মঙ্গলবার ২৫ মার্চ, ২০২৫


ছবির একটি বিশেষ দৃশ্যে।

● মুক্তির তারিখ: ২৭.০২.১৯৫৯
● প্রেক্ষাগৃহ: মিনার, বিজলী ও ছবিঘর
● পরিচালনা: যাত্রিক
● অভিনীত চরিত্র: রজত
● ছবির নায়িকা: সুচিত্রা সেন
ছবিটার বিশেষত্ব এই যে, এ ছবির রিমেক করতে এখনও পর্যন্ত কেউ সাহস পাননি। এমনই এক ম্যাজিক্যাল মোমেন্টের সংগ্রহ। যে উত্তম-সুচিত্রা নামক চুম্বকীয় আকর্ষণ, দর্শকদের বাঁধাধরা ধারণায় ছাঁচে ফেলত, এ বার তা অন্য খাতে বয়েছিল। ১৯৫৯ সালে উত্তমকুমারের চোখে মুখে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। সুচিত্রা সেনও তাই। কোনও অংশে দুজন দুজনের থেকে কম যান না। প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গায় স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘সবার উপরে’, ‘সাগরিকা’ প্রভৃতি ছবিগুলো যদি উত্তম-সুচিত্রা থেরাপির মান দিয়ে আমরা বিচার করি। সেখানে কোথায় যেন একটা নিরাপত্তা হীনতার ভাষা, দুজনের চোখে ফুটে উঠেছে। সঙ্গে সঙ্গে সুচিত্রা সেনের যে একটা অতি সচেতন থাকার বহিঃপ্রকাশ ছবির ফ্রেমে নীরবে ছড়ানো থাকতো সেটাও বোঝা যেত। কিন্তু ‘চাওয়া পাওয়া’ ছবিতে মঞ্জুর চরিত্র সুচিত্রা এমন ভাবে আঁকলেন যে একজন সুচিত্রার অতি বিরোধী বোদ্ধাকেও ভাবিয়ে তুলেছিল। ঠিক সেই কারণেই এখানে ফিল্ম নির্মাণের একটু গভীরে ডুব দেবার প্রয়োজন।
আত্মতার খোঁজে সুচিত্রা যে ১৯৫৯ সাল থেকেই উত্তমের হাত ছাড়তে শুরু করেছেন তা আর কেউ খেয়াল করেননি। ১৯৫৫ সালে সুচিত্রা সেন ছটি ছবি করেছেন, তার তিনটির নায়ক উত্তম, বাকি তিনটিতে নায়ক বিকাশ রায়। উত্তমের সঙ্গে দুটি ছবি এর মধ্যে মেগা হিট। ‘শাপমোচন’ ও ‘সবার উপরে’। আর বিকাশের সঙ্গে ছবি তিনটি ‘সাজঘর’, ‘মেজ বউ’, ‘ভালোবাসা’। তিনটিই ফ্লপ। ১৯৫৬ তে ৬টি ছবির মধ্যে উত্তম চারটি ছবিতে। এর মধ্যে আবার দুটি মেগহিট। ‘সাগরিকা’ ও ‘শিল্পী’। বাকি দুটিও মন্দ ব্যবসা করালো না। ‘একটি রাত’ ও ‘ত্রিযামা’। ছবি দুটি অবশ্য পুনর্মুক্তিতে সুপার ডুপার হিট। অন্য দুটি ছবির মধ্যে ছিল ‘শুভরাত্রি’। নায়ক ছিলেন বসন্ত চৌধুরী। ‘আমার বউ’-তে বিকাশ রায়।

১৯৫৭ তে চারটি ছবি সুচিত্রার। চারটিরই নায়ক উত্তম। আর চারটিই এবার সুপার ডুপার হিট। ‘হারানো সুর’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘পথে হল দেরি’ ও ‘জীবন তৃষ্ণা’। ৫৮-তে তিনটি ছবি সুচিত্রার। তিনটিরই নায়ক উত্তম। এবং ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে। তিনটিই সুপার ডুপার হিট। ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘ইন্দ্রাণী’ ও ‘সূর্যতোরণ’।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৮: দুর্গম গিরি কান্তার ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-২০: সঙ্কল্পজাতক

১৯৫৯ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পেল ‘চাওয়া পাওয়া’ এবং যখন সাফল্য পেল ভাবতে অবাক লাগে, টানা আটটি ছবির সাফল্য হাতের মধ্যে। মনে হওয়া স্বাভাবিক এই জুটির কাছে সাফল্য হল হাতের মুঠোয় থাকা আমলকি মাত্র। ঠিক তখনই ১৯৫৯ এ ১লা মে আরেক ছুটির দিনে মুক্তি পেল অসিত সেনের ‘দীপ জ্বেলে যাই’। নায়িকা সুচিত্রা। নায়ক উত্তম নন, ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’-র নায়ক বসন্ত চৌধুরী। এবং এ ছবি ব্যবসা করল ৪০০ শতাংশ। আর রি-সেলে এ ছবিতো সোনার খনি। ১৯৬০-এ দুটি ছবি। নায়ক অশোক কুমার। ছবির নাম ‘হসপিটাল’, চলল বারো সপ্তাহ। পরেরটি ‘স্মৃতিটুকু থাক’। নায়ক বিকাশ রায়। যিনি এর আগে সুচিত্রার সঙ্গে চারটি ফ্লপ ছবি উপহার দিয়েছেন। দুটি ছবিই ব্যবসা করল ৩০০ শতাংশ। অর্থাৎ উত্তমকে ছাড়াই এই দেড় বছরে সুচিত্রার হ্যাট্রিক হিট। সবচেয়ে বড় কথা নায়ক হিসাবে উত্তমের বিকল্পে পেলেন তিনজন নায়ককে যাদের নিয়ে তিনি পরবর্তীতে আবার হিট দেবেন। বসন্ত চৌধুরী-কে নিয়ে ‘মেঘ কালো’, বিকাশ রায়-কে নিয়ে ‘সন্ধ্যাদীপের শিখা’ আর অশোক কুমারকে নিয়ে ‘মমতা’।

ছবির একটি বিশেষ দৃশ্যে।

এরকম একটা প্রেক্ষিতকে মাথায় রেখে ‘চাওয়া-পাওয়া’ ছবিটির নির্মাণ সংক্রান্ত মূল্যায়ন সুধী সমাজকে করতে হবে।
কখনো কখনো মনে হয় সুচিত্রা ছাড়া উত্তমের যে জয়যাত্রা যেখানে উত্তম, নিজেকে ভারসেটাইল করে একের পর এক ফিল্ম প্রসব করেছেন সেখানে সুচিত্রার মনেও কোথাও একটা না পাওয়ার ব্যথা ছিল যে, উত্তমকে ছাড়া তাঁর অস্তিত্ব প্রকাশ পাবে না! যে লক্ষণ আমরা ‘সপ্তপদী’ সিনেমার প্রথম অর্ধে বেশ কয়েকটি ফ্রেমে সচেতনভাবে লক্ষ্য করব। আমার বলার উদ্দেশ্য এই যে, ‘সপ্তপদী’ সিনেমার দ্বিতীয় অর্ধে, সুচিত্রা উচ্চমানের পরিণত অভিনয়ের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। প্রথম অর্ধে চিত্রনাট্যের দাবি অনুযায়ী যেখানে দুজনের লড়াই একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার চূড়ান্ত মাত্রা স্পর্শ করছে সেখানে যেন সুচিত্রা নিজের ভেতরের মানস প্রতিমাকে বেশি করে প্রকাশ করতে অতি উদ্যোগী হয়ে পড়েছিলেন। যা তার দ্বিতীয় অর্ধে কোনওভাবেই প্রকাশিত হয়নি। তাই ‘চাওয়া পাওয়া’ সিনেমাটা একটা অদ্ভুত মানসিক টানাপোড়েন নিয়ে নির্মাণ হয়েছিল। কাহিনি ও চিত্রনাট্যকার নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় এর আগে অনেক বাঘা বাঘা চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন যেখানে বড়োলোকের মেয়ের সাথে গরীবের ছেলের অসম প্রণয়, মাখো মাখো সংলাপের নিগড়ে ধরা পড়েছে।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫০: রোজই দেখি আলাস্কা পর্বতশৃঙ্গের বাঁ দিকের চূড়া থেকে সূর্য উঠতে

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮৯: উদ্বোধনের ঠাকুরঘরে মা সারদার সঙ্গে স্বামী অরূপানন্দের কথোপকথন

সেখানে খুব ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বড়লোকিয়ানা প্রকাশ করার জন্য ক্যামেরার সামনে সেট নির্মাণের অনুঘটক থাকতো। কিন্তু প্রকৃত বড়লোকের মেয়েকে গরিবের বউ হয়ে অভিনয় করার মত মানসিক গঠন এবং সুযোগ পেলেই সুদসমেত দেমাকের প্রকাশ করে কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে আবার পুরাতন অবস্থায় ফিরিয়ে আনা ….এ অতি উচ্চ ঘরানার
বাঁধুনি ছাড়া প্রকট হয় না।

ছবির কাহিনি এরকম, রোজ রোজ মালিকের ধমক আর ভালো লাগে না। কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। পথে আলাপ মঞ্জুর সঙ্গে। আলাপ ঠিক নয়। পোশাকে বিবিয়ানি অথচ টিকিট নেই। উদ্ধার করতে বেরিয়ে গেল কিছু টাকা। তখনই আলাপ। সকালে কাগজে দেখে বোঝা গেল আসল ঘটনা। কাগজে মঞ্জুর ছবি। নিরুদ্দেশ। খুঁজে দিতে পারলে নগদ দশ হাজার টাকা। আর হাতছাড়া নেই। পাটনায় হোটেলে স্বামী-স্ত্রী হয়ে থাকা। সেখান থেকে আরও পশ্চিমে বন্ধুর বাড়ি। সেখানেও স্বামী-স্ত্রী। মনের কোণে জমে ওঠে অন্য কিছু। কিন্তু একদিন তো ছেড়ে যেতেই হবে।

এ’ই ছিল ছবির সাকুল্যে মূলধন। এরকম সুইচ অফ এবং সুইচ অন মুডে পরপর অভিনয় করার মুন্সিয়ানা তা, সুচিত্রার পক্ষেই সম্ভব। মানে এক কথায় উত্তম কুমার-তো এ ধরনের অভিনয় আগে করে নিজের জাত চিনিয়েছেন, কিন্তু ছবিটিতে প্রতিটা মুহূর্তের যে ডায়নমিক ক্যারেক্টার তা, রূপায়ণ করা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়।

ছবির একটি বিশেষ দৃশ্যে।

আমরা হলফ করে বলতে পারি সে সময়ে ভারতবর্ষে এমন কোন রূপসী নায়িকা ছিলেন না যিনি এরকম একটি কঠিন চরিত্রে রূপদান করবেন। কথাটি বলতে আরও জোর পাচ্ছি একটি কারণে যে, এই একই বছরে ‘দীপ জ্বেলে যাই’-র মতো ব্লকবাস্টার অভিনয়, সুচিত্রা সেন করে দেখিয়েছেন। আমরা যদি ‘চাওয়া-পাওয়া’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’ আর ‘সপ্তপদী’ এরকম চারটি ছবির একটি সিরিজ রচনা করি তাহলে দেখব চারটি ছবিই সুচিত্রাময়। চারটি ছবিতেই উনি যেন নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘সবার উপরে’, ‘শাপমোচন’-র সুচিত্রা কে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি এই ছবিগুলোতে। ‘চাওয়া পাওয়া’ ছবির মূল সম্পদ ছবির চিত্রনাট্য। কীভাবে ছবিটিতে ঘটনার ঘনঘটা শুধুমাত্র সংলাপের মোড়কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তার মডেল এ ছবি। কোনওরকম চটুল রসিকতা না করে, বাক্-চাতুরী না দিয়ে শুধুমাত্র নাগরিক সমাজের একটি মানসিক বিবর্তনের দলিল হয়ে থাকবে এ ছবির প্রতিটি অংশ।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯২: দুর্গা টুনটুনি

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৭: লুকাবো বলি, লুকাবো কোথায়?

এরপর বলতে হয় ছবির প্লেয়ার কাস্টিং নিয়ে। একদিকে ছবি বিশ্বাস, তুলসী চক্রবর্তী, জীবেন বোস, গঙ্গাপদ বোস- দের মতো বাঘা বাঘা পুরুষ অভিনেতা, অন্যদিকে পদ্মা দেবী এবং অন্যান্যরা ছবিটির মান উন্নয়নে যথার্থ ভূমিকা রেখেছিলেন।

পার্শ্ব চরিত্রের নির্মাণ বিনিয়োগ, একটা ছবির মূলধনকে কতটা ডিভিডেণ্ট দিতে পারে তার সাক্ষাৎ পরিচয় এ ছবির প্রতিটি ফ্রেম। শুধু উত্তম-সুচিত্রা নন, তাঁদের প্রতিটি মুহূর্তকে অলংকারিক করে তোলার দায়িত্ব এই ছবির প্রতিটি কলাকুশলী বহন করেছেন।

সে সময়ে উত্তম কুমার নামক দাপুটে নায়ককে এরকম একটা চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে দেখানো, ছবি নির্মাতাদের বেশ পরিশ্রমের ফসল বলে মনে হয়। আমাদের সহজাত ধারণা, নায়ক মানেই তিনি হবেন বাস্তবের থেকে দশ ধাপ এগিয়ে থাকা একজন অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন মনুষ্য দেহ, যাঁর জীবনে অপ্রাপ্তি বলে কিছু থাকবে না। উত্তমবাবুর এ ধরনের চরিত্রের অভাব হয়নি বিগত বছর গুলিতে। কিন্তু একেবারে দৈনন্দিন টানাপোড়েনকে মাথায় রেখে নিজের অভিনয় ক্ষমতাকে ক্যামেরার সাথে কোন অনুপাতে মেশালে চরিত্রের চ্যালেঞ্জিং মুড বজায় থাকে বা আরও বেশি করে দর্শকের সামনে ফুটিয়ে তোলা যাবে তার প্রস্তুতি ছিল এ ছবি। আমরা যারা আর কিছুদিনের মধ্যেই ‘বিচারক’, ‘সপ্তপদী’, ‘জতুগৃহ’ এবং সর্বোপরি ‘নায়ক’ দেখে উত্তমবাবুর জয়গান করবো তাদের সবচেয়ে আগে মনে রাখতে হবে উল্লিখিত সমস্ত ছবির প্রস্তুতি পর্ব ছিল ‘চাওয়া পাওয়া’ জাতীয় ছবিগুলির নির্মাণ পর্ব।

ছবির পোস্টার।

ছবিতে সবচেয়ে বড় সম্পদ ক্যামেরার প্লেসিং। আগামী দিনের প্রতিশ্রুতিমাণ তিনজন তরুণ পরিচালক হাত পাকিয়েছিলেন এ ছবির পরিচালনার মাধ্যমে। শচীন ভৌমিক, দিলীপ মুখোপাধ্যায় এবং সর্বজনশ্রদ্ধেয় তরুণ মজুমদার মহাশয়গণ; যাঁরা পরবর্তীকালে স্বপরিচালনায় বাংলা ছবির উর্বর ভূমিকে আরও শস্য-শ্যামল করে গড়ে তুলবেন ছবিটি নিয়ে এত কথা বলার উদ্দেশ্য এ ছবির ডায়ালগে এত বেশি প্রচ্ছন্ন আবেদন ছিল যে মানুষকে অনেক বেশি ভাবিয়ে তুলেছিল। একজনকে প্রেম নিবেদন করতে গেলে বা কারোর প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করতে হলে চোখের চাউনিকে কঠিন আর মুখকে ব্যক্তিত্বপূর্ণ করে রেখে দুজনের দ্বান্দিক উপস্থাপনায় পারস্পরিক আকুতিকে ফুটিয়ে তোলা যায়, তা, এ ছবির প্রতিটি সংঘর্ষময় দৃশ্যে দেখা যায়। যেখানে একটি অসম পরিস্থিতি, নায়ক এবং নায়িকাকে ভাবিয়ে তুলেছিল।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৫: বনবাসে অর্জুনের অসংযত জীবন, আশ্রয়দাতার বিশ্বাসভঙ্গ কি অনুসরণযোগ্য আচরণ?

চালচুলোহীন নায়ককে মনে জায়গা দেওয়া যায় কিনা একজন ধনীর দুলালী কীভাবে সে অংশকে নিজের মধ্যে বীজ আকারে গড়ে তুলে প্রতিষ্ঠার মহীরুহে পরিণত করবেন ..তা দেখার জন্য চাওয়া পাওয়া ছবিটি আবার একবার সকলের দেখা উচিত।

বাস্তবে উত্তমবাবু এবং সুচিত্রা সেন দুজনেই চরম টানাপোড়েন নিয়ে বাস করতেন তাঁদের পারিবারিক জীবনে। একজন অভিজাত রমণীর দাপট, কোন মানের হতে পারে তা, সুচিত্রা সেন-কে হাতে ধরে পরিচালক-কে শেখাতে হয়নি। ছবি দেখতে দেখতে মনে হয়েছে তাঁর ব্যক্তিজীবনের অভিব্যক্তিগুলো খুব সহজে উনি ক্যামেরার সামনে জাস্ট বিহেভ করেছেন। অনুরপ উক্তি প্রযোজ্য, উত্তমবাবুর ক্ষেত্রেও। তিনিও নিজের ব্যক্তিজীবনের উত্থান পতন কিভাবে হজম করতেন তা যেন চোখ মুখ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন।

এরপর আসব এ ছবির অন্যতম সম্পদ গান নিয়ে। যে সময় উত্তম কুমার মানেই হেমন্ত মুখার্জী, সুচিত্রা সেন মানেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। পরিচালক, প্রযোজক মায় সংগীত পরিচালকগণ এর বাইরে হাঁটেননি। কিন্তু ছবির নির্মাতারা উত্তম সুচিত্রার ছবি মানেই রবীন চট্টোপাধ্যায় বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সংগীত পরিচালনা থেকে একটু স্বাদ বদল করেছিলেন। যে সময় হাতে নাতে গরম গরম সাফল্য ছিল ‘ইন্দ্রাণী’ ছবির গান। এ ছবিতে অবশ্য গান অতটা কলকে পায়নি। কিন্তু একটি গানের দৃশ্য যা, নির্মাণ না করলে ছবিটির আকস্মিক প্রয়াণ ঘটত তার, নির্মাণে কোন কার্পণ্য ছিল না। একটা গোটা গানকে দুজনে আধা আধা করে গেয়েছেন আর সে গানের রূপায়ণে উভয়ের বিনিময়, সারস্বত সমাজের সম্পদ হয়ে আছে।

ছবির তালিকা।

নাগরিক জীবনের মানসিক দ্বন্দ্ব কোন পর্যায়ে যেতে পারে উত্তম কুমারের চলন-বলন, চিরকালের জন্য সকলের কাছে একটা মডেল করে দিয়েছেন এই গানের দৃশ্য। অনুরূপভাবে সুচিত্রা সেন গলায় মালা পরে যখন তাঁর আন্তরিক আকুতিকে একবার চাপা দিচ্ছেন একবার প্রকাশ করছেন, এরকম একটা সেলুলয়েডি লুকোচুরি খেলা চিত্রমোদীদের চরম আনন্দের সাক্ষী হবে—এ কথা বলাই বাহুল্য।

রতিকে কোন পর্যায়ে নিয়ে গেলে তা আর আরতিতে রূপান্তরিত হতে পারে ,শেষ দৃশ্যের নির্মাণ, তা যেন আরও বেশি করে প্রমাণ দাখিল করল। যে সময় অর্থের প্রলোভনকে জয় করে একটি দরিদ্র ছেলে তার অন্তরের ধর্ম দিয়ে উল্টো দিকের প্রেয়সীকে বরণ করছেন সে সময়ে ধনতান্ত্রিক ও সামন্ততান্ত্রিক সমস্ত বাঁধনকে ভেঙেচুরে তার প্রিয়তমর কাছে ফিরে আসার যে নিবেদন তা, বোধ হয় সুচিত্রা সেন ছাড়া অসম্ভব ছিল। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি উত্তম সুচিত্রা তর্পণ করা এ প্রতিবেদকের উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য, ভারতবর্ষের চিরকালীন মিলন মন্ত্র যা রবীন্দ্রনাথ ‘প্রাচীন সাহিত্য’-এ বলেছেন ‘অন্নপূর্ণার সাথে বৈরাগীর যে মিলন সে মিলনে প্রকৃত মিলন’ নৃপেন্দ্রবাবু চিত্রনাট্য লেখার আগে মনের অবচেতনে কোনভাবে এই রাগকেই আলাপের তানে বিস্তার করেছেন বলে মনে হয়। আর উত্তম- সুচিত্রা তাঁদের দুচোখ দিয়ে বিশ্বকবির আদর্শকে সকলের সামনে তুলে ধরেছেন। —চলবে।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar–Mahanayak–Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content