শুক্রবার ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


উত্তম ও সুমিত্রা।

● মুক্তির তারিখ: ১৪.১১.১৯৫৮
● প্রেক্ষাগৃহ: দর্পণা, ইন্দিরা ও প্রাচী
● পরিচালনা: জীবন গঙ্গোপাধ্যায়
● অভিনীত চরিত্র: বীরেন
● ছবির নায়িকা: সুমিত্রা দেবী
সাহেব বিবি গোলামের পর আমার সুমিত্রা দেবীর সাথে চিত্রায়ন। এ ছবির দুটি অংশ ভীষণভাবে আলোচনায় মন টানে। প্রথমত: উত্তম সুচিত্রার মারকাটারি যুগে সুমিত্রা দেবীর সঙ্গে এ ধরনের একটি ছবি নির্মাণের সাহস দেখান; কারণ সাধারণত চিরাচরিত রাস্তা থেকে একেবারে অন্যরকম গল্প নিয়ে যৌতুক ছবির প্লট নির্মিত হয়েছিল।

দ্বিতীয়ত: সালতামামিতে একজন অভিনেতার ক্যারিয়ার গ্রাফ কোন মানের থাকলে পরপর একই মাসে একের পর এক ছবি রিলিজ করা যায় এবং কলকাতার নামী হলগুলোর চেনে সেগুলো রিলিজ করানোর ব্যাবস্থা হয়।
আমরা জানি সে সময়ে রূপবাণী, অরুণা ভারতী, উত্তরা, পূরবী, উজ্জ্বলা, শ্রী, প্রাচী, পূর্ণ এবং মিনার, বিজলী, ছবিঘর এ ধরনের চারটি রিলিজিং চেন সারা কলকাতা জুড়ে বিস্তৃত ছিল। একসময়ে উত্তম কুমার নামক একজন তারকার আবির্ভাব হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেটের ঝোড়ো ব্যাটিং এর মত প্রতি ১৫ দিন অন্তর একটি করে ছবি মুক্তির ঘটনা। এ সমস্ত রিলিজিং চেন হলগুলির কাটাকুটি খেলা বাড়িয়ে দিয়েছিল। সারা কলকাতায় তখন দর্পণা, ইন্দিরা, এলিট প্রভৃতি সিনেমা হলগুলিও ছবি রিলিজের ব্যাপারে এদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছিল।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৫: ইন্দ্রধনু আর ‘ইন্দ্রাণী’

ওই ডাকছে বই

আমার এত কথা বলার উদ্দেশ্য হল, সারা ভারতে হিন্দি ছবিতে একমাত্র রাজেশ খান্না ছাড়া এ ধরনের ছবি রিলিজ এবং সাকসেসের ইতিহাস আর কারও নেই। তাও রাজেশ খান্নার জীবনে এ ধরনের ফেস গেছে দুই থেকে তিন বছর। কিন্তু উত্তমবাবু একটানা ২০ বছর এরকম মারকাটারি ফর্মে ছবির জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন যার প্রথম দিকের বেশিরভাগ ছবির কান্ডারী ছিলেন সুচিত্রা সেন নামক আরেক অংশীদার।

যৌতুক ছবির পোস্টার।

এবার আসি ছবিতে কাহিনীর ঘনঘটা প্রসঙ্গে। একেবারেই সাধারণ একটি কাহিনি উপেন গঙ্গোপাধ্যায় নামক একজন লেখকের থেকে পাওয়া চিত্রনাট্যে রূপায়ণ করেছিলেন বিমল মিত্র। সুর সংযোজনা করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কাহিনির সঙ্গে, সুরের সঙ্গে মেলবন্ধন করে গীত রচনা করেছিলেন সর্বকালের সেরা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার।

ছবিটির প্রিন্ট অনেক আগে দেখা যেত এখন আর সে মানে দেখা যায় না কারণ উত্তম কুমার নামক কালজয়ী অভিনেতার অভিনয়কে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা আমাদের মতো বিশৃঙ্খল দেশে বা রাজ্যে না থাকাই স্বাভাবিক।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০২: অন্ধকারে কে?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১১: মৃণালিনীর মৃত্যুর পর বিবাহ-প্রস্তাবের মুখোমুখি রবীন্দ্রনাথ

ছবিটির আলোচনা প্রসঙ্গে প্রথমেই বলতে হয় সুমিত্রা দেবীর ছক ভাঙ্গা অভিনয়ের পরাকাষ্ঠা। উনি এলোপাথাড়ি কোনও ছবি করেননি। “সাহেব বিবি গোলাম”-এ ক্যামেরার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময়, একটা গোটা ছবির অভিমুখকে নিজের দিকে করে নিয়েছিলেন উনি। যে সময়ে উনি হিট ছবির পরপর নায়িকা হওয়ার এলেম রেখেছেন সেসময় বাংলা ছবি তে পঞ্চকন্যার আবির্ভাব ঘটে গিয়েছে। শুরুর থেকে উনি যে গভীর অভিনয়ের মান দিয়ে নিজের যাত্রাপথকে মসৃণ করেছিলেন পঞ্চাশের দশকের প্রথম অর্ধে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে আগত পাঁচ জন কালজয়ী অভিনেত্রীর গুণসম্পন্ন নায়িকার আবির্ভাবে সে ব্যবস্থা অনেকটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

মহানায়ক।

এ পাঁচ জন আমার আপনার সবারই চেনা। রেঙ্গুন ছেড়ে আসা সুপ্রিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়। আদতে তাঁরা ফরিদপুরের লোক। বরিশালের অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়। পাবনার রমা দাশগুপ্ত ওরফে সুচিত্রা সেন। কুমিল্লার সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। আর ফরিদপুরিয়া কাবেরী বসু। যাকে বলে পুরো ইস্টবেঙ্গল টিম। এ হেন পরিস্থিতিতে সুমিত্রা দেবীর এরকম ছক ভাঙ্গা নায়িকা চরিত্রে অভিনয়, বাঙালি জাতিকে ভাবিয়ে তুলেছিল বটে। তবে সবচেয়ে মনে রাখার মতো অংশ হল, কি অসাধারণ দক্ষতায় উত্তম কুমার নামক একজন চারা গাছ থেকে মহীরূহ হতে যাওয়া পথিক এ ছবিতে রূপদান করেছেন।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৭: সুন্দরবনের পাখি — ফিঙে

আকাশ এখনও মেঘলা/৪

ক্যামেরাম্যান দীনেন গুপ্ত তাঁর স্মৃতি কথা বারবার উল্লেখ করেছেন এ ছবিতে উত্তম কুমারের ক্যামেরার সঙ্গে সারস্বত সম্পর্কের বিনিময়। যেকোন কারণে উত্তমবাবু ক্যামেরাটা একটু বেশি বুঝতেন। দর্শকরা হলে বসে তার নায়ককে বা নায়িকাকে কীভাবে দেখতে পেলে মনের অবচেতনে ভালো লাগার রিদম্ অনেকটা সময় বয়ে বেড়াতে পারবেন, যার মূল্য হিসাবে দর্শক হলমুখী হবেন, প্রযোজক পরিবেশক প্রভৃতির ঘরে বাণিজ্যিক সাফল্য প্রবেশ করবে—এই এত কিছুর মেলবন্ধন কি একা হাতে নির্ণয় করতেন উত্তমবাবুর মতো ক্ষণজন্মা একজন স্ক্রিন রিপ্রেজেন্টেটর।

সুমিত্রা দেবী।

স্ক্রিনে চিত্রনাট্য, শিল্প নির্দেশনা প্রভৃতি হাজারো অসুবিধা থাকলেও উত্তমবাবুর উপস্থাপন ভঙ্গিতে তা মুহূর্তেই যেন প্রাণ পেত। দেবী সরস্বতীর এমন এক আশীর্বাদ উনার উপর বিরাজ করতো যে প্রতিটা মুহূর্তকে ফ্রেমবন্দি করার একটা দুর্লভ সাহস উনি দেখাতে পারতেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০১: অর্জুন প্রমাণ করলেন, রাজধর্ম পালনের ক্ষেত্রে মিথ্যাচারের কোনও স্থান নেই

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১৪: ‘…জীবন খুঁজে পাবি ছুটে ছুটে আয়’, লরেন্স ও ফ্রিডা/২

সুমিত্রা দেবী কখনওই সুচিত্রা সেন, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের ধাঁচে অভিনয় করবেন না, এ সারকথা সবার আগে বুঝেছিলেন উত্তম কুমার। কাজেই ওঁর সঙ্গে চোখের বিনিময় যা সুচিত্রা সেনের ছবিতে বাধ্যতামূলক ভাবে থাকে সেটা এ ছবিতে নেই। এ ছবি নির্মাণের প্রতিটা পর্বে কাহিনির অদৃশ্য চাবুক ছবিটির পাত্র-পাত্রীকে একটি নির্দিষ্ট দিকে পরিচালনা করেছে।
সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নামক কালজয়ী সংগীত পরিচালকের সুরের মাধুর্য ছবিটির প্রসাদ গুনকে অনেক অংশে বাড়িয়ে তুলেছে। ছবি দেখতে বসে কখনও মনে হয়নি উত্তম কুমার কাছের লোক নন আর সুমিত্রা দেবী, সুচিত্রা সেন নন অর্থাৎ যে কোনও নায়িকাকে নিজের মতো ভঙ্গিতে পরিচালনা করার মতো একটা জহুরী চোখ ছবির পরিচালকের থেকেও উত্তম কুমারের বেশি ছিল।

সে দিক দিয়েই এ ছবির পূর্ণাঙ্গ সার্থকতা যা পরবর্তীতে বয়ে গিয়েছিল।—চলবে।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar–Mahanayak–Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content