সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


 

মুক্তির তারিখ: ১২/১১/১৯৫৪

প্রেক্ষাগৃহ : রূপবাণী, অরুণা ও ইন্দিরা

আবার সুচিত্রা। আবার হিট। আবার আবার। এ যেন সাগরের ঢেউ। একটার পর একটা।
‘গৃহ প্রবেশ’ উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেনের আরও একটি সাড়াজাগানো ছবি। হাসির ছবি। ‘গৃহ প্রবেশে’র দিন চাবি হারানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে গন্ডগোলের সূত্রপাত, মান-অভিমান, দুর্ভাবনা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে চরিত্রের টানাপোড়েন ছবিটির বিষয়। শেষ পর্যন্ত চাবি পাওয়া গেল গৃহকর্তার ট্যাকে।

সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে অসামান্য ছবি। আগেই বলেছি যে ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র আগে এবং ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র পরে দুটি যুগের একটা সীমারেখা তৈরি করে দিয়েছিল এ ছবি। আগেই বলেছি অগ্নিপরীক্ষা নিজে একটা সীমারেখা তৈরি করে দিয়েছিল উত্তম সুচিত্রার অগ্নিপরীক্ষার পূর্ববর্তী যুগের ছবির ও পরবর্তী যুগের ছবির মধ্যে। এমন নয় যে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ সুপারহিট হল আর সমস্ত প্রযোজক পরিচালক উত্তম সুচিত্রার পিছনে পড়ে গেলেন।
অন্যদিকে আর কোনও নায়িকার সঙ্গে ছবি তৈরি হচ্ছে না বিষয়টা কিন্তু তা নয়। একটা গোটা দশক জুড়ে উত্তমকুমার নামক একজন প্রতিশ্রুতিমান নায়ককে দিয়ে নানা নায়িকার সঙ্গে অভিনয়ের মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছিল। অর্থাৎ উত্তম কুমারকে গোটা দশ বছর জুড়ে একটা ভালো জমি তৈরির জন্য লড়াই করতে হয়েছিল এবং সুচিত্রা সেনের সঙ্গে যখন তার ছবি রিলিজ করত মানুষ শুধু কিন্তু উত্তমকুমারকে দেখতে যেতেন না।

সুচিত্রা সেনকে ও দেখতে যেতেন। সে সময়ে উত্তম কুমারের নায়িকা হিসেবে যে সমস্ত অন্যান্য নায়িকা মনোনয়ন পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে সুচিত্রা সেন কয়েক কদম এগিয়েছিলেন। এর সুবাদে সুচিত্রা সেনের নিজস্ব একটা জমিও কিন্তু তৈরি হয়েছে। ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’ এর মতো ছবি তৈরি হয়েছে উত্তম বিহনে।
আবার ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র বছরেই ‘বলয়গ্রাস’ নামে একটি আলাদা ছবি তৈরি হয়েছিল যেখানে উত্তম কুমার ছিলেন না। তাহলে রসায়নটা হল এই যে, উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেন দু’ জনেই নিজে নিজে ক্ষেত্রে। বেড়ে উঠছিলেন। যখন তাদের দু’ জনকে একসঙ্গে পাওয়া যেত
তখন তো একেবারে জোড়া ইলিশের মরসুম।

মানুষ সবচেয়ে আগে প্রাধান্য দিতেন পরিচালক কিভাবে ছবিটাকে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু উত্তম সুচিত্রা এসে প্রমাণ করলেন পরিচালকের উপস্থাপনা, অনেকটা নির্ভর করে নায়ক-নায়িকার উপর।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২২: স্বপ্নের সারথি পাঠিয়েছেন ‘বকুল’ ফুল

ছোটদের যত্নে: সুস্থ ও পরিপুষ্ট সন্তানের জন্য এগুলি মেনে চলছেন তো? সন্তানসম্ভবাদের জরুরি পরামর্শে শিশু বিশেষজ্ঞ

অনেক ছবি আছে যে ছবিগুলো পরিচালক সর্বস্ব। কৌশল করে পরিচালককে বলে দিতে হয় এটা অমুকের ছবি। সেসব ক্ষেত্রে পরিচালক নিজের স্বাতন্ত্র্য হারাতে প্রস্তুত নন। সত্যজিৎ বাবুর ক্ষেত্রে তো একথা বর্ণে বর্ণে সত্য। ওঁর সমস্ত ছবির হিরো কিন্তু সত্যজিৎবাবু নিজেই। আমরা আজও কিন্তু একটা ছবি দেখে বলি এটা সত্যজিৎ বাবুর ছবি।

কিন্তু উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন সেই সীমারেখাকে অতিক্রম করে দেখাতে পেরেছিলেন। আমরা বলি না এটা অগ্রদূত-র ছবি। এটাই চিত্র জগতের বড় প্রাপ্তি। ‘গৃহ প্রবেশ’ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন পরবর্তীকালের সাড়া জাগানো ‘উত্তম-সুচিত্রা’ ব্র্যান্ডের সাড়া জাগানো পরিচালক অজয় কর। যিনি ‘জিঘাংসা’ ছবি তৈরি করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন সে-ই সময় পরিচালনা কীভাবে করতে হয়।
আরও পড়ুন:

হেলদি ডায়েট: গাল জুড়ে এক রাশ ব্রণ? সমাধান লুকিয়ে আছে এ সবের মধ্যে, কী ভাবে কাজে লাগাবেন ঘরোয়া টোটকা?

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৩: বিমানবন্দর থেকে বেরিয়েই উইসকনসিনের সঙ্গে পার্থক্যটা টের পেলাম, মুহূর্তে ঠোঁট, গাল জমে যেতে লাগল

অবশ্য হাসির ছবি বললেই আমাদের চোখে সবচেয়ে আগে ভেসে উঠে সুচিত্রা-উত্তমের পাশে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ নামক শব্দ বন্ধটি। যেখানে সুচিত্রা- উত্তমের সঙ্গে সঙ্গে তুলসী চক্রবর্তী মলিনা দেবীর একটা সহাবস্থান। সকলের মনে জায়গা করে নেওয়া তুলসী চক্রবর্তী ও মলিনা দেবীর পাশে তাদেরকে নবাগত হিসাবে মানিয়েছিল ভালো। কিন্তু এবার আর সে ঘটনাটা ঘটল না পরিচালক অজয় কর স্বাদ বদল করার জন্য উত্তম-সুচিত্রাকে দিয়ে নতুন ধরনের একটা ছবি তৈরি করানোর পরিকল্পনা করলেন। মনে রাখতে হবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নামক তারকা সংগীত পরিচালক তখনও হাল ধরেননি। কারণ অজয় করের পরবর্তীকালে সমস্ত ছবিতে তরুণ মজুমদারের মত হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন।
এক্ষেত্রে মুকুল রায় নামক একজন অনামী অখ্যাত মানুষকে অজয়বাবু সুযোগ দিয়েছিলেন ছবিতে সংগীত পরিচালনা করার জন্য। তিনিও দায়িত্ব যথেষ্ট সচেতনতার সাথে পালন করেছিলেন। যে কারণে ছবিটা সেসময় মাঝারি মানের হিট হয়েছিল কারণ আগেই বলা হয়েছে অগ্নিপরীক্ষা মুক্তি পাবার পর তার রেশ কাটতে এক বছর সময় লেগে গিয়েছিল।

বম্বের সমস্ত মাখোমাখো হিন্দি ছবিকে মানুষ পিছনে ফেলে রেখে দর্শক ‘অগ্নিপরীক্ষা’-তে মন দিয়েছিল। এরও পরবর্তীকালে যতদিন না ‘শাপমোচন’ এসে আবার গানে গানে কাহিনী এবং অভিনয় সমস্ত ক্ষেত্রে মানুষের মন জয় করল ততদিন কিন্তু ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র রেশ মানুষের মনে রয়ে গিয়েছিল। ছবিটা চলেও ছিল অন্যান্য ছবিকে পিছনে ফেলে। এর পরের বছর উত্তম কুমার সুচিত্রা সেনের আবার ‘সাঁঝের প্রদীপ’ মুক্তি পাবে কিন্তু তখন আবার তাদেরকে লড়াইয়ের ময়দানে নামতে হবে নিজেদের ছবির সঙ্গে। অর্থাৎ ব্যবসায়িক দিক দিয়ে একটা ছবি কতটা সাফল্য পেল সেটার উপর সে ছবির কলাকুশলীদের ভাগ্য নির্ভর করত।
শুধু ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র সাফল্য দিয়ে কিন্তু সারা জীবন উত্তম সুচিত্রার চলে যেত না। তাই তাদেরকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও ভালো কাজের জন্য যাতে মানুষ তাদের মনে রাখেন ধারাবাহিক ভাবে। তার মানে এই নয় যে মাঝারি মানের ছবিতে তারা অভিনয় করবেন না।
সমস্ত ছবিতেই উত্তম কুমারের সেই বিশ্বমানের অভিনয় মানুষের মন কেড়েছিল। আগেই বলা হয়েছে যে উত্তম কুমার নামক তারকার অভিনয় কিম্বা একজন ডেডিকেটেড অ্যাকটরের অভিনয় প্রতিভা বুঝতে টলিউডের সময় লেগে গিয়েছিল।

যখন বুঝতে পারা গেল তখন তাকে ছাড়া কুড়ি বছর টলিউড এক পাও হাঁটতে পারেনি অর্থাৎ বৃত্তের প্রান্ত থেকে বৃত্তের কেন্দ্র পর্যন্ত একটা গোটা যাত্রাপথে একক নিঃসঙ্গভাবে নিজেকে তৈরি করার সমস্ত দায়িত্ব উত্তম কুমার পালন করেছিলেন।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৩: শোকস্তব্ধ অযোধ্যানগরী কি আপন করে নিল ভরতকে?

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৩: বাইরে ঘর, ঘরের মধ্যে ঘর

পাশাপাশি সুচিত্রা সেনও কোন অংশে কম যাননি। একই দশকে অরুন্ধতী দেবী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, কাবেরি বসু, সন্ধ্যারানি, মালা সিনহা প্রভৃতি নায়িকাদের সমারোহ ঘটলেও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের মনে জায়গা পেয়েছিল কিন্তু সুচিত্রা সেন।

কারণে তার সাফল্যের খতিয়ানটা অন্যদের থেকে অনেক বেশি। পরবর্তী বছরগুলিতে উত্তম সুচিত্রার যে রেটিং আমরা দেখব এবং সাফল্যের হার তাতে সারা জীবনে উত্তমবাবু এ সাফল্য বোধহয় কোন দশকে কোনও নায়িকার সঙ্গে আর পাননি।

গৃহপ্রবেশ ছবিটি কথা যদি আলাদা করে আলোচনা করতে হয় তাহলে সবচেয়ে আগে দাম দিতে হবে বিকাশ রায় মঞ্জু দে-কে। তারা উত্তম কুমারের সিনিয়র হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিলেন কিন্তু উত্তম বাবু যখন সকলের চেয়ে এগিয়ে থাকার প্রতিশ্রুতি সকলের থেকে আদায় করে নিয়েছিলেন তখন ওঁদের অভিনয়টা মাঠে মারা যায়নি।
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৩: পিতার অভিশাপ—জন্ম হল অষ্টাবক্র বালকের

স্বাদে-গন্ধে: মিষ্টি কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? বাড়িতে ঝটপট বানিয়ে ফেলুন জিভে জল আনা ক্ষীর মাধুরী

বিকাশ রায় এবং মঞ্জু দে সমান তালে তাল দিয়ে সহনায়ক এবং সহনায়িকার ভূমিকা পালন করেছিলেন। অন্যদিকে পাহাড়ি সান্যাল, জহর গাঙ্গুলী, তুলসী চক্রবর্তী ও মলিনা দেবী এঁদের তো কোনও তুলনাই ছিল না। তাঁদের অনেকদিন পর কোথায় যেন একটা আশ্রয় পেয়েছিলেন প্রাণ খুলে অভিনয় করেছিলেন। ফল হল হাতেনাতে ছবি হিট।

আর কিছুদিনের মধ্যে ‘শাপমোচন’ মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই ‘সাঁঝের প্রদীপ’, ‘গৃহপ্রবেশ’ ‘মরনের পরে’, ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’, ‘সদানন্দের মেলা’ এ ছবিগুলো একটু পিছিয়ে পড়ে। কিন্তু আমরা লক্ষ্য রেখেছি যে দুটি সুপার-ডুপারের ছবির মাঝে সেতুর মতো এই ছবিগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যেখানে উত্তমবাবু বা সুচিত্রা সেন চরিত্র অভিনেতাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখে নেয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।—চলবে

ছবি: সংগৃহীত।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content