সোমবার ৭ অক্টোবর, ২০২৪


এ এমন এক ছবি নিয়ে আলোচনা, যার পরতে পরতে ইতিহাসের হাতছানি। প্রথম কথা ফ্লপ মাস্টার জেনারেল উত্তম কুমার যে খড়কুটো ধরে মানুষের কাছে হালে পানি পেয়েছিলেন এ ছবির কাহিনি সে দিক দিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার।

ছবির জগতে ব্যর্থ হবার পর তারই যখন ‘শ্যামলী’ নিয়ে তুমুল উন্মাদনা শুরু হয়েছে। সে সময়েই সৌভাগ্যবশত উত্তম কুমারের ফিল্মি কেরিয়ার আশার আলো খুঁজে পায়। পরবর্তী এক বছরের মধ্যে যে এ কাহিনির সেলুলয়েডি মস্তানি, উত্তম কুমারকে এবং বাংলা ছায়াছবির জগতকে অনেক এগিয়ে দিয়েছিল।
উত্তমকুমারের শুধু অভিনেতা হিসাবে যদি অকাল প্রয়াণ না হতো তাহলে আবশ্যিকভাবে উনি ছায়াছবি নির্মাণে অর্থাৎ পরিচালকের ভূমিকায় খুব উজ্জ্বল হয়ে রয়ে যেতেন। কারণ আমরা আমজনতা, গড়পড়তা দৃষ্টিতে দেখি উত্তম কুমার অনেক হিট সুপারহিট ফিল্মের বড় অংশীদার। কিন্তু আমরা যেটা দেখতে পাই না একটা গোটা বছরেই গতানুগতিক অন্য ছবির বাইরে অনেক ব্যতিক্রমী ছবি আলোচনার টেবিলে আসতো। যেগুলো উত্তমবাবু যত্ন করে রূপায়ণ করেছেন।

মোদ্দাকথা উত্তমবাবু অভিনেতা হিসাবে নিজেকে প্রকাশ করার চেয়েও ফিল্মের একজন গবেষক হিসাবে নিজেকে প্রকাশ করেছেন অনেক বেশি। যদি সালতামামির দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখব, উত্তম কুমার বাঁধাধরা সিনেমার বাইরে কেরিয়ারের শুরু থেকেই অন্য ধরনের সিনেমা নির্মাণে বেশি অভ্যস্ত ছিলেন। যে ক্রাইটেরিয়া থাকলে একটা ফিল্মের অন্যরকম ডাইমেনশন পাওয়া যায় সে দিক দিয়ে উনি অনেক শুদ্ধচেতা ছিলেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪২: আশা-ভরসার ‘শঙ্কর নারায়ণ ব্যাঙ্ক’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২০: পঞ্চমের সুর আর কিশোর-আশার অনবদ্য উপস্থাপনা, ‘এক ম্যায় অউর এক তু’ গানটি আজও সুপারহিট

আমাদের আলোচ্য ‘শ্যামলী’ ছবির কাহিনি, সেরকমই একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। যে সময় উত্তম সুচিত্রার রোম্যান্টিক যুগের সূচনা ঘটেছে, হাজারো প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নায়ক-নায়িকা খুঁজে পাচ্ছে তাদের ঈপ্সিত মিলন; সেসময় দাঁড়িয়ে ‘শ্যামলী’র মতো একটি অপরিচিত এবং ফিল্মিজন-সমর্থিত নয়, এমন ফিল্মের নায়কের ভূমিকায় আত্মপ্রকাশ করা বেশ সাহসের পরিচয় বলতে হবে।

আজকের সাংস্কৃতিক মানচিত্রে ও যে কাহিনি মঞ্চে রূপায়িত হয় তার সেলুলয়েডে খুব বেশি জায়গা হয় না। লোকে তুলনা করে আহা এর স্টেজে যা অভিনয় দেখেছি ফিল্মে তার এক পার্সেন্টও করতে পারেনি।
সে ‘সাজানো বাগান’ আর ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ তো সবসময় হয় না। কিন্তু সাবিত্রীর সঙ্গে সুপার ডুপার হিট মঞ্চ সফল ‘শ্যামলী’, ফিল্মে গিয়ে কাবেরী বসুর সঙ্গে একটি অনন্য চরিত্র রূপায়নে এলেম দেখানো … ভাবতে কষ্ট হয়। যে বছর ‘সাগরিকা’, ‘শিল্পী’ মানুষকে সিটের সাথে বেঁধে রেখেছিল সেখানে দাঁড়িয়ে ‘শ্যামলী’-কে তুলে ধরা, পরিচালকেরও যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয়।

যে পরিচালক পরবর্তীকালে ‘হারানো সুর’, ‘সপ্তপদী’, ‘সাত পাকে বাঁধা’ ইত্যাদির মতো ছবি রুপায়ন করেছেন তাঁর হাতে এ ধরনের একটি মঞ্চ-সফল কাহিনির রূপায়ণ, মানুষকে চিন্তিত করে দেয় বৈকি। ছবিটির সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ প্লেয়ার কাস্টিং। যাঁকে যে চরিত্রে মানাবে অজয়বাবু যেন স্কেলে মেপে তাদেরকে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫: সুন্দরবন নামরহস্য

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১: রাজবাড়ির ইতিকথা—ইতিহাসের অন্তরে ইতিহাস

অহীন্দ্র চৌধুরীর মতো মঞ্চ-প্রবীণ একজন অভিনেতাকে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে ফিল্মের অভিনয় করিয়ে নেওয়া চাট্টিখানি কথা ছিল না। বিশেষত যে সময়ে তুলসী চক্রবর্তীর সঙ্গে তাঁর দ্বৈরথ বাঁধছে। চিত্রনাট্যের প্রতিটি জরিপ যেন চরিত্রকে নবরূপে জন্ম দিয়েছে।

চিত্রমোদী দর্শক-শ্রোতারা জানেন, একই সংলাপ সকলের মুখে মানায় না। যে কারণে বারবার ঘুরে ফিরে আসে একটা আলোচনা ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’-তে কবিয়াল চরিত্রে অভিনয় করা উত্তম কুমার পরবর্তীকালে নিজেকে ভেঙেচুরে ‘ভোলাময়রা’-র চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। উত্তমবাবু নিজেকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে এমন একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে ফেলেছিলেন যে উনি পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে সফল হতে পারা যায় কিনা!
আরও পড়ুন:

দশভুজা: আমি আর কখনওই ফিরে আসার প্রত্যাশা করি না…

অজানার সন্ধানে: এক লিটার পেট্রলে গাড়ি ছুটবে ১০০ কিমি! যুগান্তকারী যন্ত্র আবিষ্কার করেও রহস্যজনক ভাবে উধাও হন বিজ্ঞানী ওগলে

আমার মূল্যায়ন, উনি যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে ‘সপ্তপদী’-র ছবি বিশ্বাস যে ভূমিকায় নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন উত্তমবাবুও আগামী দিনে সে ধরনের মানে পৌঁছে যেতেন।
অমিতাভ বচ্চন যদি গব্বর সিং-র রোলে অভিনয় করার সুযোগ পেতেন বা করে থাকেন তাহলে তার রূপায়ণ মানুষ কতটা নেবে !

প্রশ্নগুলো অবান্তর হবে না ‌ যদি দেখা যায় পূর্বের ছবিটি অত্যন্ত সফল। ‘শোলে’-তে গব্বর সিং সফল না হলে তার রিমেক করতে গিয়ে সেই গব্বরের ভূমিকায় অমিতাভবাবু নিজেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেন করবেন? অনুরূপ উক্তি প্রযোজ্য উত্তমবাবুর ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’তে। ফিরিঙ্গি কবিয়াল এর চরিত্র সুপার হিট হয়েছিল বলেই উনি ভোলাময়রা-র রোলে নিজেকে প্রকাশ করার ঝুঁকি নিয়েছিলেন।
যাইহোক ‘শ্যামলী’ ছবির কাহিনি অনুযায়ী প্লেয়ার এবং চিত্রনাট্যের বলিষ্ঠতা ছবিটিকে পূর্ণমাত্রার দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে ছিলেন স্টেজ অ্যাক্টিং এবং ফিল্মের অ্যাক্টিং-র পার্থক্য বুঝতে পারা উত্তম কুমারের মতো পরিমিত জ্ঞান সম্পন্ন অভিনেতার চরম পরিণত উপস্থিতি।

একটি ছবির মূলধন, তার দর্শক সমাজে আবেদন বা কতটা গ্রহণযোগ্যতা। স্টার-র ‘শ্যামলী’ গ্রামে বসে যারা দেখতে পাননি, সেলুলয়েডের বুকে রোটেশনালি সমস্ত বাংলায় শ্যামলী একযোগে মানুষ হলে বসে দেখতে পেলেন।

এ ধরনের একটা ব্যবসায়িক দিক এই ছবিটিকে সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল।—চলবে।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content