তোদে।
উত্তরবঙ্গে তো কতবার গেলাম। একবার তো ভিস্তা ডোমে চেপে কোথাও যাব। তাই নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ভিস্তা ডোমে চড়লাম। শেষ পর্যন্ত যাব। আলিপুরদুয়ার। ট্রেনের শেষ কোচ এর শেষ অংশটি আক্ষরিক অর্থে ভিস্তা ডোম। পিছনে ফেলে আসা রেলপথ দেখতে দেখতে যাওয়া। পাহাড় জঙ্গল নদী। তার সঙ্গে ব্রিজ। ভিতরে ধরে দাঁড়ানোর স্টিলের রেলিং আছে। পুরো যেন রেলগাড়ির সঙ্গে আমরাও ছুটছি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। অন্য ট্রেনে জানালা দিয়ে যত টুকু দেখা যায়। আর এখানে পুরোটাই ট্রেনের সঙ্গে দৌড়নো। এক অন্য রকম অনুভূতি।
আমরা খুব কম সময়ই ভিতরে কোচে নিজেদের আসনে বসেছি। মালগাড়ির শেষে যেমন খোলা জায়গা থাকে এও তেমনই জায়গা। শুধু চারপাশে মোটা স্বচ্ছ কাঁচের আবরণ। খুব মজা হল। এমনভাবে কোনওদিন ফেলে আসা রেলপথ দেখতে পাইনি। ট্রেন পাহাড় জঙ্গলের মাঝে স্টেশনগুলোতে অনেক্ষণ ধরে থেমে থেমে গেল। আমরাও সেই ফাঁকে প্ল্যাটফর্মে নেমে ঘোরাঘুরি করে নিলাম। রোজকার কর্মজীবনের দৌড়নো নেই। তাই আলিপুরদুয়ার পৌঁছতে একটু বেশি সময় লাগলেও মন আমাদের ফুরফুরে। কোনও তাড়া নেই।
আরও পড়ুন:
পরিযায়ী মন, পর্ব-৬: বৈতরণীর পারে…
যত মত, তত পথ, পর্ব-৫: ঈশ্বরের আনন্দ ও সংসার—শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ
আমরা প্রথমে যাব শিকিয়াঝোরা। বাংলার অ্যামাজন। চা বাগানে ঘেরা হোটেল। দুপুরের খাবার খেয়েই গেলাম আমাজন সাফারি। একটা পানা ভর্তি জলাশয়। ছোটছোট নৌকো। কোন জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে বোঝা যাচ্ছে না। আমরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর নৌকো এলো। যাত্রীসমেত। তারা নামলে আমরা উঠলাম। কচুরিপানার জঙ্গল ছেড়ে গভীর জঙ্গলে ঢুকলো নৌকো। দু’ ধারে ঘন জঙ্গল। বড় বড় গাছের ডালপালা জলের ওপর প্রায় ঝুঁকে পরেছে। রীতিমতো ভয় করছিল। যে কোনও বন্য জন্তু জঙ্গল থেকে লাফিয়ে পরতে পারে। জঙ্গলের ভিতর নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। কিছু অত্যুৎসাহী যাত্রী পড়ন্ত রোদের পরও আরও ভিতরে যেতে চাইছিল। মাঝিরা বারণ করল। আমারও ভয় করছিল। যাই হোক, অতি অ্যাডভেঞ্চারে ইচ্ছুকদের নিরাশ করে আমরা অ্যামাজনের যাত্রা শেষ করলাম পানাভরা উৎসমুখে এসে।
চা বাগান।জলদাপাড়া।
পরদিন গেলাম জলদাপাড়া। জঙ্গলের ভিতরে নয়। বাইরে। চা বাগানের মধ্যে থাকা। চারদিকে যতদূর চোখ যায় সবুজ সমুদ্র। মাঝখানদিয়ে সরু সিঁথির মত মাটির রাস্তা। এ সমুদ্রের জলে ভেসে যাবার ভয় নেই। তাই ফাঁকে ফোকরে ঢুকে হুটোপুটি করলাম। এখানে একদিন থেকে যাব তোদে। এ জায়গাটার কথা আগে বিশেষ শুনিনি। ছবি দেখেই আকুল হয়েছিলাম যাবার জন্য। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ছিল। নইলে শুধু তোদে যেতে মালবাজার স্টেশনে নামতে হয়। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে গাড়ি চলল। রাস্তা বেশ ভালোই ছিল। কিন্তু শেষের দিকে সেটি আর রাস্তা রইল না। পুরো উঁচু নিচু কাঁচা পাহাড়ি পথ। নৌকোর মতো ওঠানামা করতে করতে যাওয়া। ঝাঁকুনিতে কোমরের জন্য চিন্তা হতে লাগলো…আর কতক্ষণ, কতক্ষণ এমন। এক জায়গায় দেখলাম রাস্তা তৈরি হচ্ছে। আশাকরি, এতদিনে হয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন:
কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৬: অ্যালেন, দেখলেন, খেলেন
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৪: সুন্দরবনের মৎস্যদেবতা মাকাল
যাইহোক, প্রায় তিন চার কিলোমিটারের পর গন্তব্যস্থানে পৌঁছনো গেল। এ যে স্বর্গীয় জায়গা। চারদিকে পাহাড়ের পাঁচিলের মাঝে এমন সুন্দর থাকার জায়গা? মনপ্রাণ ভরে গেল। থাকার জায়গা বলতে বড় বড় পাথরের ওপর তাঁবু। পাশ দিয়ে অনবরত নদীর জলের পাথরে লাফিয়ে চলার মূর্ছনা। তাঁবুর ভিতর ঢুকে অবাক। অত্যাধুনিক সব আরামের ব্যবস্থা। সামনের চেন দেওয়া মস্ত জানালা খুলে দিলে পুরো প্রকৃতির কোল পাতা। জানালার কাছে সুন্দর দুটি বেতের চেয়ার। সারাদিন বসে চোখ ভরে দেখলেও আশ মেটে না। দেখা ও নদীর কলতান শোনা। সেই গানের লাইন মনে আসছিল ঘুরে ঘুরে “এর বেশি কি চাওয়ার থাকে এর বেশি কে পায়”।
আরও পড়ুন:
পাখি সব করে রব, পর্ব-৪: অরুণাচলের সেলা পাসে বরফ পড়তেই ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এল গ্র্যান্ডেলা পাখি
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৫: আর যাহা খায় লোকে স্বদেশে ও বিদেশে / খুঁজে পেতে আনি খেতে-নয় বড় সিধে সে!…
এ জায়গাটি ভুটান বর্ডার। পৃথিবী তো একটা। আমরা তাকে ভাগাভাগি করে নিয়েছি। ছোট্ট নদীর ওধারের পাহাড়টাই নাকি ভুটান। কতগুলো পাহাড়। কোনটা ভুটান, কোনটা আমাদের এসব ওখানে গিয়ে হিসেব রাখা মুশকিল। আর দরকারই বা কি। ছোট্ট নড়বড়ে ব্রিজ দিয়ে দিব্যি ওপারে ঘুরে এলাম। সব পাহাড়ই আমার। একজায়গায় পাহাড়ে ঘেরা টলটলে স্বচ্ছ জলে কতজন সাঁতার কাটছে। এত স্বচ্ছ জল যে, জলের নীচে সাঁতারুকে সুন্দর দেখা যাচ্ছে। আমরা একটা মনাস্টারিতে গেলাম। জনমানবহীন পাহাড়ের ওপরে মনাস্টারি। ছোট্ট ছোট্ট বাচ্ছারাও আছে। কীভাবে ওখানে সব কাজকর্ম চলে বলছিলেন ওখানকার এক কর্মকর্তা। জিনিস পত্রের প্রাচুর্য নেই। আছে প্রাণ প্রাচুর্য। আমরা শহরে এসেই নেই রাজ্যের নৈরাজ্যে মন খারাপ করি। এদের বোধকরি তেমন প্রত্যাশা নেই। তাই প্রাণশক্তিতে পরিপূর্ণ। প্রকৃতির সঙ্গে জড়াজড়ি করে বহমান জীবন।
তাঁবু থেকে বেরিয়ে বড় বড় পাথরের ওপর গার্ডেন আমব্রেলা দিয়ে বসার জায়গা। সেখানে প্রবল ঠান্ডায় সূর্যের উষ্ণতা মেখে চা খাওয়া যায়। পাশে নদীর সঙ্গীত। রাতে পাথরের চাতালে বারবিকিউ হল। আমরা আগুনের চারপাশে বসে গান, গল্পে শীতের রাতের ঠান্ডায় উষ্ণতার আমেজ নিলাম। ওপরে তারার কুচিতে ঝিকমিকে খোলা আকাশের চাঁদোয়া।
তোদেতে আমরা দু’ দিন ছিলাম। প্রতিটি মুহূর্ত সযত্নে মনে তুলে রেখেছি। কিছুদিন বাদে বাদে কোথাও যাওয়ার কথা ভাবলেই মনে হয় তোদে চলে যাই। প্রকৃতির কোলে পরম প্রশান্তির দেশে।
তোদেতে আমরা দু’ দিন ছিলাম। প্রতিটি মুহূর্ত সযত্নে মনে তুলে রেখেছি। কিছুদিন বাদে বাদে কোথাও যাওয়ার কথা ভাবলেই মনে হয় তোদে চলে যাই। প্রকৃতির কোলে পরম প্রশান্তির দেশে।
* পরিযায়ী মন (Travelholic): ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।