঁচু অথবা নিচু থাকার পরিণাম কী হতে পারে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা দরকার৷

বিভিন্ন দিকে ভূমি ঢালু হওয়ার শুভাশুভ

পূর্ব দিকে ঢালু থাকলে সেটি হবে ধনদায়ী ও উন্নতিকারী৷
আগ্নেয় দিকে ঢালু থাকলে কষ্ট, মৃত্যু ও পীড়াদায়ী৷
দক্ষিণ দিকে ঢালু থাকলে যশোহানি ও পুত্রহানি৷
নৈর্ঋত দিকে ঢালু থাকলে যশোহানি ও পুত্রহানি৷
পশ্চিম দিকে ঢালু থাকলে ধনহানি ও পীড়াদায়ী৷
বায়ব্য দিকে ঢালু থাকলে উদ্বেগ ও প্রবাসকারী৷
উত্তর দিকে ঢালু থাকলে ধনদায়ী৷
ঈশান দিকে ঢালু থাকলে বিদ্যা, ধনধান্য ও সুখদায়ী৷
মধ্যস্থানে ঢালযুক্ত জমি হয় অনিষ্টকারী৷

বিভিন্ন দিকে ভূমি উঁচু থাকার শুভাশুভ

পূর্ব দিকে ভূমি উঁচু থাকলে সন্তানহানি৷
আগ্নেয় দিকে ভূমি উঁচু থাকলে ধনলাভ৷
দক্ষিণ দিকে ভূমি উঁচু থাকলে সেই ভূমি রোগ সৃষ্টিকারী৷
নৈর্ঋত দিকে ভূমি উঁচু থাকলে সন্তানলাভ৷
বায়ব্য দিকে ভূমি উঁচু হলে ধননাশ৷
উত্তর দিকে ভূমি উঁচু হলে সেই ভূমি রোগ সৃষ্টিকারী৷
ঈশান দিকে ভূমি উঁচু হলে তা হবে ক্লেশ সৃষ্টিকারী ও অমঙ্গলকারক৷
পশ্চিম দিকে ভূমি উঁচু থাকলে তা সুখদায়ক৷

উচ্চতা ও ঢালুর ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রকারের ভূখণ্ড

আমরা যে ভূখণ্ড বাস্তুর জন্য ব্যবহার করি সেই ভূখণ্ড নানা ধরনের হয়৷ সেই ভূমির ঢালও নানা দিকে থাকে৷ ঢাল অনুসারে বিভিন্ন প্রকারের জমিকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়৷ এদের মোট ২৬ প্রকারের বিভক্ত করা হয়েছে৷ নিম্নে তারই বিশদ বর্ণনা দেওয়া হল৷ সঙ্গের চিত্রগুলিতে প্রতিটি জমির ঢাল বোঝাতে উঁচু দিকটি প্লাস (+) চিহ্নযুক্ত এবং নিচু দিকটি মাইনাস (-) চিহ্নযুক্ত নির্দেশিত হয়েছে৷ জমির দিকগুলি অধ্যায় শুরুতে নির্দেশিত দিক অনুসারে ব্যবহৃত হয়েছে৷ যেমন, উত্তর প্লাস (+) চিহ্নযুক্ত, দক্ষিণ মাইনাস (-) চিহ্নযুক্ত, পূর্ব মাইনাস (-) চিহ্নযুক্ত এবং পশ্চিম প্লাস (+) চিহ্নযুক্ত৷

১. গোবীথি : পশ্চিম দিকে উঁচু ও পূর্ব দিকে ঢালু থাকলে সেই ভূমিকে গোবীথি বলা হয়৷ এই ধরনের ভূমিতে সন্তান লাভ হয় (চিত্র-১)৷

২. জলবীথি : পূর্ব দিকে উঁচু ও পশ্চিম দিকে ঢালু হলে সেই জমি জলবীথি৷ এ ধরনের ভূমিতে সন্তানহানি হয় (চিত্র-২)৷

৩. যমবীথি : উত্তর দিকে উঁচু ও দক্ষিণ দিকে ঢালু থাকলে সেই জমিকে যমবীথি বলা হয়৷ এই ভূমি স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর (চিত্র-৩)৷

৪. গজবীথি : দক্ষিণ দিক উঁচু ও উত্তর দিকে ঢালু জমি গজবীথি৷ এই ধরনের জমি আরোগ্যকারী (চিত্র-৪)৷

৫. ভূতবীথি : ঈশান দিকে উঁচু ও নৈর্ঋত দিকে ঢালু থাকলে সেই জমিকে ভূতবীথি বলা হয়৷ এর ফল কষ্টদায়ী (চিত্র-৫)৷

৬. নাগবীথি : আগ্নেয় দিকে উঁচু ও বায়ব্য দিকে ঢালু হলে সে ভিূমি নাগবীথি৷ এই ধরনের ভূমি অর্থলাভ প্রদানকারী (চিত্র-৬)৷
৭. ধনবীথি : নৈর্ঋত দিকে উঁচু ও ঈশান দিকে ঢালু হলে সে ভূমিকে ধনবীথি বলা হয়৷ এ ধরনের জমি প্রচুর ধনদায়ী (চিত্র-৭)৷
৮. বৈশ্বানরবীথি : বায়ব্য দিকে উঁচু ও আগ্নেয় দিকে ঢালু ভূমি বৈশ্বানরবীথি৷ এ ধরনের জমি ধননাশকারী (চিত্র-৮)৷

৯. পিতামহ বাস্তু : যে ভূমি পূর্ব ও আগ্নেয় দিকের মাঝখানে সর্বাধিক উঁচু এবং পশ্চিম ও বায়ব্য দিকের মাঝখানে সর্বাধিক নিচু থাকে, তাকে পিতামহ বাস্তু বলা হয়৷ এ ধরনের জমিতে মানুষ সুখী হয়৷ (চিত্র-৯)৷
১০. সুপন্থ বাস্তু : যে ভূমি আগ্নেয় দিক ও দক্ষিণ দিকের মাঝখানে সর্বাধিক উঁচু হবে এবং উত্তর দিক ও বায়ব্য দিকের মধ্যে সব থেকে নিচু থাকবে তাকে সুপন্থ বাস্তু বলা হয়৷ এই ধরনের জমি সকল রকমের কাজের পক্ষে অনুকূল (চিত্র-১০)৷

১১. দীর্ঘায়ু বাস্তু : যদি ভূমি দক্ষিণ দিক ও নৈর্ঋত দিকের মধ্যে সব থেকে উঁচু থাকে এবং উত্তর দিক এবং ঈশান দিকের মধ্যে সব থেকে নিচু থাকে তা হলে সেই ভূমি হল দীর্ঘায়ু বাস্তু৷ এই ধরনের ভূমিতে কুল বা বংশ বৃদ্ধি হয় (চিত্র-১১)৷

১২. পুণ্যক বাস্তু : ভূমি যদি নৈর্ঋত দিক ও পশ্চিম দিকের মাঝখানে সব থেকে উঁচু হয় এবং পূর্ব দিক ও ঈশান দিকে সব থেকে নিচু হয় তাহলে তাকে পুণ্যক বাস্তু বলা হয়৷ সমস্ত রকমের শুভ ফল এই জমিতে পাওয়া যায়৷ (চিত্র-১২)৷
১৩. অপথ বাস্তু : যদি ভূমি পশ্চিম দিক ও বায়ব্য দিকের মাঝখানে সর্বাধিক উঁচু এবং পূর্ব দিক ও আগ্নেয় দিকে ঢালু হয় তা হলে এই ভূমি হবে অপথ বাস্তু৷ এই ধরনের ভূমি হল শত্রুতা ও কলহের স্থান (চিত্র-১৩)৷

১৪. রোগকৃত বাস্তু : যে ভূমি বায়ব্য দিক ও উত্তর দিকের মধ্যে সব থেকে উঁচুতে থাকে এবং আগ্নেয় দিক ও দক্ষিণ দিকের মধ্যে সবচেয়ে নীচে থাকে তা হল রোগকৃত বাস্তু৷ এই ধরনের ভূমি হল নানারকম রোগব্যাধির আস্তানা (চিত্র-১৪)৷

১৫. অর্গলা বাস্তু : ভূমি যখন উত্তর দিক ও ঈশান দিকের মধ্যে সব থেকে উঁচু থাকে এবং দক্ষিণ ও নৈর্ঋত দিকে ঢালু থাকে তখন সে জমি হবে অর্গলা বাস্তু৷ এ জমি ভয়ংকর ধরনের পাপ নষ্ট করে দেয় (চিত্র-১৫)৷
১৬. শ্মশান বাস্তু : ভূমি যদি ঈশান দিক ও পূর্ব দিকের মধ্যে সব থেকে উঁচুতে থাকে এবং নৈর্ঋত দিক ও পশ্চিম দিক সব থেকে নিচু হয় তা হলে সে জমিকে শ্মশান বাস্তু বলে৷ এই ভূমিতে কুল বা বংশ হানি ঘটে (চিত্র-১৬)৷

১৭. শ্যেনক বাস্তু : যে ভূমি নৈর্ঋত, বায়ব্য ও ঈশান দিকে সব থেকে উঁচু হবে এবং আগ্নেয় দিকে সবথেকে নিচু সেটি হল শ্যেনক বাস্তু৷ এর ফল হয় মৃত্যু (চিত্র-১৭)৷

১৮. স্বমুখ বাস্তু : যে ভূমি বায়ব্য, ঈশান ও আগ্নেয় দিকে সব থেকে উঁচু, উত্তর ও নৈর্ঋত দিকে সব থেকে নিচু, সেটি হল স্বমুখ বাস্তু৷ এই ভূমি দারিদ্র প্রদান করে (চিত্র-১৮)৷
১৯. ব্রহ্মণ বাস্তু : যখন ভূমি ঈশান, আগ্নেয় ও নৈর্ঋত দিকে উঁচু এবং বায়ব্য দিকে সব থেকে নিচু হয়, তখন সেই জমি হবে ব্রহ্মণ৷ এ জমি অশুভ ফলদায়ী (চিত্র-১৯)৷

২০. শাণ্ডুল বাস্তু : যে ভূমি ঈশান দিকে উঁচু এবং আগ্নেয়, নৈর্ঋত ও বায়ব্য দিকে নিচু, সেই ধরনের ভূমি হল শাণ্ডুল বাস্তু৷ এই বাস্তু অশুভ ফলপ্রদানকারী (চিত্র-২০)৷

২১. স্থাবর বাস্তু : যে ভূমি শুধু আগ্নেয় দিকে উঁচু এবং নৈর্ঋত, বায়ব্য ও ঈশান দিকে নিচু, তাকে স্থাবর বাস্তু বলা হয়৷ এ জমি হল শুভ ফলদানকারী (চিত্র-২১)৷
২২. স্থণ্ডিল বাস্তু : যে ভূমি শুধু নৈর্ঋত দিকে উঁচু এবং বায়ব্য, ঈশান ও আগ্নেয় এই তিন দিকে নিচু, তাকে বলা হয় স্থণ্ডিল বাস্তু৷ এও শুভ ফলদায়ী (চিত্র-২২)৷

২৩. সুস্থান বাস্তু : যে ভূমি আগ্নেয়, দক্ষিণ ও নৈর্ঋত দিকে উঁচু এবং উত্তর দিকে নিচু তা হল সুস্থান বাস্তু৷ এ রকম ভূমি ব্রাহ্মণ, বিদ্বান ও অধ্যাপকদের পক্ষে শুভ (চিত্র-২৩)৷

২৪. সুতল বাস্তু : ভূমি যদি নৈর্ঋত, পশ্চিম ও বায়ব্য দিকে উঁচু থাকে এবং পূর্ব দিকে নিচু থাকে তা হলে সেটি সুতল বাস্তু৷ এই ভূমি দেশ বা রাজ্যের পক্ষে সমৃদ্ধিশালী হয়৷ এ ধরনের ভূমি ক্ষত্রিয়, শাসক ও প্রশাসকদের পক্ষে অনুকূল (চিত্র-২৪)৷
২৫. চর বাস্তু : যে ভূমি বায়ব্য, উত্তর ও ঈশান দিকে উঁচুতে থাকলেও দক্ষিণ দিকে সবথেকে নিচু থাকে, তাকে চর বাস্তু বলা হয়৷ এ ধরনের ভূমি বৈশ্য ও ব্যবসায়ী শ্রেণির পক্ষে অনুকূল (চিত্র-২৫)৷

২৬. শ্বমুখ বাস্তু : ভূমি যখন ঈশান, পূর্ব ও আগ্নেয় দিকে উঁচু থাকে এবং পশ্চিম দিকে নিচু থাকে তখন তাকে শ্বমুখ বাস্তু বলা হয়৷ এ ধরনের জমি সমাজের নিম্ন ও দুর্বল শ্রেণির পক্ষে অনুকূল (চিত্র-২৬)৷

জমির ঢালের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি

বাস্তুশাস্ত্রে জমির ঢাল সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, জমির ঢাল যেন একই দিকে থাকে এবং তা উত্তর-পূর্ব দিকে হওয়াই বিধেয়৷ বাস্তুশাস্ত্র যে বিজ্ঞানভিত্তিক তার উত্তর মেলে জমির ঢাল উত্তর-পূর্ব দিকে রাখার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায়৷ জমির ঢাল উত্তর-পূর্ব দিকে রাখা অত্যন্ত উপকারী৷ কেননা উত্তর-পূর্ব দিকে ঢাল করলে সমস্ত জমির জল উত্তর-পূর্ব দিকে সঞ্চিত হবে৷ এই সঞ্চিত জল ধীরে ধীরে মাটির গভীরে প্রবেশ করবে৷ আর উত্তর-পূর্ব দিকে বাস্তুশাস্ত্র মতে পাতকুয়া, টিউবওয়েল, পুকুর ইত্যাদির অবস্থান নির্দেশ করেছে৷ মাটির গভীরে সঞ্চিত জল প্রবেশের কারণে জলের উৎসগুলি জলস্তর কখনওই কমবে না৷ আবার উত্তর-পূর্ব দিক থেকে আসা সূর্যরশ্মির মধ্যে যে অবলোহিত রশ্মি আছে সেই রশ্মি উত্তর-পূর্ব দিকে থাকা জল শোষণ করে৷ জল সেই শোষিত অবলোহিত রশ্মি দুপুরের পর থেকে বিকিরিত করে৷

জমির দক্ষিণ-পশ্চিম দিকটি উঁচু হওয়া উচিত৷ কেননা ওই দিক উঁচু থাকলে জল উত্তর-পূর্ব দিকে গড়িয়ে যায়৷ আবার পৃথিবী সর্বক্ষণ সাড়ে ২৩ ডিগ্রি উত্তর-পূর্ব দিকে কাত হয়ে ঘোরে৷ সেই কারণেও জমির দক্ষিণ-পশ্চিম দিক উঁচু হবে এবং উত্তর-পূর্ব দিক নিচু থাকবে৷

আয়ুর্বেদশাস্ত্রেও বলা হয়েছে যে, এমন জমিতে বাস করা স্বাস্থ্যকর যার ঢাল উত্তর ও পূর্ব দিকে আছে৷ এবং অবশ্যই পূর্ব ও উত্তর দিক উন্মুক্ত থাকবে৷

* বাস্তুবিজ্ঞান (Vastu Shastra): সুরেন্দ্র কাপুর (Surendra Kapoor), বিশিষ্ট বাস্তুবিদ।

Skip to content