উত্তম কুমার।
উত্তম কুমারের অত্যন্ত অনালোচিত এবং দুষ্প্রাপ্য ছবি ‘ডাক্তারবাবু’। কারণ ছবিটির প্রিন্ট আর পাওয়া যায় না। আর নতুন প্রজন্মের কাছে এরকম অদেখা ছবির আকর্ষণ খুব বেশি নেই। কিন্তু সালতামামির নিরিখে ১৯৫৮ সালে উত্তমবাবু যে সব ছবি করেছেন তার মধ্যে এই ছবিটির গুরুত্ব অনেক অংশে দেখা যায়।
এই বছরে উত্তম কুমারের মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা ৮ এবং অধিকাংশ ছবিতেই উত্তম সুচিত্রা ম্যাজিক। অর্থাৎ সেই সোনাঝরা দিনগুলিতে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে এ ধরনের একটি সিরিয়াস ছবি যথেষ্ট সাড়া ফেলে দিয়েছিল। অন্যরকম ভাবে মনে রাখতে হবে, বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সূত্রপাত হয়েছিল সময়ের হাত ধরে সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রত্যেকটি স্তরেই স্বর্ণাক্ষরে উত্তম কুমারের নাম লেখা আছে।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬২: ধনময়ী জ্ঞানময়ী-র পাশে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৬: সুন্দরবনের লৌকিক চিকিৎসায় ম্যানগ্রোভ—হরগোজা ও কেয়া
আসলে আমরা উত্তম সুচিত্রার রোম্যান্টিসিজম নামক একটা বিশেষ থেরাপিকে মনের মাঝে এমন একটা স্থান দিয়েছে যেখানে, সিরিয়াস অভিনেতা অভিনেত্রীদের অন্যান্য অনেকগুলো সিনেমা ফিকে হয়ে গিয়েছে। মানুষ সিনেমা হলে যেত তার মনের গ্লানি ক্লান্তি মেটানোর জন্য। সেখানে যে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মাধ্যমে এ ভাব বেশি করে ফুটে উঠত মানুষ সেদিকেই বেশি আকৃষ্ট হতো। এবং এই কথাকে অবলম্বন করে আমরা দেখতে পাই। যে শুধু উত্তম সুচিত্রা নয় পরবর্তীকালে ‘দেয়া নেয়া’, ‘এন্টনি ফিরিঙ্গি’ এইসব ছবিতে যখন তনুজাকে নিয়ে অভিনয় করা হচ্ছে তখনও কিন্তু উত্তম ম্যাজিক, সেই রোম্যান্টিসিজমের কথাই বলেছেন।
সমস্ত ছবি তৈরির প্রধান উপাদানগুলো হতো মানুষের মাঝে, মানুষের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগের বিনিময়টা তৈরি করা হবে তা ভিত্তি করে। যোগাযোগ ব্যবস্থা এমন একটা জিনিস যে সেটার উপরই নির্ভর করে সমস্তকিছু। আজ আমরা উত্তম তিরোধানের পর তার যে কোনও সেলুলয়েডই উপস্থাপনকে কেন্দ্র করে যেমন স্মৃতি তর্পণে বা প্রশস্তি বাক্যে মেতে উঠি সে সময়ের পথগুলো কিন্তু সে রকম ছিল না। গোটা ৫৮ সালে মাত্র আটটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল।
উত্তম কুমারের মাত্র কথাটি বলছি এই কারণে যে উত্তম কুমার ছাড়াও প্রায় চল্লিশটা বাংলা ছবি সে বছর মুক্তি পেয়েছিল এবং সেই কাজটা যথেষ্ট যুক্তি দিয়ে ভাবার একটা অবকাশ আছে। কারণ বাংলার দর্শক শুধুমাত্র উত্তম কুমারে কেন্দ্রীভূত ছিলেন না। সে বছর মুক্তি পাওয়া উত্তম ব্যতিরিক্ত যেসব চলচ্চিত্র, সেগুলো হয়তো বাজারে চলেছে কম, উত্তম কুমারের হয়তো পরিমাণ বেশি চলেছে। এরপর উত্তমবাবুর ছাড়া হিন্দি চলচ্চিত্র যা সারা ভারতবর্ষব্যাপী চলে সে বছরের মুক্তি প্রাপ্ত হিন্দি চলচ্চিত্র কিন্তু দর্শক দেখেছে। অর্থাৎ দর্শকের মনে শুধু উত্তম কুমার নয়।
উত্তম কুমারের মাত্র কথাটি বলছি এই কারণে যে উত্তম কুমার ছাড়াও প্রায় চল্লিশটা বাংলা ছবি সে বছর মুক্তি পেয়েছিল এবং সেই কাজটা যথেষ্ট যুক্তি দিয়ে ভাবার একটা অবকাশ আছে। কারণ বাংলার দর্শক শুধুমাত্র উত্তম কুমারে কেন্দ্রীভূত ছিলেন না। সে বছর মুক্তি পাওয়া উত্তম ব্যতিরিক্ত যেসব চলচ্চিত্র, সেগুলো হয়তো বাজারে চলেছে কম, উত্তম কুমারের হয়তো পরিমাণ বেশি চলেছে। এরপর উত্তমবাবুর ছাড়া হিন্দি চলচ্চিত্র যা সারা ভারতবর্ষব্যাপী চলে সে বছরের মুক্তি প্রাপ্ত হিন্দি চলচ্চিত্র কিন্তু দর্শক দেখেছে। অর্থাৎ দর্শকের মনে শুধু উত্তম কুমার নয়।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৬: যন্ত্রণাদগ্ধ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রাঁচিতে পেয়েছিলেন সান্ত্বনার প্রলেপ
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬০: আধুনিক ভারতীয় রাজনীতির চালচিত্রে কি দশরথ ও কৈকেয়ীর ছায়া?
উত্তম ছাড়া অন্য হিরোদের ছবি তারও বড় বৃত্তে ভারতীয় ছবির মধ্যে হিন্দি ছবি। এছাড়াও যারা এলিট ক্লাস তারা হলিউডের মুভিও দেখতেন। সুতরাং বাংলায় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের যে কয়টি ধারা বাণিজ্যিকভাবে প্রচলিত ছিল উত্তম কুমার তাদের মধ্যে একজন অংশীদার ছিলেন। আমাদের মনে রাখতে হবে এই চার পাঁচটা সরণীর একটিমাত্র অংশের মালিকানা ভুক্ত একজন অভিনেতাকে, কালজয়ী হতে গেলে কত রকমের প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করতে হয়। কারণ একটা ছবি প্রদর্শন চালু হওয়ার পর দর্শক মনে স্থায়ী জায়গা পাওয়া নিশ্চয়ই ছবিটা নির্মাণ পর্বে তৈরি হয়ে যায় না।
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।
কিন্তু একজন অভিনেতা তার নিজের ক্রিয়াকর্ম যদি ঠিকঠাক করে রাখতে পারেন তাহলে তার ফলাফল কিন্তু সুদূর প্রসারী হতে বাধ্য যেটা উত্তমবাবুর ক্ষেত্রে হয়েছে। এযাবৎ প্রেক্ষিত আলোচনার পর আমরা প্রবেশ করব ‘ডাক্তারবাবু’ ছবির অভ্যন্তরে। ছবিটির কাহিনি অত্যন্ত সাদামাটা একজন ডাক্তারের। একজন ডাক্তারের জীবন বেদ আলোচিত হয়েছে এই ছবিতে। উত্তম ডাক্তার চরিত্রে বহু অভিনয় করেছেন। প্রথম যে ছবিতে অভিনয় করে তিনি মানুষের নজর কেড়েছিলেন তা ছিল ‘সাগরিকা’ পাশে অবশ্যই সুচিত্রা সেন। পরের বছর ‘পথে হল দেরি’ আরও পরের বছর ‘সপ্তপদী’।
তারও কয়েক বছর পর ‘সূর্যশিখা’ এবং ভালো করে অনুধাবন করলে দেখা যায় কেরিয়ারের শেষের দিকে ‘আমি সে ও সখা’, ‘আনন্দ আশ্রম’ এইসব ছবিতে ডাক্তারের ভূমিকায় অত্যন্ত কুশলী একজন শিল্পী হিসাবে তাকে দেখাচ্ছে।
তারও কয়েক বছর পর ‘সূর্যশিখা’ এবং ভালো করে অনুধাবন করলে দেখা যায় কেরিয়ারের শেষের দিকে ‘আমি সে ও সখা’, ‘আনন্দ আশ্রম’ এইসব ছবিতে ডাক্তারের ভূমিকায় অত্যন্ত কুশলী একজন শিল্পী হিসাবে তাকে দেখাচ্ছে।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৩: শ্রীমার বড় ভাইজিরা—নালু ও মাকু
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২০: মানকুমারী বসু—সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল রত্ন!
ছবিটির আঙ্গিক নির্মাণে পরিচালক বিশু দাশগুপ্ত কোনরকম সমঝোতা করেননি সিরিয়াস রোলে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় কে কাস্ট করে তিনি পরিচালক হিসেবে পরিণত বোধের পরিচয় দিয়েছেন। ছবিটির প্রতিটি আঙ্গিকে ডাক্তারবাবুর মনোবেদনা কীভাবে সবার অন্তরালে প্রকাশিত হয় সে ব্যাপারটাও পরিচালক ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন এইভাবে আমরা দেখব যে একজন পরিচালক শুধু রোম্যান্টিক উত্তম কুমারকে ছাড়াও সিরিয়াস রোলে উত্তম বাবুকে যেভাবে ব্যবহার করেছেন তা কালের বিচারে উত্তীর্ণ এবং আগামী দিনে সোনালি ভবিষ্যতের দ্যোতক।
ছবিটির দুর্বলতা দুটি অংশে দেখতে পাই একটি নায়ক নায়িকার যখন মুখোমুখি দ্বৈরথ উপস্থিত হচ্ছে তখন সেখানে মানবিক আবেদন অপেক্ষা। যান্ত্রিক নৈপুণ্য দেখানোর একটা অসম প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। অর্থাৎ দর্শকরা ছবিটির অন্তর্নিহিত ভাব নিয়ে যেভাবে নিমজ্জিত হচ্ছে আর প্রতিটি অংশ বিঘ্নিত হচ্ছে ছবিটির টেকনিক্যাল অংশকে নির্মেদ রাখতে পরিচালকের অতি সচেতনতা। তবুও এ ছবি সুপারহিট হয়েছিল।—চলবে।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar–Mahanayak–Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।