বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


জয়পুরের প্রাসাদ কেল্লা এ সব তো পর্যটকদের দর্শনীয়। কিন্তু এক অন্য রাজস্থান আবিষ্কার করতে গেলে যেতে হবে চোখিধানি। লোকমুখে শুনে বলতাম চৌকিদানি। ইংরেজি হরফে উচ্চারণে হয় চোখিধানি। শুনলাম এর মানে সুন্দর ছোট গ্রাম। আমরা দ্বিতীয় বার জয়পুর গেলাম চোখি ধানি দেখার জন্যই। শহরের প্রান্তে অনেকটা জায়গা নিয়ে, এককথায় বলতে গেলে হেরিটেজ ভিলেজ।
আমরা সন্ধেবেলা পৌঁছে গেলাম চোখিধানির দরজায়। মস্ত দরজা। দুর্গের গেটের মতো। প্রাচীন দিনের মতো পাগড়ি পরে বল্লম হাতে দুই প্রহরী। ঢুকে বাঁ হাতে এক মাটির দেয়াল। সেখানে অনেকগুলো কুলুঙ্গিতে জ্বলছে প্রদীপ। ডানদিকে একটি ছোট ঘরের সামনের রোয়াকে বসে সানাই বাজাচ্ছেন দুই বাজনদার। ট্রাডিশনাল রাজস্থানী পোশাকে। আমাদের চন্দনের টিপ পরিয়ে স্বাগত জানালো সুসজ্জিতা রাজস্থানী দুটি মেয়ে। ভিতরে ঢুকে দেখি এক অন্য রাজ্য। যেন অনেক বছর আগে রাজস্থানের এক প্রত্যন্ত গ্রামে এসেছি। ছোট ছোট গোল গোল ছাউনি দেয়া চারপাশ খোলা চত্বর।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-৭: ভিস্তা ডোমে তিস্তার দেশে

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৫: সুন্দরবনের বিসূচিকা রোগের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ওলাবিবি

এক এক জায়গায় এক এক অনুষ্ঠান চলছে। ধারে বাজনদার বসেছে। মাঝখানে জমকালো রাজস্থানী পোশাকে নাচ গান হচ্ছে। মাথায় সুদৃশ্য কলসির ওপর কলসি বসিয়ে ব্যালান্স এর নাচ। সামনে কাচের টুকরো ফেলে তার ওপর নাচ। মুখে জ্বলন্ত কাঠের অপর প্রান্ত ধরে নাচ। নানারকম কসরতের নাচ। আবার দর্শকদের ও আমন্ত্রণ জানাচ্ছে একসঙ্গে নাচার জন্য। কোথাও রয়েছে নানারকম চা এর দোকান। আর যেখানে সেখানে বিশ্রামের জন্য খাটিয়া পাতা।সেখানে বসে মৌজ করে চা খেলাম। একজায়গায় খোলা আকাশ দেখার জন্য শুয়ে ও পড়লাম।
এক বাঁধনহীন রাজ্যে এসে পড়েছি। কোথাও আবার ছাউনির ভেতর তাকিয়া পাতা। কেউ যদি রাজকীয় মেজাজ পেতে চায়। একটু এগিয়ে দেখি দড়ির ওপর হাঁটা চলছে। নিচে ঢোলক বাজছে। ওপরে দড়ির ওপর দিয়ে বাচ্চা মেয়ে ব্যালান্স এর খেলা দেখাচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে ভয় লাগছে। এই বুঝি পরে গেল। আবার একজায়গায় দেখি বায়োস্কোপ। পুরোনো দিনের। কাচের ফোকর দিয়ে চোখ রেখে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছবি দেখা। পুরোনো দিনের কাঠের নাগরদোলা রয়েছে। হই হই করে উঠছে সবাই।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৭: আমি শুধুই উদাস, জলজ্যান্ত লাশ

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৪২: গুণমুগ্ধ দিলীপ কুমার তাঁর ছবিতে বিনা পরিশ্রমিকেই অভিনয় প্রস্তাব দিয়েছিলেন

যত মত, তত পথ, পর্ব-৬: ঈশ্বরলাভ ক’রে / শুদ্ধাভক্তি লাভ ক’রে সংসারে থাকা—শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ

একটু এগিয়ে ডানদিকে একটি লেক।তার ওপরের বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে ঢুকলাম মন্দিরের দেশে। ভারতের সব প্রদেশের মন্দিরের একটি করে মডেল। কি সুন্দর ছিমছাম। সামনের উঠোনে অল্প আলো। ঈশ্বরের পৃথিবী। মনের বিশ্বাসে আলোকিত। সব কটা মন্দিরেই একবার করে ঢুকলাম। বেরোনোর পথ অন্যদিকে। অন্ধকারএক গুহার মধ্য থেকে বেরিয়ে যেন এক আদিম জগতে ঢুকে পরলাম। ছোট ছোট বাচ্চারা খালি গায়ে আঁকিবুকি কেটে, গালে, চোখের নিচে দাগ কেটে আমাদের সামনে এসে চিৎকার করে লাফালাফি করতে লাগলো। মশালের আলো একটু দূরে দূরে। গা ছমছম করলেও বাস্তবে ফিরে মজা পেলাম। পাথরের তৈরি বেদী। পেছনে জঙ্গল। বেদির ওপর আদুল গায়ে আঁকিবুকি কাটা আদিম মানুষদের নাচানাচি। চাইলে আমরা ও তাদের সঙ্গ নিতে পারি।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৯: খাবারে একদম মশলা নয়?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৩: নহবতবাড়ির ‘এতটুকু বাসা’

সেই আদিম মানুষের জগৎ পেরিয়ে এলাম পাহাড়ের কাছে। ছোট্ট একটি পাহাড় বানানো। তাতে সিঁড়ি, ব্রিজ নদী সবই বানানো আছে। বৈষ্ণো দেবীর আদলে। ওপরে উঠে সেভাবেই নিচু হয়ে কিছু জায়গা পেরতে হয়। মন্দিরে ঘণ্টাধ্বনি শোনা যায়। পাহাড় থেকে নেমে আবার সেই লেকের ধারেই পৌঁছলাম। এবারে খানিকটা দূরে একটি ছাউনিতে দেখি পুতুলনাচ হচ্ছে। রাজস্থানের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির এক প্রধান অঙ্গ পুতুলনাচ। কি যে সুন্দর রংবেরংয়ের পুতুল। ওপর থেকে সুতো নাড়িয়ে কি সুন্দর তাদের নাচ। রাজস্থানী পুতুলগুলো একদম আলাদা রকম। কাঠপুতলি ভারতবর্ষের সবচেয়ে জনপ্রিয় পুতুল। ছেলে পুতুলের মাথায় পাগড়ি। টানাটানা কালো চোখ আঁকা। বেশ পাকানো গোঁফ। মেয়ে পুতুলের ও ট্রাডিশনাল রাজস্থানী পোশাক। কথকতা গান এসবের মাঝে নানা কাহিনি পরিবেশিত হচ্ছে পুতুলনাচে। জমজমাট আসর। ওখান থেকে নড়তেই ইচ্ছে হচ্ছিল না।
রাত বাড়ছিল। এবার খাবার খাওয়ার সময়। মস্ত এক খোলা জায়গায় খাবার চেয়ার টেবিল পাতা। বড় গাছতলায়। আমরা বসতেই ওরা ওখানকার থালি দিয়ে গেল। একদম ট্রাডিশনাল থালি। যেমন খায় রাজস্থানের প্রত্যন্ত গ্রামের লোক। শালপাতার থালায় ছোট ছোট শালপাতার বাটি। মোটা বাজরার রুটি। একটু ভাত। আচার। সব্জি। একটা ভাজা আর বিখ্যাত ডাল বাটি চুরমা। খুব সুস্বাদু নয়। শহুরে স্বাদের মোড়কে রাজস্থানী খাবার নয়। খুব ভালো না লাগলেও ওই পরিবেশের সঙ্গে একদম মানানসই। দু’ একটা মিষ্টির পদ ছিল। তাই দিয়ে আমাদের রসনা তৃপ্ত হল। আলো আঁধারীর এক অপূর্ব জগত ছেড়ে আসতে একদম ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু… Adieu! the fancy cannot cheat so well
As she is famed to do…

তাই আমাদের চেনা জগতে ফিরে এলাম। চোখিধানির মস্ত দুর্গের মতো গেট পেরিয়ে। একবিংশ শতাব্দির আমাদের চেনা হোটেলে। রাতে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলাম।

ছবি: লেখিকা
* পরিযায়ী মন (Travelholic): ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content