রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


উত্তম যেহেতু এমপি প্রোডাকশনসের চুক্তিবদ্ধ বেতনভোগী শিল্পী, তাই অন্যথ কোনও প্রোডাকশন হাউসে কাজের সুযোগ তাঁর নেই। অন্যোদিকে এমপি কর্তৃপক্ষও বছরে যতগুলো ছবি নির্মাণ করছেন নায়কের রোলে উত্তমকেই সুযোগ দিয়েছেন। ১৯৫১ সালে মুক্তি পাওয়া তিন তিনখানা ছবিই তো চরম ব্যির্থ। মনের দিক থেকে তিল তিল করে শুকিয়ে যাওয়া।

একটা স্থির সিদ্ধান্তে আসা দরকার। মন বলল চাকরি ছাড়া আর কিছুই করা উচিত নয়, ভাবাও উচিত নয়। মাথার ওপর সংসারের ষোলো আনা দায়িত্ব। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, ফিল্ম লাইনেও কেউ তার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারছেন না। রাখা সম্ভবও নয়। নিজের কাছেই জবাবদিহি চলছে কার অভিশাপ নিয়ে এ অভিযান, কেন তার এ ভাগ্যমবিড়ম্বনা, কেন এ ব্যষর্থতা!
বাড়িতে একমাত্র গৌরী সবরকমের উৎসাহ দিয়ে তাঁকে সজীব রাখেন। উত্তম ছবির জগতে সম্রাট হবেন —এ স্বপ্নতো গৌরীই তাঁকে দেখিয়েছেন। হাতে দু’ একখানা ছবি আছে বটে, তবে বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। ব্যরর্থ শিল্পী হিসাবে নিজেকে ধিক্কার দেওয়াই প্রতিদিনের কাজ। যে মুরলীধরবাবু একদিন ডেকে পাঠিয়ে সস্নেহে মাথার ওপর আশীর্বাদের হাত রেখেছিলেন তিনিও যেন কোথায় একটা বেসুরো হয়ে গেছেন।

পতনের চরম সীমায় যখন মৃত্যুকযন্ত্রণা গলা চেপে বসেছে ঠিক সে সময় পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্ত কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তাঁর প্রতি সদয় হলেন। তাঁর ‘সঞ্জিবনী’ ছবির নায়কের চরিত্রে উত্তমকে নির্বাচন করলেন। নায়িকার চরিত্রে সন্ধ্যাসরানি।
চুক্তিপত্রে সই করার সময় মুরলীধরবাবুর কণ্ঠে সংশয়, ”এ ছবিতে কি উত্তম অভিনয় করতে পারবে? না সুকুমার, তুমি বরং ছবি অথবা ধীরাজকেই নাও— উত্তম তৈরি হলে তখন নিও”। সুকুমারবাবুর কিন্তু দৃঢ় আত্মপ্রত্যেয়। তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন — আমরা যদি তৈরি না করি, তৈরি হওয়ার সুযোগ না দিই, তাহলে তৈরি হবে কেমন করে বলুন?
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬: সে এক হতভাগ্যের ‘নষ্ট নীড়’ [২৪/০৮/১৯৫১]

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-২: তরুণ প্রজন্মের পছন্দের পর্যটন স্পট কক্সবাজার

‘সঞ্জিবনী’-র নায়ক মাতাল। একটি দুরূহ মাতাল চরিত্র। সুকুমারবাবু একান্ত আপনার জনের মতো নিজের কাছে ডেকে ভাল করে চরিত্রটি মনের মধ্যে গেঁথে দিলেন। উত্তমও গভীর শ্রদ্ধা ও একাগ্রতা নিয়ে চরিত্রের ভেতর প্রবেশ করলেন। মনে মনে রিহার্সাল ছাড়া আর কোনও কাজ নেই। সে এক প্রাণান্তকর অবস্থা। কোনও কাজেই যেন মন বসাতে পারা যায় না। পেট চালানোর জন্যর চাকরিও করতে হচ্ছে আবার ফিল্মলাইনে সবাই যেন তাঁকে করুণার চোখে দেখছেন। যথাসময়ে ছবির কাজ শুরু হল। তারপর এক সময়ে কাজ সম্পূর্ণও হয়ে গেল। প্রস্ততি চলতে লাগল ছবি মুক্তির।
বড় বড় বিজ্ঞাপনে শ্লোগান ছাপা হতে লাগল— “সন্ধ্যায়রানির ভূমিকা অভিনয়ে সমৃদ্ধ”। অপয়া নায়কের নাম বিজ্ঞাপনে কেউ প্রকাশ করলেন না। এও এক চপেটাঘাত। মুক্তি পেল ‘সঞ্জিবনী’। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা তাদের সমালোচনাস্তম্ভে লিখলেন নিজেদের বক্তব্য। সমস্ত পত্রিকা তাঁর নামটা সযত্নে এড়িয়ে যেতেন। আনন্দবাজার পত্রিকা সৌভাগ্যবশত লিখল, “উত্তমকুমার স্থানে স্থানে অভিনয়ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন।”

মাত্র দুলাইনের খ্যাবতি উত্তমকে যেন মরুভূমিতে মরুদ্যােন দেখাল। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে মানুষ ছবি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। সুপার ফ্লপ হল ‘সঞ্জিবনী’। আসলে সংবাদপত্র পড়ে কেউ ছবি দেখতে যান না। মানুষ ছবি দেখেন নিজের চেতনার তুলাদণ্ডে। সেখানে কারও বলে দেওয়া কোনও কাজ করে না।
অন্য‍দিকে দর্শকের মনে লেগে গেলে কারও অনুপ্রেরণা ছাড়াই ছবি এগিয়ে চলবে। ‘সঞ্জিবনী’-র সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল প্লেয়ার কাস্টিং। প্রতিমা দেবীর গল্পের অভিনবত্বে সত্যি ই চমক ছিল। কিন্তু উত্তমের বয়স অনুযায়ী রোলটা ছিল চ্যা্লেঞ্জিং। একরাশ ব্যযর্থতাকে মূলধন করে রবি-র চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে উত্তম, পরবর্তী ‘অমানুষ’-র মতো অতো পরিণত ছিলেন না। তার ওপর খোলা মনে কাজও করতে পারেননি। যখনই ক্যায়মেরার সামনে আসছেন একরাশ টেনশন যেন উত্তমকে ভর করে আছে।
সুকুমারবাবু, উত্তমকে ঠিকই বাছাই করেছিলেন কিন্তু একটু যদি সহশিল্পীদের সমর্থন পেতেন এ ছবি ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র আগে ব্লকব্লাষ্টার হয়ে যেত। নায়িকা হিসাবে সন্ধ্যািরানি, উত্তমের পাশে যেন জোর করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। চোখেমুখে মাতৃসুলভ দিদি দিদি ভাব, আর মুখে হিরোইনের সংলাপ দর্শকের বদহজম হচ্ছিল। শৈলেন রায়ের কথায় অনুপম ঘটকের সুরসংযোজন, বেসিক ডিস্কের জন্যর ভালো লাগলেও পুরোপুরি ফিল্মি অভিব্য ক্তিতে ভরা হয়ে ওঠেনি, যা দর্শককে হলমুখী করবে।
আরও পড়ুন:

মনের আয়না: পরীক্ষার আগে হারাচ্ছে মনঃসংযোগ? কী করলে ফিরবে মনঃসংযোগ? জেনে নাও মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মতামত

গল্প: আলোকসংশ্লেষ

বম্বের রাজেন্দ্র কুমার, শাম্মি কাপুরের ছবি মানুষ যত না ভালো বেসেছেন ছবিগুলোতে রফির কালজয়ী মেলোডিপ্রসব, মানুষকে আঁস্তাকুড় থেকে টেনে এনে হলে বসিয়েছে। গুপী-র মুখে অনুপ ঘোষালকে মানিকবাবু এত সুচারুভাবে বয, বহার করেছিলেন মানুষ ভাবার সময়ই পাননি কতটা মিল কতটা অমিল।

দর্শককে শিল্পিত মায়াজালে বন্দী করার কৌশল জানা না থাকলে কপালে দুঃখ আছে। যা হাজার চেষ্টা করেও ‘সঞ্জিবনী’ ছবির নির্মাণকর্মীরা পেরে ওঠেননি। ফল পেয়েছিলেন হাতে-নাতে। উত্তমও তলিয়ে গেলেন অখ্যাততির অতল গহ্বরে।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content