মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


ঠাকুরানি ঘাট, নন্দ ঘোষের বাড়ি যাবেন বলে যেখানে বসুদেব শিশু কৃষ্ণকে নিয়ে এসে উঠেছিলেন।

গোপাল নৌকা বাইতে বাইতে বিভিন্ন ঘাট সম্পর্কে ধারাবিবরণী দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি মথুরার অনেক পুরোনো অধিবাসী। তাই পর্যটকদের ঘাটগুলোর পৌরাণিক কাহিনী ও মন্দিরগুলোর কথা শুনিয়ে আনন্দ পান। খানিকটা দূরে ‘কংস কেলা’ দেখিয়ে গোপাল বললেন কথিত আছে ওটাই নাকি রাজা কংসের দরবার ছিল, বর্তমানে আরএসএস-এর অফিস। এছাড়া কালিন্দী ঘাট, মহামায়া ঘাটও জলপথে দৃষ্ট হল। কালিন্দী ঘাটে যমুনা ও শনিদেবের যে ছোট মন্দিরটির অবস্থান, তা ভাই বোনের মন্দির নামে খ্যাত — এ তথ্য গোপালের থেকেই শুনলাম। কালীয় দমনের কাহিনীটি ওই ঘাটের মাহাত্ম্য বৃদ্ধি করেছে।

নন্দ ঘোষের বাড়ি থেকে জন্মাষ্টমীর রাতে বসুদেব যে কন্যা সন্তানকে নিয়ে এসেছিলেন, কংস তাকে মারতে গেলে দৈব বাণী হয় — ”তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।” এই পৌরাণিক কাহিনীটি মহামায়া ঘাটের সঙ্গে এবং দুর্বাসা ঘাটের সঙ্গে জড়িত আর একটি পৌরাণিক কাহিনী। মহামুনি দুর্বাসার ধ্যান ভঙ্গ করতে শ্রীকৃষ্ণ রাধার একশো আটজন সখিকে প্রেরণ করেছিলেন।

গোকুলে রমনরেতি মন্দির।

সব শেষে আমরা অবতরণ করলাম বিশ্রাম ঘাটে। কথিত আছে এই ঘাটে শ্রীকৃষ্ণ কংস বধ করে মাতা, পিতাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে তাঁদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাই সব থেকে প্রসিদ্ধ এই ঘাটটি। এখানে অনেকগুলো ছোট ছোট মন্দিরে পুজোপাঠ চলছিল। মথুরার প্রাচীন ঘাটগুলোর ঐতিহ্য সর্বকালীন এ কথা বলাই বাহুল্য। এবার হোটেলে ফিরে চলার পালা।

জন্মাষ্টমীর দিন বিকেলে অটো করে আমরা গোকুল গেলাম। গোকুল শব্দের আক্ষরিক অর্থ গরুর পাল। গোকুল যমুনা তীরের গ্রাম বিশেষ, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ বলরাম নন্দগৃহে পালিত হয়েছিলেন। গোকুলে শ্রীকৃষ্ণের শৈশব কেটেছে। শ্রীকৃষ্ণের বাললীলার পৌরাণিক কাহিনীগুলো আমাদের মনে গেঁথে আছে। গোকুল হিন্দুদের কাছে একটি পবিত্র স্থান। শ্রীকৃষ্ণের মাখন চুরি, বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলো, রাধার সঙ্গে সাক্ষাৎ ইত্যাদি কাহিনীগুলো গোকুলের ভূমিতেই ঘটেছে বলে কথিত আছে। যমুনা নদীর ওপর ব্রিজের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল অটো। মথুরা থেকে পনেরো কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে গোকুলের অবস্থান।
শৈশবেই কৃষ্ণ এমনই অপ্রতিরোধ্য প্রকৃতির হয়ে উঠেছিলেন যে, তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টাগুলোকে সফল হতে দেননি। কংস পুতনা সহ অন্যান্য রাক্ষসদের প্রেরণ করলে কৃষ্ণ সকলকেই হত্যা করেন। মাত্র ছমাস বয়সেই পুতনা রাক্ষসীকে হত্যা করেন তিনি, যার উচ্চতা ছিল আঠারো কিলোমিটার দীর্ঘ। কথিত আছে যমুনা নদীতে শ্রীকৃষ্ণ কালীয় নাগকে দমন করেছিলেন। নদীতীরে গোকুলের গ্রামবাসীরা এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছিলেন। ভারতের অনেক চিত্রকলায় ও স্থাপত্যে কালীয় নাগের মাথার ওপর নৃত্যরত কৃষ্ণকে দেখা যায়। অশুভ শক্তির নাশ করে কৃষ্ণ গোকুলবাসীকে রক্ষা করেছিলেন।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৫: হৃদয়ে হৃদয় মিলল মিথিলা অযোধ্যার

কোন আপেলে উপকার বেশি? লাল না সবুজ

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২: এক ছবিতে অনেক ‘কামনা’ [০৪/০৩/১৯৪৯]

প্রথমেই গোকুলে যমুনা তীরে ঠাকুরাণী ঘাট দর্শন করলাম। কথিত আছে জন্মাষ্টমীর দিন বসুদেব তাঁর পুত্র সন্তানকে কোলে করে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি দুর্যোগের মধ্যে মথুরা থেকে গোকুলের ঠাকুরানি ঘাটে এসে উঠেছিলেন। গোকুলের ঘাটগুলোরও প্রাচীন ঐতিহ্য আছে। গোকুলের রাস্তাঘাট, সরু গলি, পলেস্তরা খসা পুরোনো ইটের বাড়িগুলোতে প্রাচীন জনপদের ছাপ স্পষ্ট। ব্রাহ্মণ পান্ডাদের রুজি রোজগার গোকুলে বেশ ভালোই। তাঁরা ভক্ত ও পর্যটকদের বিভিন্ন কাহিনী শুনিয়ে পূজা পাঠ করান।

ঠাকুরাণী ঘাট থেকে কাছেই নন্দ ঘোষের বাড়ি। গলির রাস্তা ধরে সামান্য গিয়েই খুঁজে পেলাম বাড়িটি। বর্তমানে বাড়িটি শ্রীকৃষ্ণ বলরামের মন্দিরে পরিণত হয়েছে। ভেতরের দেওয়ালে পৌরাণিক কাহিনীর অনেক ছবি লক্ষ্য করলাম। মন্দিরের গর্ভগৃহের কাঁচের দেওয়াল জাঁকজমকপূর্ণ শোভায় দৃষ্টিনন্দন করছে। এখানে সোনার দোলনাটি বালগোপালের দোলনার প্রতীক রূপে সজ্জিত। মন্দিরে কৃষ্ণগাথা ও ভজন শুনতে অনেক লোক সমাগম হয়েছে। এত হাজার বছরের প্রাচীন স্থানটির মাহাত্ম্যর কথা স্মরণ করে ভক্তিপূর্ণ প্রণাম জানালাম।
আরও পড়ুন:

শিশুকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছেন? কোন কোন বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন? কী কী ওষুধ সঙ্গে রাখবেন? রইল পরামর্শ

ত্বকের পরিচর্যায়: ফর্সা হওয়ার দৌড়ে না গিয়ে স্বাভাবিক রং নিয়েই সুন্দর ও সুরক্ষিত থাকুন, জানুন ত্বক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

হার্ট অ্যাটাক নীরবেও হতে পারে! কোন উপসর্গ দেখে সতর্ক হবেন? জেনে নিন ডাক্তারবাবুর পরামর্শ

বৈষ্ণবদের কাছে জন্মাষ্টমী একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। তাঁরা নানা ভাবে এই উৎসব উদযাপন করেন। ভাগবত পুরাণ অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণ লীলার অনুষ্ঠান, মধ্যরাতে কৃষ্ণ জন্মের মুহূর্তে ধর্মীয় গান গাওয়া, উপবাস, দহি হান্ডি প্রভৃতি নানান জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠান পালন মথুরা, বৃন্দাবন ও গোকুলে করা হয়। তামিলনাড়ুতে ‘উড়িয়াদি’ নামে একটি প্রথা প্রচলিত,যেখানে অনেক উঁচুতে মাখনের হাঁড়ি রাখা হয় এবং ছেলেরা মিলে মানুষের পিরামিড তৈরি করে সেই হাঁড়ি ভাঙার চেষ্টা করে।

গোকুলে নন্দ ঘোষের বাড়ি।

মথুরা, বৃন্দাবন, গোকুল ছাড়াও মণিপুর, আসাম, ত্রিপুরা, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যেও বৈষ্ণব সম্প্রদায় এই উৎসব পালন করেন। ভাগবত পুরাণে কৃষ্ণকে বংশীবাদন রত এক কিশোর রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। গীতায় তিনি পথ প্রদর্শক রূপে দন্ডায়মান। দর্শন ও ধর্মতাত্ত্বিক ঐতিহ্যতে শ্রীকৃষ্ণ সংক্রান্ত উপাখ্যানগুলো বহুধা পরিব্যপ্ত।

শ্রীকৃষ্ণের উপাখ্যানগুলো মূলত: লিখিত আছে মহাভারত,হরিবংশ,ভাগবত পুরাণ ও বিষ্ণুপুরাণ গ্রন্থে। গোকুলে শিশু কৃষ্ণকে স্নান করাচ্ছেন যশোদা ভাগবত পুরাণের পশ্চিম ভারতীয় পুঁথিচিত্র থেকে প্রাপ্ত হয়। পিতা বসুদেব যমুনা পেরিয়ে শিশু কৃষ্ণকে গোকুলে নিয়ে যাচ্ছেন মধ্য অষ্টাদশ শতকের চিত্রকলায় লব্ধ হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে আধ্যাত্মিক ভক্তি আন্দোলন মূলত: কৃষ্ণকে কেন্দ্র করেই হয় এবং জনজীবনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

কালযবন পরিবেষ্টিত মথুরা (যেখানে কৃষ্ণ ও বলরাম উপবিষ্ট, ভাগবত পুরাণের একটি পুথিচিত্র, ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ)

নন্দ ঘোষের বাড়ি থেকে যমুনার ধারে ফিরে এসে আমরা অটোয় উঠলাম। আকাশে গোধূলির আলো, দূরে সারি সারি নৌকা— এক অনির্বচনীয় দৃশ্যর সাক্ষী রইলাম। সব শেষে গেলাম গোকুলের রমনরেতি মন্দিরে। মন্দির প্রাঙ্গণটি বিশাল। ভেতরে আশ্রম, মন্দির ও অনুষ্ঠানের মঞ্চটি সুন্দর। এখানকার ধূলি পবিত্র এ কথা কেউ কেউ বললেন। এই মন্দিরের বৈশিষ্ট্য হল একটি সুসজ্জিত হাতী সন্ধ্যারতির সময় মন্দিরে ঘন্টা বাজায়। হাতিটিকে ঘিরে জনতার ভিড়। কেউ কেউ নানান কিছু খেতে দিচ্ছে হাতিটিকে। মন্দিরের ভেতরে থেকে কৃষ্ণ ভজন ভেসে আসছিল, কিছু মহিলা ভক্তিভাবে নৃত্য করছিলেন। বেশ কিছু শিশুপুত্রকে বালকৃষ্ণ সাজিয়ে বাবা মায়েরা মন্দিরে নিয়ে এসেছে। এরপর শুরু হল সন্ধ্যারতি। হাতি শুঁড়ে করে ঘণ্টা ধ্বনি দিল, শুড়ে করে মালা নিয়ে মন্দির খানিকটা প্রদক্ষিণ করল, সঙ্গে দর্শনার্থীরাও গেল। সব মিলিয়ে অপার্থিব আনন্দ ও ভক্তি রসের এক সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল।
দু’দিনের মথুরা ভ্রমণের রেশ নিয়ে ফিরে চললাম বাড়ির দিকে। এ কথা স্বীকার করতেই হয় যে, পুরাণ, ইতিহাস ও ভক্তিরসের মেলবন্ধন মথুরাকে জনমানসে চির স্মরণীয় করে রাখবে!— শেষ

ছবি লেখক

Skip to content