সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


 

মুক্তির তারিখ : ২৭/০৫/১৯৫৫

 

প্রেক্ষাগৃহ : রূপবাণী, অরুণা ও ভারতী

 

পরিচালনা : সুধীর মুখোপাধ্যায়

 

উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম : মহেন্দ্র

‘শাপমোচন’ ছিল মুখার্জিদের ছবি। কথাটা বলার তাৎপর্য হল ছবির কাহিনি লিখেছেন ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, সুর করেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, পরিচালনায় সুধীর মুখোপাধ্যায়, আর যে চরিত্রতে উত্তম কুমার প্রাণ দান করেছিলেন তার নাম ‘মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।’ তাই রসিকতা করে সুধী সমাজ ছবিটিকে মুখোপাধ্যায় বা মুখার্জিদের ছবি বলে ডেকে থাকতে পছন্দ করেন।

এ ছবির পরতে পরতে কিংবদন্তির হাতছানি। ‘অগ্নি পরীক্ষা’তে শুরু হওয়া ‘সুচিত্রা-উত্তম’ বা ‘উত্তম-সুচিত্রা’ নামক সেই অমোঘ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু এ ছবিতে পূর্ণতা পায়।

পরিচালক সুধীর মুখোপাধ্যায়ের আগে বেশ কয়েকটি ছবিতে হাত পাকিয়েছেন তার মধ্যে
‘পাশের বাড়ি’ উল্লেখযোগ্য। ‘শাপমোচন’ যখন নির্মাণ পর্বে তখন পরিচালক এবং প্রযোজক গোষ্ঠী মনে করেন সঙ্গীতবহুল এ ছবির দায়িত্ব নতুন কোন সংগীত পরিচালকের হাতে দেওয়া হবে।

সংগীতের যে মান এই ছবির কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে প্রাণশক্তির কাজ করেছে তার স্রষ্টা শুধু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নয়, বাংলা সংগীত জগতকে একটি নক্ষত্র উপহার দিয়েছিল।

আমরা ধাপে ধাপে ছবিটির বেশ কিছু অংশ তথা স্মরণীয় অধ্যায় আলোচনা করব। ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় ‘সন্ধ্যারাগ’ এ শব্দ বন্ধের মোড়কে উপন্যাসের যে নির্মাণ করেছিলেন তা-ই ‘শাপমোচন’ রূপে চলচ্চিত্রায়িত হয়েছিল।

ছবিটির কাহিনি ছিল এরকম, ‘শাপ দিয়েছিলেন ক্ষুব্ধ গুরু। বংশের যে কেউ সঙ্গীতচর্চা করলেই হয় পঙ্গু না হয় অপঘাতে মৃত্যু। দরিদ্র সঙ্গীতগুরুকে অপমান করার জন্যই এমন নির্ধারণ অভিশাপ। বড় ভাই কুসংস্কার বলে সংগীত চর্চা শুরু করেন কিন্তু কঠিন ব্যাধিতে তার দুটি চোখে হারাতে হয়। রোজগারের আশায় ছোট ভাই মহেন্দ্রকে পাঠালেন কলকাতায় যাওয়ার আগে শপথ করিয়ে দেন সংগীতচর্চা একদম নয়। মহেন্দ্র কলকাতায় এসে উঠল বাবার বন্ধু উমেশবাবুর বাড়িতে। ভদ্র নাগরিক সমাজের সামনে মহেন্দ্রকে তুলে ধরতে চাইলো উমেশবাবুর কন্যা মাধুরী। মহেন্দ্রকে গড়ে তুলতে গিয়ে মাধুরী নিজেই ডুবে গেল গভীর প্রেমে। একদিন হঠাৎ মাধুরী আবিষ্কার করল সুর পাগল মহেন্দ্রকে। সব শুনেও মাধুরী ব্রাহ্মণের অভিশাপ থেকে উদ্ধার করে আনতে চায় পুরো পরিবারটিকে।

এই ছিল ‘শাপমোচন’-র প্রেক্ষিত। অসাধারণ আটটি গান এ ছবির সম্পদ, যা আজও লোকের মুখে ফেরে।
এবার আসি উত্তম-সুচিত্রা যুগল পর্বে। ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র পর মাত্র দুটি ছবি ‘সাঁঝের প্রদীপ’ এবং ‘গৃহপ্রবেশ’। ছবি দুটি সে অর্থে ‘অগ্নিপরীক্ষা’র সমতুল্য জনপ্রিয়তা না পেলেও উত্তম-সুচিত্রা একই ফ্রেমে দুজন দুজনকে যেভাবে উপস্থাপনের রীতি বাংলা চলচ্চিত্রে দেখিয়েছেন পরবর্তী ‘শাপমোচন’-এ তার প্রতিষ্ঠা হয়ে গিয়েছে।

‘শাপমোচন’ সে-সময়ে এমন একটি ছবি যা শুধু উত্তম সুচিত্রাকেই নয়, বরং পরিচালক হিসাবে সুধীর মুখোপাধ্যায়কে এবং সংগীত পরিচালক হিসাবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে পায়ের তলায় শক্ত মাটি এনে দিয়েছিল।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে উত্তম কুমারের যে অভূতপূর্ব সমাপতন তার জয়যাত্রা শুরু হয় এই ‘শাপমোচন’ ছবি থেকে।

ছবিটির সবচেয়ে বড় সম্পদ ক্যামেরার সঙ্গে সঙ্গে বিষয়বস্তুর অভিনবত্বে। রেডিওতে গান করলে মানুষকে যে এত সুন্দর লাগে এবং রেডিও মানুষের জীবনে এতখানি গভীর প্রভাব বিস্তার করে তা, ‘শাপমোচন’ না দেখলে বোঝা যাবে না।

ছবির নামকরণ উপন্যাসের থেকে আলাদা করে। শব্দবন্ধের ঋণ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ থেকে নেওয়া হলেও মানুষ এই ছবিটিকে আলাদা মর্যাদা দিতে কোন কার্পণ্য করেননি।

পরিচালক প্রথমে ভেবেছিলেন ছবির নাম রবিঠাকুর ঘেঁষা বা রাবীন্দ্রিক ঘরানার হলে না জানি কত সমস্যার মধ্যে পড়তে হবে। কিন্তু উত্তম-সুচিত্রা উত্তম-হেমন্ত এই যুগল বন্দির পারস্পরিক নিবেদনে বোধহয় আমজনতার মাঝে ‘শাপমোচন’ শব্দটিও সার্থকতা পেয়েছিল যা রবি ঠাকুরের আমলে সম্ভব হয়নি।

গায়ক হিসেবে কোন মানুষকে যে এতটা সুন্দর লাগে এবং গায়ক হলে রাতারাতি তারকা হওয়া যায় সে ধরনের থিম উত্তম কুমার এর আগে পাননি। অর্থাৎ ছবির মধ্যেই দর্শক শ্রোতাদের জনপ্রিয়তার একটা স্তুতিকরণ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। মা, উত্তম কুমারের তারকা হিসাবে নিজেকে প্রকাশ করতে আগামী দিনে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছিল।

আমরা এর প্রায় সাত আট বছর পর ‘দেয়া নেয়া’ নামক একটি ছবিতে উত্তম কুমারকে প্রতিষ্ঠিত গায়কের চরিত্রে রূপদান করতে দেখব। তারও ৭-৮ বছর পর ‘সোনার খাঁচা’ ছবিতে একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ তারকা গায়কের জীবনবেদ রূপায়ণ করতে দেখব। তাহলে ‘শাপমোচন’-র মধ্যে কী এমন যাদু ছিল যা উত্তম কুমারের এই তিনটি গায়ক সত্তার ভেতর অন্যতম।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৮: পূর্ণ অপূর্ণ-র মাঝে পথ দেখায় ‘দেবত্র’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৪: পঞ্চমকে সিনেমা হলে বসিয়েই বেরিয়ে যান রীতা

পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৯: অমরগীতি ছবিতে রাজাবাবু চরিত্রে তরুণ মজুমদারের প্রথম পছন্দ ছিলেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়

পরবর্তী যে দুটি ছবির কথা বললাম ‘দেয়া নেয়া’ এবং ‘সোনার খাঁচা’, সেখানে গায়কের নির্মাণ পর্বে নায়িকার কোনও ভূমিকা সে অর্থে ছিল না। বরং প্রতিষ্ঠিত গায়কের পারিপার্শ্বিক কী সমস্যা সেই অংশটা বেশি করে আলোকপাত করা হয়েছিল। শাপমোচনের বেলায় কিন্তু তা নয়। এ ছবিতে একজন দরিদ্র পরিবার থেকে কিভাবে তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে যুদ্ধ করে গায়কের আসনে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন সেটাই ছিল মূল কেন্দ্রবিন্দু, সেখানে নায়িকা হিসাবে একজন ধনীর দুলালী যিনি নিজেও সংগীত সাধনার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত তার আত্মত্যাগ অংশটা বেশি করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
বাংলা ছবির ইতিহাসে উত্তম পরবর্তী সময়ে একমাত্র ‘গুরু দক্ষিণা’ ছবিতে এ ধরনের একটি চিন্তাভাবনা তৎকালীন পরিচালক প্রকাশ করেছিলেন। যেখানে দরিদ্র জয়ন্ত কে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ধনী নায়িকা নিজে গায়িকা হয়েও স্ত্রীর কর্তব্য পালন করতে নায়ককে এগিয়ে দিয়েছেন।

মহেন্দ্রকে সর্ব অংশে পূর্ণ করার জন্য একজন অভিজাত ঘরের রমণীর কি ত্যাগ থাকতে পারে তা বোধ হয় ‘শাপমোচন’ ছবি না দেখলে মানুষ বুঝতে পারত না।

‘প্রাচীন সাহিত্য’ প্রবন্ধে স্বয়ং রবি ঠাকুর সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছিলেন, ‘অন্নপূর্ণার সঙ্গে বৈরাগীর যে মিলন তাই প্রকৃত মিলন’। উপন্যাসিক ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় তার ‘সন্ধ্যারাগ’ উপন্যাসে সে ভাবনা বীজ অবস্থায় আস্তে আস্তে ঘটনার জল সেচন করে মহীরুহ গড়ে তুলেছিলেন।

মহেন্দ্ররূপ বৈরাগীর সঙ্গে মাধুরী রূপ অন্নপূর্ণার মিলনকে সার্থক করতে যত বাধা এসেছিল সমস্ত কেই প্রেম-ত্যাগ-তিতিক্ষা সবকিছুর মেলবন্ধনে উত্তরণ করতে সহযোগিতা করেছিল।
পরিচালক সুধীর মুখোপাধ্যায় উপন্যাসের এই সূক্ষ্ম বিনির্মাণ ছত্রে ছত্রে ক্যামেরা দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।

এ ছবিতে (ব্যক্তিগত জীবনে অভিজাত ঘরের বৌমা এবং) ধনীর কন্যা হিসাবে সুচিত্রা সেন চোখের যে ব্যবহার করেছেন মানে, উত্তম কুমার এবং সুচিত্রা সেন মুখোমুখি হওয়া ছাড়াও ফ্রেম টু ফ্রেম সুচিত্রা সেনকে নিয়ে পরিচালক যে চিত্রকল্প উপস্থাপন করেছেন তা এক কথায় অনবদ্য।

আমার বলার উদ্দেশ্য, ছবিটিতে যদি অন্য কোন অভিজাত ঘরের শিক্ষিত মার্জিত রুচিসম্পন্ন নায়িকাকে পরিচালক মনোনয়ন করতেন যে সময়ে পাশাপাশি অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়, কাবেরী বসু (সাহেব বিবি গোলাম খ্যাত) সুমিত্রা দেবী ছিলেন সে-সময় সুচিত্রা সেনের নির্বাচন, পরিচালককে কয়েক কদম এগিয়ে রেখেছিল।

কারণ সুচিত্রা সেনের বিকল্প সুচিত্রা সেনই। আগামী দিনে যখন ধনীর দুলালী হিসাবে তাঁকে আমরা আবার দেখবো ‘শিল্পী’, ‘পথে হল দেরি’ ইত্যাদি ছবিতে। সেখানেও তাঁর অভিব্যক্তি, শুধু তাঁকে নয়, স্বয়ং উত্তম কুমারকেও চলচ্চিত্র জগতে অনেক এগিয়ে রেখেছিল।

তারকা নামক উপাদানটি চলচ্চিত্র বিদ্যায় যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়ে থাকে। তারকা প্রথাকে শুধু বিনোদনের কিছুটা স্থুল উপায় হিসেবে দেখা হয় না, তারকার মধ্য দিয়ে পরিচয়-আত্মপরিচয় গঠন এক ছবি থেকে অন্য ছবিতে চিহ্নের বহন ফিল্ম টেক্সটের সঙ্গে বৃহত্তর প্রাতিষ্ঠানিক অর্থ উৎপাদন পদ্ধতির সম্পর্ক বহু গবেষণার জন্ম দিয়েছে।

যে বছর উত্তম কুমারের ‘শাপমোচন’ নির্মাণ হচ্ছে ভারতীয় চলচ্চিত্রে হিন্দি ভাষায় সে বছরই রাজ কাপুরের ‘শ্রী ৪২০’ মুক্তি পেয়েছে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৬: কবির ভালোবাসার পশুপাখি

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৩: আর্ষ মহাকাব্যদ্বয়ের আদি প্রচারমাধ্যম

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৮: ড. হীরালাল চৌধুরীর আবিষ্কার আজও পোনামাছ চাষীদের কাছে এক পরম আশীর্বাদ

সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশের মানুষের আর্থিক অবক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে যে নৈতিক মেরুদণ্ডটা বজায় রাখার লড়াই, দেশভাগের পরবর্তী বিশেষত বাংলাদেশের যে আর্থিক এবং সামাজিক পরিকাঠামোর একটা পারস্পরিক আড়চোখে তাকানো শুরু হয়। সেই প্রেক্ষিতেই ‘শাপমোচন’-র মহেন্দ্রর জন্ম। গ্রাম থেকে শহরে যাত্রার একটা অভিমুখ সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা যায়। যে গ্রামের প্রাকৃতিক সম্পদ মানুষকে দয়া-মায়া-ক্ষমা ত্যাগ-তিতিক্ষার একটা মূর্তি হিসেবে গড়ে তুলত শহুরে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইতে সেই মানুষগুলোই কীভাবে নিজেদের মধ্যে চরম লড়াইকে বজায় রাখতো তার প্রতিফলন শাপমোচন ছবির প্রতিটি ফ্রেমে।

সঙ্গে সঙ্গে নাগুরেপনা, মানুষকে বড় আকৃষ্টও করতো। সেখানকার জীবনযাপন এবং প্রত্যেকটি বিষয়তে মানুষকে পরিপাটি হয়ে বেঁচে থাকার একটা রীতি অনেক বেশি আকর্ষণ যোগাযোগ।

শহরাঞ্চলের সেই দাপুটে প্রাতিষ্ঠানিক সিস্টেমকে গ্রামীণ মানুষের হজম করতে সমস্যা হতো। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ দেখানোর যিনি প্রকৃত বন্ধু তিনি পরবর্তীকালে জীবনসঙ্গী হিসাবে কাজ করতেন। এ ধরনের যাত্রা থেকেই শাপমোচনের বিন্যাস।

ছবির প্রতিটা অংশে জড়িয়ে আছে গান। যে গান গাওয়ার অপরাধে ছবির নায়ক এবং তার পরিবার অভিশাপগ্রস্থ হয়েছে পুরুষাক্রমে, সেই গানই আবার নায়ক এবং নায়িকাকে পরস্পরের কাছাকাছি এনে দিয়েছে। একই পরিবারের গান গাওয়াকে কেন্দ্র করে বড় ভাই দেবেন্দ্র এবং তার স্ত্রীর মধ্যে যে বিচ্ছেদ হয়ে গেল সেই পরিবারেই গানকে সামনে রেখে দু’ জন অসম মেরুর নায়ক-নায়িকার মধ্যে চিরকালীন মিলন রচিত হল এরকম একটি দুর্লভ সঞ্জীবনী সেতু রূপায়ণে, শুধু নায়ক-নায়িকা নয় পরিচালক প্রযোজক সহশিল্পী এবং সর্বোপরি সংগীত পরিচালকের ভূমিকা অনেক বড়।

উত্তম কুমার পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে এসে তারকা হিসেবে এমন এক শরীর ধারণ করেছিলেন যা আধুনিকতার পরিসরে নিজের ঠিকানা খুঁজে নিয়েছিল। এই সিনেমাটিক শরীরকে আমরা আগে দেখিনি এবং বলাবাহুল্য এ নিছক শারীরিক ব্যাপারও ছিল না। এই শরীর সিনেমায় নির্মিত হয়ে অবয়ব ভঙ্গি বাচন কণ্ঠের সংযোগ এবং বিযুক্তির মধ্য দিয়ে ইন্দ্রিয় জগতের মধ্যে ব্যক্তি অবয়বের প্রসারণ এবং সেই জগত থেকে তার বিচ্ছিন্নতার প্রক্রিয়ায় চলচ্চিত্র বিদ্যা এসব নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে কিন্তু আমরা এখনও জানি না বিবরণ বা ব্যাখ্যার আওতায় এসব বস্তুকে কী করে আনা যায় উত্তম কুমারের পারসনা যেমন অনেকখানি এক ধরনের চলন দিয়ে তৈরি এই চলনে দেহের ব্যবহার অবশ্যই প্রাথমিক কিন্তু চলনের যদি একাধিক উপাদান থাকে ধরে নিই সেটাও কিছু মাল-মশলা দিয়ে তৈরি তাহলে নিশ্চয়ই ইন্দ্রিয় অনুভূতির এক একটা ব্যবস্থায় এক এক রকম হয়ে উঠবে। শহর এক রকম ভাবে ঘুরে নেয় এবং চলনের কোনও একটা আদর্শ রূপ ভাবা যায় এর সাপেক্ষে, যা শুরু হয়েছিল শাপমোচন ছবির প্রস্তুতির সময় থেকে।

পরবর্তীকালে আমরা দেখেছি উত্তম কুমারের ছবিতে তার নিজের কণ্ঠ আরও একটি জরুরি উপাদান। কণ্ঠের ক্রিয়া বাচনের চেয়ে অনেক বেশি জটিল। যেসব তাত্ত্বিক ক্ষণ ব্যবহার করেন তারা বলেন যেমন দৃষ্টি নয় কোন বিশেষ চোখের দেখার প্রক্রিয়া নয় বরং দৃষ্টির বিমুর্ত সাধারণ দশা দৃষ্টি ক্ষমতা তেমনি কণ্ঠ বাচন নয়, বলা যায় কণ্ঠের সমস্ত ব্যবহারের পিছনে যে বিমূর্তি কণ্ঠ সেই রকম একটা কিছু। কোন স্তরে কাজ করে যায় বলে কণ্ঠ আমাদের অজান্তে ছবির সঙ্গে অথবা সেই জমিতে দাঁড়ানো কোন মানুষের সঙ্গে গভীর কোন সংযোগ ঘটাতে পারে। আইডেন্টিফিকেশন প্রক্রিয়ায় বিশেষ ভূমিকা নিতে পারে উত্তম কুমার এবং তার সঙ্গে জড়ানো অনেকটা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠ। স্বাধীনতা, উত্তাল নাগরিক সত্তার এমন এক চিহ্ন যাকে না বুঝলে এক শ্রেণির এক বিশেষ অবয়বকে হয়তো বোঝা হয়ে উঠবে না।

এরকম নানা সূত্রে গাঁথা এক শরীরের কথা বলতে চাইছি নাগরিকত্ব বা গণতন্ত্রকে যদি ভাষা হিসেবে দেখা যায়, তাহলে বলা যেতে পারে যেমন একটা বৃহৎ সর্বজনীন ভাষা আছে তেমন কিছু স্থানীয় ভাষায় অনূদিত সংস্করণ আছে। সেই অনুবাদের কাজে হাত দিতে হয়েছে আমাদের এগিয়ে পিছিয়ে সর্বজনীন মডেলের মুখোমুখি হয়ে পাশ কাটিয়ে। জনপ্রিয় সংস্কৃতি এই প্রকল্পে নিজের মতো করে যোগ দেবে সেটাই স্বাভাবিক মাতৃভাষায় নাগরিক হয়ে ওঠার এমনই এক প্রকল্প। আজ আমাদের আধুনিকতার যখন আরেকটি পর্বের প্রাথমিক প্রস্তাবগুলি অতিক্রম ও বিস্মরণ সুনিশ্চিত হয়ে উঠেছে।

আরেকটি অংশ না বললে শাপমোচন ছবির মূল্যায়ন অনেকটা ফিকে থাকবে তা হল ঠিক এর আগে পিছে ‘ঢুলি’ ছবি মুক্তি পায়। যেখানে সুরের জগতের অমৃতবাহি নায়ককে প্রতিষ্ঠার আলোতে আনতে নায়িকা সুচিত্রার চেষ্টার অন্ত ছিল না। সেই সত্তাকে অতিক্রম করে শাপমোচন এর সুচিত্রা নিজেকে অনেক পরিণত প্রমাণ করেছিলেন উত্তম কুমারের চোখের দিকে তাকিয়ে।

গায়ক হিসাবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় উত্তম কুমারকে পর্দায় যে প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছিলেন তাতে শুধু আমজনতাই নয় আমজনতার প্রতি রূপক হিসাবে পর্দাতেই সুচিত্রা মুগ্ধতমার পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন। আমরা দর্শকরা যে মুগ্ধতার রেশ চোখের মধ্যে নিয়ে ‘শাপমোচন’ দেখতে বসেছি তাদের সবার প্রতিনিধি হয়ে যেন ছবির মধ্যে সুচিত্রা নিজেকে উপস্থাপন করছেন। এ অংশের নির্মাণ খুব একটা সহজ কাজ নয়।
আরও পড়ুন:

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১০: রেমন্ড কোপা এক কিংবদন্তি ফুটবল বাদশা

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭: ওখানে কে?

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১২: দক্ষ কর্মী নির্বাচন বনাম নারী সহকর্মী

এ ছবির কাহিনীগত কাঠামো, দর্শকদের এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে তার পরবর্তী বছরে অগ্রগামী গোষ্ঠী যখন ছবি নির্মাণে প্রথম আসরে নামেন সেখানে শিল্পী ধীমানকে, অভিজাত ঘরে অঞ্জনার বাড়িতে আশ্রয় দেন। এমনকি ফ্রেম টু ফ্রেম দুটি অসম পরিবারের প্রেম সার্থকতার কোন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় তা, অনুমিত হয়, ছবিটির শেষ পরিণতি থেকে সে সময় অনেক ছবি থেকে আলাদা আকর্ষণ টেনে নিয়েছিল। যেমন ঋষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘আনন্দ’ ছবিতে রাজেশ খান্নার মৃত্যু ছবিটিকে দর্শকের মাঝে স্মরণীয় করে রেখেছিল ঠিক একই ফর্মুলাতে বড় লোকের বাড়িতে আশ্রয় নেয়া গরিবের ছেলে গুণী গরিবের ছেলে মধ্যে যখন নায়ক সত্তার উত্তরন ঘটছে। সেই সম্মোহনী অংশকে মৃত্যুর হাতে স্থানান্তর করে দর্শক থেকে অতিরিক্ত সমীহ আদায় করে নেওয়া। একই ফর্মুলাতে পরবর্তীকালে ‘পথে হল দেরি’ নির্মাণ হয় সেখানেও শেষ পরিণতি একটু পাল্টে দর্শকের থেকে অতিরিক্ত সমীহ আদায় করে নেওয়া হয়েছিল। এ ভাবে আমরা দেখতে পাই ‘অগ্নি পরীক্ষা’-তে শুরু হওয়া মানসিক বৈষম্যকে একটি রুপরেখার আওতায় আনায় যে চেষ্টা উত্তম সুচিত্রাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল ‘শাপমোচন’ ছিল তার সেই দিক নির্দেশক একটা ভূমি।
আরও পড়ুন:

হেলদি ডায়েট: দাঁতকে অবহেলা নয়, শিশুর দাঁতের যত্ন নিন গোড়া থেকেই, সতর্ক হন এই সব খাবারে

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১২: ঘাম কমাতে পাউডার ব্যবহার করেন?

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১২: বাইগা রিসর্ট ও বস্তি

আমরা এর প্রভাব পরবর্তী ছবিগুলির নির্মাণ পর্বে অনেক বেশি দেখতে পেয়েছি। মনে রাখতে হবে সুচিত্রা সেনকে ঘিরে যে কোড তৈরি হচ্ছিল তার একটা লক্ষণ হল পারিবারিক ঘেরাটোপের বাইরে পরিবারের আভাস এড়িয়ে ফ্রেম তৈরি করা এ জাতীয় কম্পোজিশন মূলত সফটওয়্যার তাকে একাকী স্বতন্ত্র করে রাখে নতুন যুগলের জন্য নতুন ব্যক্তির সংশ্লেষ প্রয়োজন। সেই উদ্যোগের সঙ্গে চলচ্চিত্র আঙ্গিকের সম্পর্ক বহু স্তরে বিস্তৃত পরবর্তীকালে সুচিত্রা যে মিসেস সেন হয়ে উঠবেন তার পূর্ণ আভাস ‘শাপমোচন’-র ছত্রে ছত্রে পাওয়া গিয়েছিল।

এবার আসি গান প্রসঙ্গে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত কুমার নামে বোম্বেতে জনপ্রিয়তা এবং কাজের যে অভিধান রচনা করেছিলেন তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটেছিল ‘এ বঙ্গের সমতলে তৃণলতা গুল্ম দলে’ ‘শাপমোচন’ ছবিতে।

অন্যদিকে বাংলা ছবিতে বিশেষত সংগীত আয়োজনে আধুনিকতার মিশেল কতটা প্রয়োজন তা এ ছবির সংগীত পরিচালনা দেখলে বোঝা যায়।

একদিকে যেমন রাস্তায় বসে ভিক্ষুক গান করছেন এবং সেই গানে কণ্ঠ দান করছেন শ্যামল মিত্রের মতো নবাগত গায়ক, অন্যদিকে নায়িকা মাধুরীকে গান শেখাতে এসেছেন যে ওস্তাদজি, তার কণ্ঠে চিন্ময় লাহিড়ী বা নায়িকার কণ্ঠে প্রতিমা বন্দোপাধ্যায়কে ব্যবহার ‘অগ্নিপরীক্ষা’ উত্তর ছবিতে সাহসের পরিচয় বলতে হবে।
আমরা এ ছবির নায়কের কণ্ঠের গান নিয়ে মাতামাতি করি, যার সংখ্যা ছিল মাত্র চারটি। এই গানগুলির পারস্পরিক দক্ষতা খুব একটা আলোচনার জায়গা রাখে না। কারণ সংগীত পরিচালক নিজেই এ গানগুলির কণ্ঠদানে দায়িত্ব পালন করেছেন।
কিন্তু যে জায়গাটি সবচেয়ে বড় বলার জায়গা তাহলে উত্তম কুমারের ঠাকুরদার গানের চিত্রায়ন যখন হচ্ছে সেখানে এসডি পালুস্করের নেতৃত্বে গানের তান নির্মাণ আবেদন তারপর ছিন ত্রিবেণী তীর্থ পথে গানের প্রাণ নির্মাণ বা ভিক্ষুকের কণ্ঠে শ্যামল মিত্রকে ব্যবহার সংগীত পরিচালকের জাত চিনিয়ে দিয়েছিল। সঙ্গীতের এই দু ধরনের মিশ্রণ, দু’ ধরনের গায়কীর মিশেল ছবিটিকে সংগীত মুখর করে তুলেছিল। সেসময়ের বাংলা ছবি বিশেষত হিট বাংলা ছবির একচেটিয়া সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতেন কালিপদ সেন। তার বেশ কিছুটা পরে রবিন চট্টোপাধ্যায়।

কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের শাপমোচন এর হাত ধরে বাংলা ছবির সংগীত জগতে আগমন, পুরনো সবকিছুকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়েছিল। আমরা খুব ভালো করে যদি কালিপদ সেন মহাশয় এর সংগীত পরিচালনা বিশেষ করে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের দিকে লক্ষ্য রাখি তাহলে দেখতে পাবো, হলিউডের চার্লি চ্যাপলিনের ছবিগুলির টাইটেল কার্ডে যে মিউজিক ব্যবহার হতো সে ধরনের মিউজিককেই উনি অনেকটা বাংলা ছবিতে ব্যবহার করতেন।

হেমন্তবাবু সেখান থেকে বেরিয়ে ছবিতে যুগোপযোগী কম্পোজিশন ব্যবহারের রেওয়াজ করেছিলেন যা, সেসময়ের প্রতি ছবির একটি অনুকরণীয় সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতো।
পরবর্তীকালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যে সমস্ত পরিচালকের বাঁধা সংগীত পরিচালক হিসাবে কাজ করে গেছেন তাদের মধ্যে অজয় কর এবং তরুণ মজুমদার সবচেয়ে এগিয়ে আছেন। হেমন্ত বাবু যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তারা অন্য কোন সংগীত পরিচালকের কাছে কাজ করেননি। যখন ছবি নির্মাণ করেছেন তখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কেই বেশিরভাগ অংশে সুযোগ দিয়েছেন।
কাজেই ‘শাপমোচন’ ছবিটি, শুধুমাত্র উত্তম কুমারের জীবনে নয় এক দিকে পরিচালকের জীবনে, একদিকে সংগীত পরিচালকের জীবনে, একদিকে নায়িকা সুচিত্রা সেনের জীবনে একটি বর্ণালী জয়যাত্রার সূচনা ঘটিয়েছিল।—চলবে
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content