রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


মনুমেন্ট ভ্যালি৷

যেখানে পাহাড় সেখানেই কোনও নতুন গল্প, সেই গল্পের অবসরেই নতুন কোনও জীবন ও সংস্কৃতিকে খুঁজে পাওয়া৷ উটাহ নগরীতে গিয়ে সেই অভিজ্ঞতাই হল৷ কলোরাডোর পর্বত ঘেরা রাস্তা, যেখানেই চোখ যায় ছোট বড় নানান মাপের পাহাড়ে পড়ে থাকা আলোর ছটা, কখনও মেঘ, বা বৃষ্টির নেমে আসা এসবের বাইরে উটাহ ছিল এক ভিন্ন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা৷ পার্থক্য বলতে ছিল, পর্বতের সৌন্দর্য থেকে প্রাচীনতম জলনগরীর রুক্ষ কঠিন ভূমিকে নতুনভাবে আবিষ্কার করা৷ আর সেই জায়গাটির সংস্কৃতির ভূমিপুত্রদের সম্পর্কে কৌতূহল তৈরি হওয়া৷ উটাহ মূলত একটি পর্যটন স্টেট বা রাজ্য৷ এর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়েছিটিয়ে আছে ছোট বড় অনেক শহর৷ উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম মিলিয়ে এই শহরের চারধারে রয়েছে কলোরাডো, ওয়েমিং, ইদাহো, আরিজোনা, নেভাডা এবং পার্শ্বিক মেক্সিকো শহর৷

ব্রাইস ক্যানিয়ন৷

কলোরাডো থেকে পাহাড় পর্বত পেরিয়ে, ছোট বড় নানান মাপের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে মনে হচ্ছিল কী এমন দেখব সেই নগরীতে! কলোরাডো নিজেই এত সুন্দর, তার পাহাড়ি রাস্তার বাঁক, অন্ধকার হয়ে আসা পাইনের জঙ্গল, উঁচুনিচু রাস্তা, আকাশের ক্যানভাসে ভাসা মেঘ, সব মিলিয়ে যেন ভেসে বেড়ানো! উটাহ সম্পর্কে যা জেনেছি, যা শুনেছি তাকে চরিতার্থ করার এই সুযোগ৷ উটাহ ঘুরতে গেলে আমেরিকার যেকোনও প্রান্ত থেকে বিমানযোগে সল্টলেক সিটিতে আসা যায়৷ পাঁচ বা ছয় অথবা দশ ঘণ্টার স্থলপথে মানুষ ড্রাইভ করার সুযোগও হাতছাড়া করে না অনেক সময়৷ সল্টলেক সিটি উটাহ শহরের রাজধানী৷ এখান থেকে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নও ঘুরতে যাওয়া যায়৷ শুধু তাই নয়, উটাহ সম্পূর্ণ ঘুরে দেখতে চাইলে প্রায় মাসখানেক সময় প্রয়োজন৷ এত বিস্তৃত প্রান্তর যার, একেকদিকে একেক রকমের ল্যান্ডস্কেপ, জনজাতির জীবনের বৈচিত্রময় বহিঃপ্রকাশ তাকে দেখতে ও বুঝতে গেলে কিছুটা সময় প্রয়োজন বইকি৷ আজ থেকে প্রায় ১২ হাজার বছরেরও আগে এই স্থানটি মানুষের বসবাসের যোগ্য হয়ে উঠেছিল৷ নাভাহো, গশু, শোষনি, পাইউট এবং উটে নামক আদিবাসী নাগরিকদের সংমিশ্রণে নেটিভ আমেরিকানদের একটি অংশ এখানে থাকতে শুরু করে৷ উটাহ শহরে এলে কোথাও এই প্রাচীনতম ইতিহাসের নগর সভ্যতা সহজেই চোখে পড়বে৷ এখনও বিভিন্ন আদিবাসী রাজা উটাহ শহরের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে৷ আমেরিকান প্রেসিডেন্টের শাসন চলে না সেখানে৷ জানা গেল, ১৬৮০ সালের দিকে স্পেনীয়দের কিছু অংশ নাবাহো গোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যায়৷ পরবর্তীকালে নাবাহো সম্প্রদায়ের মহিলারা বন্যপ্রাণীর চামড়াজাত দ্রব্য বানাতে শুরু করে৷ স্থানীয় দোকান বাজারে আছে সেই প্রাচীন সভ্যতার স্পর্শ খুঁজে পাওয়া যায় সহজে৷ ১৯৩০ সালে এই গোষ্ঠীর মানুষরাই নাকি বিশ্বযুদ্ধে ‘সিক্রেট কোড ম্যাসেঞ্জার’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে৷ কেননা এদের ভাষার বিকল্প ছিল না বলে৷
উটাহ শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত জুড়ে এই আদিবাসী গোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষের রুক্ষ পাথরের সমতল এলাকা খুঁজে ১৫ থেকে ৩০ জনের পরিবার নিয়ে বসবাসের কাহিনি শোনা যায়৷ উড়ন্ত পাখি ধরা, পাহাড়ের চড়া, ছোট বা বড় প্রাণী হত্যা করে খাওয়া, এক গোষ্ঠী থেকে দুর্বল মানুষ খুঁজে নিয়ে মেক্সিকানদের কাছে দাস হিসেবে তাদের বিক্রি করে দেওয়া, পাথরে ঘষে, বুনো ফল আর মাটি মিশিয়ে প্রতিষেধক তৈরি করা, ঘোড়ায় চড়ে নিজেদের সংরক্ষিত এলাকার নিরাপত্তা বিস্তার করা এগুলোই ছিল এইসব আদিবাসীদের একমাত্র কাজ, সময়ের সঙ্গে এরা আধুনিক সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের মেলানোর চেষ্টা করেনি, বরং আদিবাসীদের জীবনকে গতানুগতিক রাখতে উটাহ শহর এখনও সেই আদি অকৃত্রিম সময়ের ফ্রেমে যেন দাঁড়িয়ে আছে৷ এখানে না এলে বোঝা যায় না যে, এরা হেরিটেজকে কীভাবে সংরক্ষণ করতে জানে৷ তাদেরকে সম্মান দিতে জানে৷ লিভিং ট্রাডিশন ফেস্টিভাল, পাইউট রেস্টোরেশন ডে, নেটিভ আমেরিকান ফেস্টিভ্যাল, ট্রাডিশনাল হ্যান্ড অ্যান্ড স্টিক গেমস, নাবাহো ফেয়ার ইত্যাদি নানা ধরনের আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান সারাবছর চলতে থাকে৷ মজার বিষয় হল, আদিবাসী হিসেবে এদের সম্মান স্থানীয়দের তুলনায় অনেক বেশি৷ সেই সঙ্গে সুযোগ সুবিধাও৷ উলটোদিকে আমাদের দেশের আদিবাসীদের জীবনের কথা মনে হতে অদ্ভুত এক অসহায়তা বোধ হল৷ এখানে এলে মনে হয়, কোনও দৈবাৎ নির্দেশে এসে পৌঁছেছি, এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা আছে, তাই যেন আমরা (পর্যটক) আছি৷ আজ তাদের প্রজন্ম একই উত্তরাধিকার বয়ে চলেছে৷ শহরের সর্বত্র বহেমিয়ান সংস্কৃতি৷ কাঠের তৈরি রেস্তোরাঁ, বিয়ার শপ, এমনকী স্থানীয় গ্রসারি দোকানগুলোর সাজসজ্জা খুবই সাধারণ৷

আর্চেস ন্যাশনাল পার্ক ৷

দূর দূর পর্যন্ত চোখে পড়বে না কিছু৷ যতদূর চোখ যায়, মাটির যেন হাতে গড়া স্থাপত্য, বিভিন্ন প্রকারের, আকারের৷ এইসব পথে জনমানুষের পদচিহ্ন তো দূর অস্ত্, কোনও গাছপালা পর্যন্ত দেখা যায় না৷ মনে হতে পারে, যেকোনও সময়ে হয়তো ঘোড়ার পিঠে সওয়ার করে কোনও মধ্যযুগীয় যোদ্ধার দল সামনে এসে পড়বে৷ মার্কিন চলচ্চিত্রের অসংখ্য প্লটের অজানা রহস্যময় প্রেক্ষাপট এই উটাহ শহরকে কেন্দ্র করে৷ লালরঙা সেই রুক্ষ প্রস্তর ভূমিতে জীবনের স্পন্দন ধরে আছে ছোট ছোট নদীর মতো জলক্ষেত্রগুলো৷ বর্ষায় সেই ক্ষীণস্রোতা নদীই নাকি ভাসিয়ে নিয়ে যায় এই অনুর্বর প্রান্তকে৷ ব্রেস ক্যানিয়ন, জিয়ন, আর্চেস, ক্যানিয়ন ল্যান্ড, ক্যাপিটালরিফ, ডিয়ার ভ্যালি, ডেড হর্স পয়েন্ট এই জায়গাগুলো সব ন্যাশনাল পার্ক৷ ভিজিটর সেন্টারে গিয়ে জানা গেল, ২৯০ মিলিয়ন বছর আগে এই পুরো এলাকাটি সমুদ্রের নীচে ছিল৷ আর তাই মাটির উঁচু উঁচু ঢিবির কী আশ্চর্য সব কারুকার্য! জলের দাগ আর দীর্ঘদিনের প্রবাহিত হাওয়া এর প্রকৃতিকে বদলাতে পারেনি একটুও৷ জলের নীচে থাকা বিস্তৃত এক প্রান্তর ধীরে ধীরে ভূমি হল, সেখানে এসে বাসা বাঁধল এইসব অধিবাসীরা৷ হঠাৎ রোদ, অথবা বৃষ্টির মেঘ জমতে দেখা, ১০০ মিটারের মধ্যে কোথাও বৃষ্টি আবার শুষ্কতা অদ্ভুত এই প্রকৃতি একমাত্র উটাহতেই দেখতে পাওয়া সম্ভব৷ সেই কবে থেকে পৃথিবীর এই প্রান্তে মৌনতার প্রহর যেন কাটে না৷ ভৌগোলিক ইতিহাসচর্চায় না জানি এর কত গবেষণা, কত জ্ঞানবিজ্ঞানের স্রোত মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে৷ কিন্তু রূপকথার রহস্য ভেঙে সেই আদিম রাখাল, আজও কারও অপেক্ষায় বসে আছে, তাঁর খোঁজ পেতে সেই অজানায় ডুব দিতে আবার যেতে হবে নিঃসন্দেহে৷

ছবি : লেখিকা

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম : এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে বেশ কিছু ছবি ও ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ পাঠাতে হবে। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল : samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content