পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে সাসারামের কথা বড় একটা শোনা যায় না। শের শাহের নামের সঙ্গেই ইতিহাসে শহরটিকে স্মরণীয় করে রেখেছে। পাহাড় ঘেরা এই শহরটিকে প্রকৃতি অকৃপণ ভাবে সাজিয়ে রেখেছে নদী, ঝর্ণা ও জলধারায়। না গেলে বিশ্বাস হত না। স্টেশন ঢোকার আগেই মস্ত সোন নদী। ছেলেবেলায় ভূগোলে পড়েছিলাম দৈর্ঘ্যের জন্য বিখ্যাত সোন নদীর ব্রিজ। সাসারাম পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠেনি বলে এখানে পর্যটকদের জন্য সরকারি কোনও আবাস নেই। গিয়ে হোটেল খুঁজে নিতে হল। স্টেশন এর আশেপাশে বেশ কিছু হোটেল আছে। ট্রেনে রাতে উঠে সক্কালবেলা পৌঁছে যাওয়া যায় সাসারাম। তাই সময় নষ্ট না করে সকালের খাবার খেয়েই বেরিয়ে পরলাম।
শহর ছাড়িয়ে অনেকটা পথ। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে লাল কাঁকর মাটির রাস্তা। মাথার ওপর ভাদ্রমাসের সূর্যের তাপ। জঙ্গলে বড় গাছ বেশি নেই। রাস্তা ও খুব ভালো নয়। তিনটে কুণ্ড আছে। একটু পর পরই। সীতা কুণ্ড, মাঝের কুণ্ড ও ধুঁয়াকুণ্ড। পাথরের ফাঁটল দিয়ে প্রবলবেগে জলধারা বয়ে চলেছে। কোথাও নিচে জমে কুণ্ড তৈরি হচ্ছে। ধুঁয়া কুণ্ডতেই জল অনেক উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়ছে। অন্য দুটিতে মোটামুটি সমতলে। পাথরের ফাঁটল দিয়ে। তিনদিকে পাহাড়ের দেওয়াল। খুবই সুন্দর। কিন্তু ভাদ্রমাসের দুপুরে, বিহারের গরম। বেশিক্ষণ বাইরে থেকে উপভোগ করার জো নেই।
আরও পড়ুন:
পরিযায়ী মন, পর্ব-৮: চোখিধানির জগৎখানি
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৭: অ্যাঁ, বলো কী নন্দলাল…!
এরপর গেলাম শের শাহের সমাধি দেখতে। কোথায় যেন দেখেছিলাম একে ভারতের তৃতীয় তাজমহল বলে। খুব একটা অত্যুক্তি হবে না বললে। একটি কৃত্রিম হ্রদের মাঝখানে এক মস্ত স্থাপত্য। ইন্ডো ইসলামিক ধাঁচে। ঢোকার গেটটি এবং একটি সমাধি। শুনলাম সেটি শের শাহের সেনাপতির। মৃত্যুতে ও দ্বার আগলে রেখেছেন। সেটি পেরিয়ে হ্রদের মধ্য দিয়ে বাঁধানো রাস্তা। দু’পাশে বাহারি গাছ। সৌধটি তাজমহলের কথাই মনে করায়। যদিও শ্বেত পাথরের নয়। চারদিকে চারটি ছোট ছোট মিনার। ভিতরে অনেকগুলো সমাধি। পরিবারের লোকেদের। মাঝখানেরটি শের শাহের। সমাধির ঘরটি মস্ত বড়। বাইরেও মস্ত বাঁধানো চত্বর। সেখান থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে হ্রদের ধারে যাওয়া যায়। আবার ওপারে ও চমৎকার সবুজ লন হ্রদটি ঘিরে। এছাড়া বাহারি ফুলগাছ ও আছে।বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।শোনা যায় এটি শের শাহ নিজেই বানিয়েছিলেন। সম্পূর্ণ হওয়ার তিন মাস আগে হঠাৎই মারা যান। সাসারামের মূল পর্যটক আকর্ষণ কেন্দ্র এই সমাধিমন্দির।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৯: অনেক যতনে ‘বড়দিদি’-র পর্ব রাখিনু সেথা
যত মত, তত পথ, পর্ব-৭: ঈশ্বরে মনে রেখে সংসার ধর্ম—শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ
পরদিন গেলাম কর্কটগড়। এখানে প্রতিটি দর্শনীয় স্থানই অনেকটা করে পথ। বেশিরভাগটাই জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। মস্ত সংরক্ষিত ঘেরা বাগানের মধ্য দিয়ে হেঁটে এক চমৎকার ঝর্ণা। জলধারা পাথরের ফাঁক ফোকর দিয়ে জড়ো হয়ে লাফিয়ে পরছে নীচে। একদিকে পাহাড়। জানলাম সেদিকটা উত্তরপ্রদেশ। তাহলে এ ঝর্ণাটি বিহার ও উত্তরপ্রদেশের প্রান্তসীমা। রেলিং ঘেরা বাগান থেকে দেখলাম। ভরা বর্ষায় সব ঝর্ণাই পরিপূর্ণ রূপসী। তবে এ রূপ দেখতে গরমে আমরা নাজেহাল। বর্ষা ছাড়া আবার ঝর্নাকে এত পরিপূর্ণ ভাবে দেখা যায় না। এসব সান্ত্বনা দিয়ে প্রখর রোদ্দুর কে সয়ে নিলাম। এরপরে দেখলাম তিলহারকুণ্ড। সেটি ও ঝর্ণা। রাস্তার দু’পাশে অপূর্ব কাশফুলের বাহার। সবুজ পাহাড়ের সামনে সাদা কাশফুলের বন্যা।
ঝর্ণা ছাড়া দেখলাম বাঁধ। তিনদিকে পাহাড় ঘেরা নদীকে বাঁধ দেয়া হয়েছে। নদীর মাঝে মাঝে চড়াতে অপূর্ব সাদা কাশফুল ভরে আছে। সাদা সবুজের অপরূপ সমারোহ। চোখ ফেরানো যায় না। আরেকটি বাঁধে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখলাম। সেখানে তিন দিকেই পাহাড়। পাহাড়গুলোর গা যেন দক্ষিণভারতের মন্দির। ওপরের দিকে প্রায় অর্ধেক পাহাড়ই নিরাবরন। শুধু পাথর দেখা যায়। খাঁজকাটা। পাথরের গায়ে নানা কারুকাজ করা। নিচের দিকটায় খানিকটা সবুজ গাছ গাছালি। সূর্যাস্তের আলো বাঁধের জলে, চড়ার কাশফুলে দিল লাল আভা ছড়িয়ে। সন্ধে নামতে ফিরে এলাম।
আরও পড়ুন:
কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৮: পার্ক, ইট, এঞ্জয়
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪০: ব্রণ হয়েছে? তার মানেই কি লিভার খারাপ?
ফেরার দিন রাতে ট্রেন। তাই সারাদিন আছে হাতে।সকালে গেলাম তুতলা ভবানী গড়। নাম শুনে ভাবলাম মন্দির ও দুর্গ হবে। কিন্তু এ ও ঝর্ণা। সাসারামে যতগুলো ঝর্ণা দেখেছি সবচেয়ে সেরার শিরোপা দিই এ ঝর্ণাটিকে। দূর থেকে দেখছি পাহাড়ের ওপর থেকে লাফিয়ে পরছে জল। সামনে দেখলাম একটি দড়ির ঝুলন্ত ব্রিজ। সেটি নিয়ে গিয়েছে একদম ঝর্ণার পাস দিয়ে পাহাড়ের গায়ে মন্দিরে। ব্রিজ টির গেট এ তালা দেওয়া। সকাল সাড়ে ন’ টায় খুলল। কাঠের পাটাতন ফেলা দড়ির ব্রিজ। হাঁটলে নড়েচড়ে ওঠে। প্রচুর বাঁদরের উপদ্রব। ব্রিজে বিভিন্ন দিক থেকে ঝর্ণাকে দেখা যায়।
একজায়গায় দাঁড়িয়ে আর চোখ ফেরাতে পারলাম না। সূর্যের আলো ঝর্ণার জলে ক্রমাগত রামধনু এঁকে চলেছে। এ অদ্ভুত দৃশ্য আগে কোনও ঝর্ণাতে দেখিনি। জলে সাত রঙের খেলা। এ দৃশ্য কোনও ক্যামেরায় বন্দি করা যাবে না। প্রাণ ভরে দেখলাম প্রকৃতির এ অপূর্ব বাহার। চোখ বন্ধ করে এখনও দেখতে পাই। পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট মন্দির। সিঁড়ি দিয়ে উঠে পুজো দিচ্ছে সবাই। কিন্তু বাঁদরের উৎপাতে অস্থির সেখানে।
একজায়গায় দাঁড়িয়ে আর চোখ ফেরাতে পারলাম না। সূর্যের আলো ঝর্ণার জলে ক্রমাগত রামধনু এঁকে চলেছে। এ অদ্ভুত দৃশ্য আগে কোনও ঝর্ণাতে দেখিনি। জলে সাত রঙের খেলা। এ দৃশ্য কোনও ক্যামেরায় বন্দি করা যাবে না। প্রাণ ভরে দেখলাম প্রকৃতির এ অপূর্ব বাহার। চোখ বন্ধ করে এখনও দেখতে পাই। পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট মন্দির। সিঁড়ি দিয়ে উঠে পুজো দিচ্ছে সবাই। কিন্তু বাঁদরের উৎপাতে অস্থির সেখানে।
এ বারে যাব রোহতাসগর দুর্গ। এর ইতিহাস সুপ্রাচীন। বলা হয় রাজা হরিশচন্দ্রের ছেলে রোহিতাশ্ব এটি নির্মাণ করেন। বিভিন্ন রাজা, শশাঙ্ক থেকে শুরু করে শের শাহ এবং পরবর্তীতে আরও অনেকে এর অধিকার নিয়েছিলেন। শোনা যায় শের শাহ চুনার দুর্গ হারিয়ে পরিবারের মহিলা ও শিশুদের এখানে নিরাপদে রেখে আবার যুদ্ধে যান। এটি রোহতাস জেলায়। দুর্গে যাবার আগে প্রায় তেত্রিশ কিলোমিটার পথ কোনও পাকা রাস্তা নেই। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এবরো খেবরো পথ। তাকে পথ না বলাই ভালো। প্রতি মুহূর্তে ভয় লাগছিল। দেহের সব হাড়গোড় বুঝি একত্র হয়ে গেল। গাড়ি যে আমাদের গন্তব্যে নিয়ে যেতে পেরেছে তাই যথেষ্ট। সাড়ে তিন ঘণ্টা লাগলো সেই পথ পেরোতে। অবশেষে দুর্গের দেখা মিলল।
বিশাল এক সুরক্ষিত প্রাসাদ। কিন্তু কোনও রক্ষণাবেক্ষণ নেই। চমৎকার টানা বারান্দা। খিলান দেওয়া। ওপরে ছাদের চার কোণায় চারটি স্তম্ভের ওপর গম্বুজাকৃতি মিনার। আমরা সিড়ি দিয়ে ছাদে উঠলাম। কি অপূর্ব দৃশ্য ওপর থেকে। যতদূর চোখ যায় শুধু, জঙ্গল। দূরে এক নদী। নীচে নেমে এলাম। ভিতর দিয়ে দিয়ে অনেক মহল। একটা পেরিয়ে আরেকটা। কেউ নেই বলে দেবার। অনুমান করা যায়, কোনটা মহিলাদের, কোনটা রক্ষীদের। কোথাও বা রাজার দরবার হয়তো। কালের গর্ভে এখন সব বিলীন। পৌঁছনোর পথের আতঙ্ক আমাদের তাড়না করছিল। বেশিক্ষণ মোহিত হয়ে থাকার উপায় নেই। সেই পথ পেরিয়ে ফিরতে হবে। ফিরে রাতের ট্রেন এ চাপলাম। সাসারাম এ কত কি তো দেখলাম। মনের মাঝে শাশ্বত হয়ে রইল ঝর্ণার জলে সূর্যের আঁকা রামধনু।
ছবি: লেখিকা
বিশাল এক সুরক্ষিত প্রাসাদ। কিন্তু কোনও রক্ষণাবেক্ষণ নেই। চমৎকার টানা বারান্দা। খিলান দেওয়া। ওপরে ছাদের চার কোণায় চারটি স্তম্ভের ওপর গম্বুজাকৃতি মিনার। আমরা সিড়ি দিয়ে ছাদে উঠলাম। কি অপূর্ব দৃশ্য ওপর থেকে। যতদূর চোখ যায় শুধু, জঙ্গল। দূরে এক নদী। নীচে নেমে এলাম। ভিতর দিয়ে দিয়ে অনেক মহল। একটা পেরিয়ে আরেকটা। কেউ নেই বলে দেবার। অনুমান করা যায়, কোনটা মহিলাদের, কোনটা রক্ষীদের। কোথাও বা রাজার দরবার হয়তো। কালের গর্ভে এখন সব বিলীন। পৌঁছনোর পথের আতঙ্ক আমাদের তাড়না করছিল। বেশিক্ষণ মোহিত হয়ে থাকার উপায় নেই। সেই পথ পেরিয়ে ফিরতে হবে। ফিরে রাতের ট্রেন এ চাপলাম। সাসারাম এ কত কি তো দেখলাম। মনের মাঝে শাশ্বত হয়ে রইল ঝর্ণার জলে সূর্যের আঁকা রামধনু।
ছবি: লেখিকা
* পরিযায়ী মন (Travelholic): ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।