শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


মহামতি ডিরোজিও সাহেব।

শহরের সাহেবিয়ানার রাস্তাটা যেখানে আনমনেই বাঁকবদল করেছে লাচ্ছা সিমুই আর বিস্তারিত মেওয়া, খুশবুদার উমদা ফলফুলুরির দোকান বেয়ে মল্লিকবাজারের দিকে ঠিক সেই আড়াআড়ি এক বসতখানা—ইতিহাসশ্যাওলা তুচ্ছ করে সেখানে সার সার ঘুমিয়ে আছে স্মৃতির পাতারা। জীবনের থোড়-বড়ি-খাড়ার চলগামিতা টপকে একটিবার যদি কোনও এক অছিলায় ঢুকে পড়া যায় সে উঠোনটাতে, তবে ফিরতি পথ ধরতে কিছু না হলেও ঘণ্টাখানেক ছলকে যাবেই যেকোনও হিসেবি তালু ফসকে, একেবারে একশো শতাংশের দিব্যি!

হ্যাঁ, নাম একটা আছে বইকি তার, গাড়িতে চেপে গড়িয়ে যেতে যেতে বা কেজো হাঁটাহাঁটির সময় চোখের কোণ চলকে কতবার সে নামফলক পেরিয়েও যাই আমরা—’সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রি’।
অথচ, কল্লোলিনী তিলোত্তমার ব্যস্ততম বুকের ভিতরেই এরকম একটা আস্ত ফিসফিসানির রাজ্যপাট পড়ে আছে— দেখা হয় ক’জনের?

মহামতি ডিরোজিও সাহেবের মর্মরমূর্তি গাঁথা সমাধিস্থল কিংবা এশিয়াটিক সোসাইটির সৌজন্যে স্যর উইলিয়াম জোনসের সমাধিসৌধটি বৎসরান্তে কেজো মালা-ফুলে সাজে হয়তো বা, কিন্তু সকৃতজ্ঞ সশ্রদ্ধ প্রণামে ভালোবাসায় তাদের ছুঁতে যাই কতজন আর?

চিহ তব পড়ে আছে, তুমি হেথা নাই।

কতজন ওই অনতিদূরের মল্লিকবাজার এলসি রোডের সমাধিস্থলের পরে একবার অন্তত এ পথে আসি? ‘অল সোলস ডে’-তেও স্মরণদীপের আলোর অভাব মেখে আঁধারে পড়ে থাকে এই স্মরণসভাটি…

থাক তবু এই তাত্ত্বিক কচকচি, বরং এবারের উসুমকুসুম শীতে, দেশকাল উজান বেয়ে ঘর থেকে বেশি দূরে নয়— শহর কলকাতাকেই অন্যভাবে খুঁজে পাই আমরা। হ্যাঁ তো, কলকাতার বাইরের শহরতলিরাও এখানে বাস, অটো, মেট্রো ইত্যাদি যে কোনও যানে চটজলদি পৌঁছাতেই পারে—পার্ক স্ট্রিট যে!

ইতিহাস যারা ভালোবাসে আর যারা ভয় বাসে—সব্বাইকে আলতো হাতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় এ ভুবন। প্রবেশপথে কুড়িটি টাকা দিয়ে দুই ঘণ্টা সময় কিনে ভেতরে ঢুকে পড়লেই সেই অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনটি বিলকুল মালুম পড়ে। একটু স্যাঁতসেঁতে আর উমনোঝুমনো গাছে ঢাকা ইটেবাঁধাই সরণিরা দুইপাশে গম্বুজ আকৃতির সাতবাসি সব ঘরবাড়ি এগিয়ে নিয়ে চলেছে। সেসব ঘরেরা তাদের কোলের মধ্যে শুইয়ে রেখেছে কত যে গপ্পোজমিন কী বলি! ১৮০৩ সালের এগারো মাসের এক শিশুকন্যার সঙ্গে যোগাযোগ হতে জানি যে, জীবন তাকে ছাড়তে চায় না আজও, কিন্তু সে ‘departed this life’!
কী আশ্চর্য আর আশ্চর্য এই জীবনান্ত জীবন্ত বৈরাগ্য, আহা! চোখ ফিরতেই ফের ভিজে ওঠা তিন দিন, আট দিন, বছরখানেকের ‘beloved son’-দের এমন অজস্র অকালমৃত্যুর স্রোতে। চব্বিশ-ছাব্বিশের কত তরুণীর অকালঘুম লেখা এমনই কতশত ফলকে। এঁরা আমাদের এ মাটির নন। রাজদণ্ডধারী বণিকের ছদ্মবেশী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তথাকথিত ‘রাজপুরুষ’দের জায়া-পুত্র-পরিবার। তাঁদের ছেড়ে আসা স্বদেশের জলবায়ু-ভাষা-সহজ স্বাচ্ছন্দ্যময় যাপনের অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে হয়তো বাধ্যতামূলক যাত্রার অভিঘাতে এ তাঁদের অপমৃত্যুই!

জানিই না—,বোবা ইতিহাস কোনও কথা বলতে পারে না যে, তবু একের পর এক অকালমৃত্যুর সৌধের সামনে দাঁড়িয়ে হাহারবের স্পষ্ট স্বর কানে বাজেই। এইখানেই মনে হয়, দক্ষিণ পার্ক স্ট্রিটের এই সমাধিস্থল কেবল সমাধিই নয়, বরং সেকাল থেকে একালের এক অমোঘ গাঁটছড়া, যেখানে গেলে অবধারিত মনে পড়বেই জীবনানন্দীয় উচ্চারণ—
‘জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু।
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ’লে যেতে হয়
কি কাজ করেছি আর কি কথা ভেবেছি…’

স্মৃতির খেয়া।

চোখে পড়ে গঙ্গায় তলিয়ে যাওয়া যুদ্ধবাজ পিতার প্রতি তাঁর ‘affectionate son’-এর উৎকীর্ণ মন কেমন। মনে ধরে ছাব্বিশ বছরের ‘ক্যাপ্টেন’-এর প্রতি তাঁর ‘brother officers’দের আমর্ম বিনতি।
এঁরা সবাই দুশো বছর ধরে এই দেশটাকে চেটেপুটে খেতে এসেছিলেন যে, ইতিহাসের সেই ক্ষোভক্ষতে কখন যেন নুনমরিচের বদলে করুণাকণা ঝরতে থাকে—
বিবেচনা ফুরসত পায় না এমন ‘মানুষীমন’ নিন্দনীয় কি না, সে বিচারে!

আশপাশের জীবন অহরহ ডাক পাঠায় ধাতব কর্মচঞ্চলতায়, যানবাহনের বিচিত্রতর শব্দপ্রবাহে, তবু পাখি আর কাঠবিড়ালির মানবেতর ভালোবাসার বন্ধনডোর এড়িয়ে, ঝিলিমিলি ছায়াতরুর মায়াশাসন ফুরিয়ে কোনও একটি পাষাণেরও অহল্যাঘুম ভাঙে না যে!

কফিনের চিরচেনা আদলের পাশাপাশিই মুঘল স্থাপত্যের গোলালো গম্বুজ আর পাশ্চাত্যের খিলানওয়ালা গঠনের সমাধি দেখতে দেখতে চোখ খুঁজে চলে মহামতি ডিরোজিও সাহেবের চিরঘুমের আয়োজন স্থলটি, আর তখনই চোখ মন চমকে থামে এক বিরলদৃশ্য সমাধিমন্দির দেখে।
আক্ষরিক অর্থেই ‘মন্দির’ বটে!

ছোট্ট এক চৌকোনা ঘর, তার চুড়োর দিকটা অবিকল মন্দিরময় ওড়িশা বা দাক্ষিণাত্যের মন্দিরের গোপুরমের মতোই। কৌতূহলী চোখ উঁকি মেরে থমকে থামে—হিন্দু স্টুয়ার্ট—এক মেজরের সমাধিতে। জন্মসূত্রে আইরিশ এই ব্রিটিশ মেজর জেনারেল এ দেশের এক বিশেষ ধর্মের সংস্কৃতি আপন করেছিলেন। মর্মগতভাবে হয়েছিলেন ভারতীয় একদা। তাই বলতেই হয়, মানুষের সভ্যতার দেশকালহীনতার মর্যাদামন্দির এই দুশো বছরের পুরোনো সমাধিতে ‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব’—মনুষ্যকুলে!

সমাধি 'মন্দির' —হিন্দু স্টুয়ার্ট।

সব পথ এসে মিলে যাবেই শেষমেশ সেই একতম অভীষ্টে—এ দেশের নবজাগরণের অন্যতম অগ্রদূত হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর সমাধিতে। প্রণতচিত্ত একমুহূর্তে ছুঁতে চাইবে ইতিহাস—এই সেই কবি, বিরলতম শিক্ষাবিদ, অষ্টাদশীয় ইয়ংবেঙ্গলের প্রাণপুরুষ—‘Friend of his people’!!

কে বলে ইতিহাস মূক?
ফেরার পথে অজস্র পুষ্পেপর্ণে ঝিকিয়ে ওঠে অশ্রুতশ্রুতিময় ভাষ্য, দেখার অতীত দর্শন তীব্রতর হয়ে বলে—
‘তাই যা দেখিছ তারে ঘিরেছে নিবিড়
যাহা দেখিছ না তারি ভিড়।
তাই আজি দক্ষিণ পবনে
ফাল্গুনের ফুলগন্ধে ভরিয়া উঠিছে বনে বনে
ব্যাপ্ত ব্যাকুলতা,
বহুশত জনমের চোখে-চোখে কানে-কানে কথা…’

অতএব, চুপি চুপি বলে আসতেই হবে,—
‘আজ আসি?
আবার…’!!!

ছবি ও ভিডিও ক্লিপ : লেখিকা

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম : এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে বেশ কিছু ছবি ও ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ পাঠাতে হবে। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না।
ইমেল : samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content