শিকার ছবির পোস্টার।
● মুক্তির তারিখ: ২৫.০৯.১৯৫৮
● প্রেক্ষাগৃহ: এলিট, উত্তরা, পূরবী ও উজ্জ্বলা
● পরিচালনা: মঙ্গল চক্রবর্তী
উত্তম কুমারের অত্যন্ত আলোচিত এবং দুষ্প্রাপ্য ছবি ‘শিকার”। কারণ, ছবিটির প্রিন্ট আর পাওয়া যায় না আর বর্তমান প্রজন্মের কাছে এরকম অদেখা ছবির আকর্ষণ খুব বেশি নেইও। কিন্তু সালতামামির নিরিখে ১৯৫৮ সালে উত্তমবাবু যেসব ছবি করেছেন তার মধ্যে এই ছবিটির গুরুত্ব অনেক অংশে প্রধান। গেভাকালারে তৈরি রঙিন ছবি। তখন উত্তম কুমার মানেই হিট আর হিট মানেই উত্তম কুমার।
এই বছরে উত্তম কুমারের মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা ৮ এবং অধিকাংশ ছবিতেই উত্তম-সুচিত্রা ম্যাজিক। অর্থাৎ সেই সোনাঝরা দিনগুলিতে অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এ ধরনের একটি সিরিয়াস ছবি যথেষ্ট সাড়া ফেলে দিয়েছিল। অন্যরকমভাবে মনে রাখতে হবে, বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সূত্রপাত হয়েছিল সময়ের হাত ধরে সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রত্যেকটি স্তরেই স্বর্ণাক্ষরে উত্তম কুমারের নাম লেখা আছে।
এই বছরে উত্তম কুমারের মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা ৮ এবং অধিকাংশ ছবিতেই উত্তম-সুচিত্রা ম্যাজিক। অর্থাৎ সেই সোনাঝরা দিনগুলিতে অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এ ধরনের একটি সিরিয়াস ছবি যথেষ্ট সাড়া ফেলে দিয়েছিল। অন্যরকমভাবে মনে রাখতে হবে, বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সূত্রপাত হয়েছিল সময়ের হাত ধরে সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রত্যেকটি স্তরেই স্বর্ণাক্ষরে উত্তম কুমারের নাম লেখা আছে।
আসলে আমরা উত্তম-সুচিত্রার রোম্যান্টিসিজম নামক একটা বিশেষ থেরাপিকে মনের মাঝে এমন একটা স্থান দিয়েছি যেখানে, সিরিয়াস অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অন্যান্য অনেকগুলো সিনেমা ফিকে হয়ে গিয়েছে। মানুষ সিনেমা হলে যেত তার মনের ক্লান্তি মেটানোর জন্য। সেখানে যে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মাধ্যমে এ ভাব বেশি করে ফুটে উঠত মানুষ সেদিকেই বেশি আকৃষ্ট হতো। এবং এই কথাকে অবলম্বন করে আমরা দেখতে পাই। যে শুধু উত্তম-সুচিত্রা নয় পরবর্তীকালে ‘দেয়া নেয়া’, ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ এইসব ছবিতে যখন তনুজাকে নিয়ে অভিনয় করানো হচ্ছে তখনও কিন্তু উত্তম ম্যাজিক, সেই রোম্যান্টিসিজমের কথাই বলেছেন। সমস্ত ছবি তৈরির প্রধান উপাদান গুলো হতো মানুষের মাঝে, মানুষের সাথে কীভাবে যোগাযোগের বিনিময়টা তৈরি করা হবে তা ভিত্তি করে। যোগাযোগ ব্যবস্থা এমন একটা জিনিস যে সেটার উপরই নির্ভর করে সমস্ত কিছু।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৯: কী ছিল চিঠিতে, উত্তর লিখতে গিয়ে উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের হাত কেঁপেছিল
আজ আমরা উত্তম তিরোধানের পর তার যে কোনও সেলুলয়েডি উপস্থাপনকে কেন্দ্র করে যেমন স্মৃতি-তর্পণে বা প্রশস্তিবাক্যে মেতে উঠি সে সময়ের বিষয় গুলো মোটেই সেরকম ছিল না। গোটা ৫৮ সালে মাত্র আটটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল। উত্তম কুমারের ছবি, মাত্র কথাটি বলছি এই কারণে যে উত্তম কুমার ছাড়াও প্রায় চল্লিশটা বাংলা ছবি সে বছর মুক্তি পেয়েছিল এবং সেই কাজটা যথেষ্ট যুক্তি দিয়ে ভাবার একটা অবকাশ আছে। কারণ, বাংলার দর্শক শুধু উত্তম কুমারে কেন্দ্রীভূত ছিলেন না। সে বছর মুক্তি পাওয়া উত্তম ব্যতিরিক্ত যেসব চলচ্চিত্র, সেগুলো হয়তো বাজারে চলেছে কম, উত্তম কুমারের হয়তো পরিমাণ বেশি চলেছে। এরপর উত্তমবাবুর ছাড়া হিন্দি চলচ্চিত্র যা সারা ভারতব্যাপী চলে সে বছরের মুক্তি প্রাপ্ত হিন্দি চলচ্চিত্র কিন্তু দর্শক দেখেছে। অর্থাৎ দর্শকের মনে শুধু উত্তম কুমার নয়।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৫: সুন্দরবনের পাখি — মাছরাঙা
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৮: প্রতিভা দেবী—ঠাকুরবাড়ির সরস্বতী
উত্তম ছাড়া অন্য হিরোদের ছবি তারও বড় বৃত্তে ভারতীয় ছবির মধ্যে হিন্দি ছবি। এছাড়াও যারা এলিট ক্লাস তারা হলিউডের মুভিও দেখতেন। সুতরাং বাংলায় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের যে কয়টি ধারা বাণিজ্যিকভাবে প্রচলিত ছিল উত্তম কুমার তাদের মধ্যে একজন অংশীদার ছিলেন। আমাদের মনে রাখতে হবে এই চার পাঁচটা সরণীর একটিমাত্র অংশের মালিকানা ভুক্ত একজন অভিনেতাকে, কালজয়ী হতে গেলে কত রকমের প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করতে হয়। কারণ, একটা ছবি প্রদর্শন চালু হওয়ার পর দর্শক মনে স্থায়ী জায়গা পাওয়া নিশ্চয়ই ছবিটা নির্মাণ পর্বে তৈরি হয়ে যায় না।
কিন্তু একজন অভিনেতা তার নিজের ক্রিয়াকর্ম যদি ঠিকঠাক করে রাখতে পারেন তাহলে তার ফলাফল কিন্তু সুদূর প্রসারী হতে বাধ্য, যেটা উত্তমবাবুর ক্ষেত্রে হয়েছে। এযাবৎ প্রেক্ষিত আলোচনার পর আমরা প্রবেশ করব ‘শিকার’ ছবির অভ্যন্তরে। ছবিটির কাহিনি অত্যন্ত সংবেদনশীল। একজন সখের শিকারীর জীবনের ওঠাপড়া আলোচিত হয়েছে এই ছবিতে।
কিন্তু একজন অভিনেতা তার নিজের ক্রিয়াকর্ম যদি ঠিকঠাক করে রাখতে পারেন তাহলে তার ফলাফল কিন্তু সুদূর প্রসারী হতে বাধ্য, যেটা উত্তমবাবুর ক্ষেত্রে হয়েছে। এযাবৎ প্রেক্ষিত আলোচনার পর আমরা প্রবেশ করব ‘শিকার’ ছবির অভ্যন্তরে। ছবিটির কাহিনি অত্যন্ত সংবেদনশীল। একজন সখের শিকারীর জীবনের ওঠাপড়া আলোচিত হয়েছে এই ছবিতে।
অরুন্ধতী দেবী।
আসলে উত্তম কুমার নামক অবয়ব, গতানুগতিক যে চরিত্র চিত্রায়নে মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রত্যাশিত ছিলেন এ চরিত্রটি সেদিক দিয়ে একটু সিরিয়াস ধরনের। মানুষকে প্রেক্ষাগৃহে ঢোকার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের পছন্দের পাশের বাড়ির ছেলের যে ইমেজ মানসিকভাবে তারা মেলানোর জন্য আসতেন সেটা অনেক অংশেই ধাক্কা খেয়েছিল এই ছবির আঙ্গিক নির্মাণে। পরিচালক মঙ্গল চক্রবর্তী চিরকালই উত্তম কুমারকে চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে ভাবতে ভালোবেসেছেন তাঁর ‘সোনার হরিণ’ এবং শেষের দিকে ‘আমি সে ও সখা’ সাধারণ গড়পড়তা মানুষের জীবনবেদ নিয়ে সেলুলয়েডে সাজাননি। মানুষের ভিতর ঘুমিয়ে থাকা অপরিচিত সত্তার সঙ্গে দর্শক শ্রোতাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মানুষ হিসাবে তিনি আশ্রয় করেছিলেন। উত্তম কুমার নামক বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন অভিনেতাকে।
আরও পড়ুন:
প্রজাতন্ত্র
মাই নেম ইজ গওহর জান—ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে অঘোষিত বিপ্লব এনেছিলেন এই শিল্পী
হিন্দি ফিল্মের ইতিহাসে অমিতাভ বচ্চন যখন গতানুগতিক সিনেমা লাগাতার করে গিয়েছেন তার প্রস্তুতি পর্বে বহু মনে রাখার মতো অভিনয় সমৃদ্ধ ছবি তিনি করেছেন। পরিচালকরা করিয়েছেন। সেগুলোর প্রেক্ষিত মনে রাখলে ‘শিকার’ ছবির নির্মাণ অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
ছবিটার প্রথম চমক ছিল রঙিন ছবি। উত্তমকুমারকে মায় গুরুকে রঙিন পর্দায় দেখব এরকম একটা আকর্ষণ দর্শকরা এক লহমায় লুফে নিয়েছিল। তারপর ‘শিকার’ ছবির কাহিনি এবং উত্তমের অভিনয় সমৃদ্ধি। মানুষ তার অবচেতন মন দিয়ে সেটাকেই মনে রাখেন যেটা তার কাছে অপরিচিত। রঙিন উত্তম কুমার কেমন কেমন লাগছে পর্দার বুকে সেই পঞ্চাশের দশকের সেই সময় দর্শকদের বুকে হাইপ তুলে দেওয়া অভিনেতা এক ম্যাজিকেই দর্শকদের হলমুখী করেছিলেন। অধিকাংশ সে সময়ের দর্শকরা স্মৃতি তর্পণ করতে বলে ফেলেন, সে এক মনে রাখার মত ছবি। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলবো! যেমন উত্তম কুমারকে দেখতে, তেমন তাঁর অভিনয় প্রতিভায় ক্যামেরার সঙ্গে বন্ধুত্বে দর্শকদের একটা ভালো ছবি উপহার দেওয়া।
ছবিটার প্রথম চমক ছিল রঙিন ছবি। উত্তমকুমারকে মায় গুরুকে রঙিন পর্দায় দেখব এরকম একটা আকর্ষণ দর্শকরা এক লহমায় লুফে নিয়েছিল। তারপর ‘শিকার’ ছবির কাহিনি এবং উত্তমের অভিনয় সমৃদ্ধি। মানুষ তার অবচেতন মন দিয়ে সেটাকেই মনে রাখেন যেটা তার কাছে অপরিচিত। রঙিন উত্তম কুমার কেমন কেমন লাগছে পর্দার বুকে সেই পঞ্চাশের দশকের সেই সময় দর্শকদের বুকে হাইপ তুলে দেওয়া অভিনেতা এক ম্যাজিকেই দর্শকদের হলমুখী করেছিলেন। অধিকাংশ সে সময়ের দর্শকরা স্মৃতি তর্পণ করতে বলে ফেলেন, সে এক মনে রাখার মত ছবি। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলবো! যেমন উত্তম কুমারকে দেখতে, তেমন তাঁর অভিনয় প্রতিভায় ক্যামেরার সঙ্গে বন্ধুত্বে দর্শকদের একটা ভালো ছবি উপহার দেওয়া।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৯: আলোকলতা তিলোত্তমারা যুগে যুগে পুরুষের উজ্জীবনী শক্তির আধার
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০০: চোর মাচায়ে শোর
ছবিটিতে সহশিল্পীদের ভূমিকা যাঁরা অভিনয় করেছিলেন। তাদের মধ্যে নির্মলকুমার, অসিতবরণ, দীপক মুখোপাধ্যায়, অমর মল্লিক সমস্ত বাঘা বাঘা অভিনেতারা এই অংশে উপস্থিত হয়েছিলেন। মহিলাদের মধ্যে ভারতী দেবী, কমলা মুখোপাধ্যায় প্রভৃতিরাও ছবিটির গতিকে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অনবদ্য সংগীত পরিচালনা এবং গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের লেখা গান মানুষের মুখে মুখে ফিরেছিল। সব মিলিয়ে একটি নতুন উপস্থাপনা ১৯৫৮ সালকে উত্তম কুমারের ফিল্ম ক্যারিয়ারে সমৃদ্ধ করে দিয়েছিল।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অনবদ্য সংগীত পরিচালনা এবং গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের লেখা গান মানুষের মুখে মুখে ফিরেছিল। সব মিলিয়ে একটি নতুন উপস্থাপনা ১৯৫৮ সালকে উত্তম কুমারের ফিল্ম ক্যারিয়ারে সমৃদ্ধ করে দিয়েছিল।
ছবির তালিকা।
এ ভাবে আমরা দেখব যে একজন পরিচালক শুধু রোম্যান্টিক অভিনয় ছাড়াও সিরিয়াস রোলে উত্তম বাবুকে যেভাবে ব্যবহার করেছেন তা কালের বিচারে উত্তীর্ণ এবং আগামী দিনে সোনালি ভবিষ্যতের দ্যোতক।
ছবিটির দুর্বলতা দুটি অংশে দেখতে পাই একটি নায়ক নায়িকার যখন মুখোমুখি দ্বৈরথ উপস্থিত হচ্ছে তখন সেখানে মানবিক আবেদন অপেক্ষা। যান্ত্রিক নৈপুণ্য দেখানোর একটা অসম প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। অর্থাৎ দর্শকরা ছবিটির অন্তর্নিহিত ভাব নিয়ে যেভাবে নিমজ্জিত হচ্ছে আর প্রতিটি অংশ বিঘ্নিত হচ্ছে ছবিটির টেকনিক্যাল অংশকে নির্মেদ রাখতে পরিচালকের অতি সচেতনতা।
তবুও এ ছবি সুপারহিট হয়েছিল। —চলবে।
ছবিটির দুর্বলতা দুটি অংশে দেখতে পাই একটি নায়ক নায়িকার যখন মুখোমুখি দ্বৈরথ উপস্থিত হচ্ছে তখন সেখানে মানবিক আবেদন অপেক্ষা। যান্ত্রিক নৈপুণ্য দেখানোর একটা অসম প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। অর্থাৎ দর্শকরা ছবিটির অন্তর্নিহিত ভাব নিয়ে যেভাবে নিমজ্জিত হচ্ছে আর প্রতিটি অংশ বিঘ্নিত হচ্ছে ছবিটির টেকনিক্যাল অংশকে নির্মেদ রাখতে পরিচালকের অতি সচেতনতা।
তবুও এ ছবি সুপারহিট হয়েছিল। —চলবে।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar–Mahanayak–Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।