বুধবার ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪


জাগুয়ারের পায়ের ছাপ।

এরপর সারাদিনই হেঁটে চলেছি জঙ্গলের রাস্তা ধরে। আর তেমন কিছুই শিহরন জাগানো চোখে পড়ছে না। পথ চলতে চলতে দেখলাম নানাবিধ গাছ। খেলাম পৃথিবীর সবচাইতে ছোট নারকেল। তার আয়তন বড়জোর ওই পিংপং বলের (টেবিল টেনিস খেলার বল) মতো। কিন্তু দেখতে এবং খেতে অবিকল নারকেল।

তাছাড়া দেখলাম এক অদ্ভুত বিশাল উঁচু গাছ যার পুরো গুঁড়িটাই কাঁটা দিয়ে ঢাকা। গোলাপ গাছের ছোট ডালে কাঁটা দেখে বড় হওয়া আমি তো দেখেই থ। ওরকম একটা উঁচু গাছ যার মাথা ওপরে কোথায় শেষ হয়েছে দেখাই যাচ্ছে না তার গুঁড়ির পুরোটাই কাঁটায় ঢাকা! বাদিয়া বলল এর কারণ আছে। এই গাছগুলোর গুঁড়িটা ভিতরে প্রায় ফাঁপা। তাই অল্প আঘাতেই, যেমন কোনও জন্তুজানোয়ার এসে একটু যদি জোরে ধাক্কা দেয় তাহলেই ভেঙে পড়তে পারে। তাই নিজের আত্মরক্ষার তাগিদেই ওই বন্দোবস্ত। বিধাতার খেয়াল নাকি বিবর্তনের ফলাফল কে জানে, তবে অদ্ভুত এই অভিযোজন বা নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার নিদর্শন। ‘সারভাইভাল অফ দা ফিটেস্ট’-এর দুনিয়ায় বেঁচে থাকার চেষ্টা।

অন্যদিকে আবার দেখলাম এই দুনিয়াতেই হার মেনে যাওয়া কিছু গাছ। বিশাল উচ্চতা বা শক্তসমর্থ হওয়া সত্ত্বেও কেমনভাবে এক পরগাছার হাতে পরাস্ত হয়েছে। প্রায় তিনশো ফুট উঁচু এক বৃক্ষ কেমনভাবে সর্বহারা হয়ে বসে আছে। তার এমনই অবস্থা যে আসল গাছটিকে আর দেখাই যাচ্ছে না। তার পুরো গুঁড়িটাকেই মাঝখান থেকে খেয়ে নিয়েছে পরগাছাটি। তার জীবন প্রদায়ী রসে পরগাছাটিই এখন তিনশো ফুট উঁচু হয়ে মোটা শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে বসে আছে।
সেদিনকার গন্তব্যের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। ঠিক তখনই আবিলো টুকান পাখির ডাক শুনল। অবিকল ওইরকম একটা ডাক সেও নিজের মুখে বের করতে পারে। তার ডাকে সাড়া দিয়ে টুকানটিও ডাকতে লাগল। ঠিক যেমন আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে কোকিল ডাকে। ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম। কিন্তু টুকানের ডাক খুব কর্কশ। কিন্তু দেখতে খুব সুন্দর। তাই টুকানের সেই ডাক লক্ষ্য করে তাকে দেখতে চললাম সবাই। অবিলো ডাকতে ডাকতে চলেছে আগে আমরা সবাই তাকে অনুসরণ করছি। এভাবে প্রায় মিনিট তিন চার চলেছি। টুকানের দেখা তখনও পাওয়া যায়নি। ঘটনাটা ঘটল ঠিক সেই সময়। কাদা কাদা রাস্তায় হঠাৎ আবিলো লক্ষ করল জাগুয়ারের পায়ের টাটকা একখানি ছাপ। ভালো করে লক্ষ করলে দেখা গেল যে সেই ছাপ ওই পথ ধরে চলে গেছে। বিপদটা তখনও বুঝতে পারিনি। কিন্তু হঠাৎ যখন সেই টুকানের ডাককে নীচে ফেলে কানে এল এক হিংস্র গর্জন তখন এড্রেনালিন, ডোপামাইন সব হরমোন একসঙ্গে শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। আর একবার নয়, পরপর দুতিনবার গর্জন আর তার প্রত্যুত্তরে বিভিন্ন পশুপাখির চিৎকার; সব মিশে সে যেন এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। হাতের ক্যামেরা হাতেই রয়ে গিয়েছে। বলাই বাহুল্য, টুকান দেখার ইচ্ছা তলানিতে ঠেকেছে এক নিমেষেই। মৃত্যুর হাতছানি। জাগুয়ার। আবিলোর মতে সে আছে মাইল খানেকের মধ্যেই। বা হয়তো কোনও জায়গা থেকে আমাদের সে লক্ষও রাখছে। শিকার যদি সে পেয়ে গিয়ে থাকে তো ভালো। নাহলে যদি আহত অবস্থায় থাকে তাহলে কিন্তু ভয়ানক বিপদ হতে পারে। আর একথা বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না যে এখানে বিপদের অর্থ সাক্ষাৎ মৃত্যু। আবিলোর থেকে জানা গেল যে জাগুয়ার সাধারণত মানুষকে আক্রমণ করে না কিন্তু, এমনও কোনও মাথার দিব্যি নেই যে আক্রমণ করবে না। তাই সবার আগে যেটা জরুরি, আমাদের সবসময় একসঙ্গে থাকতে হবে। কারণ যত বেশি মানুষ দলে থাকবে জাগুয়ার কাছে আস্তে তত ভয় পাবে। তাই এখন থেকে কখনওই এক মুহূর্তের জন্যও যেন আলাদা না হয়। আমরা বেশ খানিকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম দল বেঁধে। দল মানে ওই পাঁচ জনই। সরকারি সার্কিট হাউস, বা বনদপ্তরের হোটেলের ঘর থেকে বাঘ দেখার চাইতে এই অভিজ্ঞতা পুরোপুরি অন্যরকম। আমাদের কাছে আত্মরক্ষার সরঞ্জাম বলতে ওই আবিলোর হাতের ছোরা আর বাদিয়ার হাতে রান্নার জন্য কাঠ কাটার একটি কুঠার। নিদেনপক্ষে একটা গাড়ি বা লঞ্চের মধ্যে থাকলেও হয়তো জাগুয়ারকে একটু চোখের দেখা দেখতে চাইতাম। কিন্তু এই গহন অরণ্য প্রান্তে, কোনও নিরাপত্তা ছাড়া তাকে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করা মানে নিজের মৃত্যুর প্রার্থনা করা। আমরা কেউই জিম করবেট নই। আবিলো আর বাদিয়া হয়তো কিছুক্ষণ লড়াই চালাতে পারবে কিন্তু, তারপরে নিশ্চিত মৃত্যু। আর এখানে মৃত্যু মানে আমার বাড়িতে কেউ জানতেও পারবে না আমার কথা, বা হয়তো দেহটাই উদ্ধার হবে না। তাই যত দুর্লভ প্রজাতির জীবই সে হোক না কেন, যত রোমহর্ষকই হোক না কেন, আমরা কেউই চাই না তাকে সামনাসামনি দেখতে। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। তাকে মুখে বা লিখে ব্যাখ্যা করা যায় না। আসলে ভাবনাচিন্তার ক্ষমতা প্রায় একরকম লোপ পেয়ে যায় এরকম সময়ে। বেঁচে থাকার ইচ্ছা ছাড়া অন্য কোনও অনুভূতি বা ভাবনার কিছুই থাকে না সেই সময়। তাই কোনও কিছু না ভেবে শুধুমাত্র ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আর তা করতে না করতেই আবার একবার গর্জন। তবে এবার শোনা গেল একটু দূর থেকে। যার মানে হল যে, সে হয় তো দূরে চলে যাচ্ছে।

এক অদ্ভুত গাছ যার পুরো গুঁড়ি টাই কাঁটায় ঢাকা ।

প্রায় দশ পনেরো মিনিট ওইখানেই দাঁড়ানোর পরও যখন আর শব্দ শোনা গেল না তখন একটু আশ্বস্ত হওয়া গেল। এ যাত্রায় হয়তো প্রাণে বেঁচে গেলাম। কিন্তু ঝুঁকি নিয়ে ওই কাছাকাছি জায়গায় তাঁবু ফেলা যায় না। কখন সে ফিরে আসবে না তা কে বলতে পারে। গতকাল রাতের খরগোশের আওয়াজে ওই অমূলক ভীতি যে আজ সশরীরে তার সমস্ত ভয়াবহতা নিয়ে হাজির হবে সে আর কে জানত। তাই ঠিক হল আমাদের আরও দূরে হেঁটে যেতে হবে। প্রায় আরও তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা মতো তাঁবু ফেলার মতো একটা জায়গায় পৌঁছতে গেলে। এই বিপদ থেকে যতটা সম্ভব দূরে চলে যাওয়া যায় আর কী।

কিন্তু কথা হল, আরও তিন ঘণ্টা বেশি হাঁটা মানে রাত্রি বেলায় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়া। এর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না আমরা কেউই। ফ্ল্যাশ লাইট নিয়েছি বটে কিন্তু সে শুধু তাঁবুর মধ্যে বা তার চারপাশে রাত্রি যাপনের বন্দোবস্ত করার উদ্দেশ্যে। এইখান থেকেই আমাদের যাত্রা হয়ে উঠল শুধুই ভয়ের। গত ১৫-২০ মিনিট থেকে শুরু করে পরবর্তী ৩-৪ ঘণ্টা নিঃসন্দেহে আমার জীবনের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ কিছু মুহূর্তগুলোর মধ্যে একটা৷

ছবি: লেখক

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম : এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে বেশ কিছু ছবি ও ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ পাঠাতে হবে। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল : samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content