লেক গ্যালেনা।
সূর্য এখানে নেমে যায় ঝুপ করে। হ্রদের কাছে এসে পৌঁছনোর পনেরো থেকে কুড়ি মিনিটের মধ্যেই চারদিক প্রায় অন্ধকার হয়ে এল। আমিও হাঁটা লাগলাম গাড়ির দিকে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। কিন্তু, শরীরে কোনও ক্লান্তি নেই। একে ওই রঙের খেলা, আবার অন্যদিকে উইসকনসিনের ফাঁকা আঁকাবাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালানো—পুরো ব্যাপারটাই যেন জীবনীশক্তিকে যেন আরও বেশি করে উসকে দেয়। তাই ক্লান্তি তো দূরের কথা, বরং কাজ করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
রাতে ফিরেই ঠিক করে ফেললাম পরের দিন যাব হোলি হিল চার্চ। মধ্য ও দক্ষিণ পূর্ব উইসকনসিনের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের ওপর অবস্থিত এই গির্জা। হোলি হিলকে অবশ্য পাহাড় বলার চেয়ে টিলা বলাই ভালো। সঠিক প্রতিশব্দ বলতে গেলে একে বলতে হয় ‘কেম’। হিমবাহজনিত ক্ষয়কার্যের ফলে তুষার যুগে চারপাশের অঞ্চল ক্ষয়ে নিচু হয়ে গিয়েছে। আর এই টিলাটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মধ্যিখানে। এরকম টিলাকেই বলে ‘কেম’। তো, হোলি হিল নামক ‘কেম’টির চারপাশে আর কোনও পাহাড় বা টিলা কিছুই নেই। বা থাকলেও এই টিলাটির তুলনায় অনেক নিচু। অর্থাৎ কিনা হোলি হিলের ওপর থেকে চারদিকের অঞ্চলটা পরিষ্কার দেখা যাবে। আর সেই অঞ্চলটা গোটাটাই ফল কালার সমৃদ্ধ গাছে ঢাকা।
আরও পড়ুন:
ফল কালারের রূপ-মাধুরী, পর্ব-৬: গাড়ির সান রুফ খুলে চালিয়ে দিলাম ‘সুহানা সফর হ্যায় ইয়ে মৌসম হাসি, হামে ডর হ্যায় কে…’
ইংলিশ টিংলিশ : APOSTROPHE-এর সঠিক ব্যবহার, Happy Teacher’s Day, নাকি Happy Teachers’ Day?
ষাট পেরিয়ে, পর্ব-২০: বয়স হয়েছে তাই ওজন কমে যাচ্ছে—এই ধারণা কি আদৌ ঠিক? / ৫
হোলি হিল আমার বাড়ি অর্থাৎ প্লেটভিল থেকে প্রায় আড়াই ঘণ্টার রাস্তা, মিলওয়াকির কাছে এরিন শহরে। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। গির্জায় পৌঁছে সেখানকার রবিবারের প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করব, সেরকমই ইচ্ছে। পাহাড়ের একদম চূড়ায় গির্জাটি অবস্থিত। গাড়ি রাখার জায়গা থেকে পাহাড়ের চূড়ায় গির্জা, গির্জা থেকে বেশ কিছুটা নীচে গাড়ি রেখে হেঁটে হেঁটে সেখানে উঠতে হবে। এই পাহাড়ের গায়ে পুরোটাই বার্চ এস্পেন-এর জঙ্গল অর্থাৎ হলুদে ঢাকা। তার মাঝে মাঝে খ্রিস্টান ভাস্কর্য ছড়িয়ে আছে এদিক-ওদিক। দেব-দেবী, পুণ্যাত্মা এবং সন্তদের মূর্তিতে পবিত্র বাইবেলের গল্প। ঠিক যেরকম পৌরাণিক, কাল্পনিক বা ফ্যান্টাসি চলচিত্রে দেখা যায়, ঠিক সেরকম।
রঙের মাঝে লেক গ্যালেনায়।
নিজেকে বেশ একটা ‘নার্নিয়া’ বা ‘গেম অফ থ্রোন্স’-এর চরিত্র বলে মনে হচ্ছিল। এই বুঝি ওপাশ থেকে একটা কথা বলা সিংহ চলে আসবে আমাকে তার সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য বা এখুনি হয়তো ওপর থেকে একটা ড্রাগন নেমে আসবে। বা হয়তো গাছের ওপরে দু-একটা ড্রাগন অপেক্ষাই করছে। এরকম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আমি এগোতে লাগলাম গির্জার দিকে। পাহাড়ের গা বেয়ে জঙ্গলের সুন্দর পরিপাটি রাস্তা করা আছে। রবিবার বলে প্রচুর লোকসমাগম সেদিন। সবাই এসেছে গির্জায় প্রার্থনা করতে।
আরও পড়ুন:
দশভুজাঃ যে গান যায়নি ভোলা— প্রাক জন্মদিনে তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য…/১
ফেসবুক প্রোফাইলে ১ ডিসেম্বর থেকে ব্যবহারকারীদের এই তিনটি তথ্য দেখা যাবে না, কী কী জানেন?
মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৪৩: সমুদ্রশোষণ তো হল, এবার পূরণ করবে কে?
প্রায় দশ-পনেরো মিনিট হাঁটার পর পৌঁছলাম গির্জার প্রাঙ্গণে, পাহাড়ের চূড়ায়। গির্জার সামনেটা বিরাট বড় একটা চাতাল করা আছে। সেখানে চারদিক ঘরে আর সেখান থেকে নীচের পুরোটাই দেখা যাচ্ছে। যত দূর চোখ যায় নীচে শুধুই ফল কালার। এ এক স্বর্গীয় অনুভূতি। একদিকে দেবালয়, অন্যদিকে যেন তাঁরই জন্য তৈরি করা হয়েছে স্বর্গীয় বিচরণভূমি। এরই মধ্যে গির্জার ভেতরে শুরু হল প্রার্থনা। ক্যাথোলিক নিয়ম অনুযায়ী অন্যান্যদের প্রার্থনার ভাবভঙ্গিমা দেখে দেখে তাদের অনুকরণ করে আমিও তাতে ভাগ নিলাম। গসপেলের কথায় ও সুরে মন যেন পবিত্র হয়ে গেল।
উইসকনসিনের সেই আঁকাবাঁকা ফাঁকা রাস্তা।
প্রার্থনার শেষে বেরিয়ে দেখি বাইরে একটি বেশ লম্বা সারি করে প্রচুর লোক দাঁড়িয়ে আছে। শুনলাম গির্জার পাশের খিলানটির মাথায় যাওয়ার অনুমতি আছে আজ সবার। সেখান থেকে যাতে আরও দূর পর্যন্ত ফল কালার দেখা যায়। প্রায় একঘণ্টা ওই সারিতে দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ওঠা গেল ওই খিলানের মাথায়। অন্যান্য খিলান বা গম্বুজের মতোই এখানেও ঘোরানো সিঁড়ি। সিঁড়ির পাশে পাশে দেওয়ালে বড় বড় জানলা। সেখান দিয়ে চারদিকের ফল কালার দেখা যাচ্ছে।
একদম ওপরে চারদিকে জানলা করা আর সেখান দিয়ে দেখা যাচ্ছে চারদিক। চারদিকে অনেক নীচে পৃথিবী জুড়ে চলেছে শুধু রঙের খেলা। আর আমরা যেন স্বর্গদ্বার থেকে তা প্রত্যক্ষ করছি। এ এক অদ্ভুত আধ্যাত্মিক অনুভূতি। এক অন্য রকম ফল কালার দর্শন। হয়তো এখানে রঙের বিচারে এই অঞ্চল ডোর কাউন্টি বা কেটলমোরেইন-এর মতো অত উজ্জ্বল নয়। কিন্তু একটি উঁচু পাহাড়, তার চূড়ায় একটি গির্জা, তার চারদিকে দেবদেবীর প্রাচীন মূর্তি সংবলিত বনাঞ্চল, মাঝে মাঝে গির্জায় বাজছে ঘণ্টা, কখনও বা গসপেলের সুমধুর সুর সোনা যাচ্ছে, আর সবাইকে ঘিরে এই ফল কালার। অতি বড় নাস্তিকও হয়তো এখানে ঈশ্বরকে তাঁর সৃষ্টির জন্য মনে মনে ধন্যবাদ না জানিয়ে থাকতে পারবে না৷
* ফল কালারের রূপ-মাধুরী (Wisconsin Fall Color : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।
একদম ওপরে চারদিকে জানলা করা আর সেখান দিয়ে দেখা যাচ্ছে চারদিক। চারদিকে অনেক নীচে পৃথিবী জুড়ে চলেছে শুধু রঙের খেলা। আর আমরা যেন স্বর্গদ্বার থেকে তা প্রত্যক্ষ করছি। এ এক অদ্ভুত আধ্যাত্মিক অনুভূতি। এক অন্য রকম ফল কালার দর্শন। হয়তো এখানে রঙের বিচারে এই অঞ্চল ডোর কাউন্টি বা কেটলমোরেইন-এর মতো অত উজ্জ্বল নয়। কিন্তু একটি উঁচু পাহাড়, তার চূড়ায় একটি গির্জা, তার চারদিকে দেবদেবীর প্রাচীন মূর্তি সংবলিত বনাঞ্চল, মাঝে মাঝে গির্জায় বাজছে ঘণ্টা, কখনও বা গসপেলের সুমধুর সুর সোনা যাচ্ছে, আর সবাইকে ঘিরে এই ফল কালার। অতি বড় নাস্তিকও হয়তো এখানে ঈশ্বরকে তাঁর সৃষ্টির জন্য মনে মনে ধন্যবাদ না জানিয়ে থাকতে পারবে না৷
* ফল কালারের রূপ-মাধুরী (Wisconsin Fall Color : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।
বাইরে দূরে
লেখা পাঠানোর নিয়ম: এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। লেখার সঙ্গে বেশ কিছু ছবি পাঠাতে হবে। চাইলে ভিডিও ক্লিপও পাঠাতে পারেন। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com