
গ্লেন হাইওয়ে। ছবি: সংগৃহীত।
রেস্তরাঁটা বিমানবন্দর এলাকারই পিছন দিকে। এই সামনে বাণিজ্যিক বিমান আর পিছনে নিজস্ব বিমান ওঠানামার ব্যাপারটা যুক্তরাষ্ট্র সোহো অনেক জায়গাতেই দেখা যায়। কিন্তু অমন রেস্তরাঁর ধরে গাড়ির সঙ্গে বিমান দাঁড়িয়ে থাকে আমি কখনও দেখিনি। পরে অবশ্য দেখলাম এরকম আলাস্কায় বহু জায়গাতেই আছে। বিশেষ করে যাদের বাড়ি নদীর তীরে বা কোনও হ্রদের ধরে, তাদের বাড়ির সামনে গাড়ি এবং বিমান দুইই রাখা থাকে। সেই বিমানগুলো হল সি-প্লেন। অর্থাৎ তারা জল থেকেই ওঠা-নামা করতে পারে। গ্রীষ্মকালে নদী বা হ্রদের জল যখন তরল অবস্থাতেই থাকে তখন বাড়ির সামনে থেকে বিমানগুলো গিয়ে নামে নদীতে বা হ্রদে। তারপর সেখান থেকেই উড়ে যায়। আবার ফেরার সময় ও এসে নামে ওই জলের ওপরেই।
এই ছোট বিমানগুলো অনেকসময়ই ব্যবহার করা হয় পর্যটনের উদ্দেশ্যে। এছাড়া অনেক সময় হেলিকপ্টার ও ব্যবহার হয় পর্যটনের উদ্যেশ্যে। অপরূপা আলাস্কার প্রত্যন্ত প্রান্তরে বহু সুন্দর এবং রোমাঞ্চকর জায়গা আছে দেখার যেখানে যাওয়ার কোনও রাস্তাই নেই। মাঝখানে বিশাল সমুদ্র বা কোনো গহন অরণ্য অথবা সুউচ্চ কোনও পর্বত অথবা বিস্তীর্ণ কোনও হিমবাহ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে সেই সব প্রান্তরকে। তাই সেসব প্রান্তর দেখতে হলে বিমান বা হেলিকপ্টারই একমাত্র ভরসা।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫২: আলাস্কায় গ্রীষ্মকালে সাজো সাজো রব, সক্কলে ব্যস্ত

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯২: শ্রীমার সঙ্গে এক মেমসাহেবের কথোপকথন
এখানেই বলি আমার স্ত্রীর হেলিকপ্টারে ওঠার প্রথম অভিজ্ঞতার কথা। সেটা আমাদের বিয়ের পরের বছর। আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী। তো আমি পরিকল্পনা করলাম যে অঙ্কনা, অর্থাৎ আমার স্ত্রী এর জন্য চমকপ্রদ কিছু করতে হবে, মানে সাধারণ ভাবে যাকে আমরা বলি সারপ্রাইজ। নতুন বিয়ে, তার ওপরে জনাকীর্ণ কলকাতার মায়া কাটিয়ে সব কিছু ছেড়ে স্ত্রী এসে আছে পৃথিবীর এই পাণ্ডব বর্জিত, নির্জন, জনশুন্য প্রান্তে, তারওপর সে এসেছে ভরা শীতের মধ্যে যখন এখানে সবসময়েই অন্ধকার। না জানি কি না কি চলছে তার মনের মধ্যে। কাজেই প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে কিছু একটা তো করতেই হবে। তো অনেক ভেবে দেখলাম যে তাকে হেলিকপ্টারে করে হিমবাহের মধ্যে নিয়ে গেলে কেমন হয়। এসে অবধি সে কোনও হিমবাহ দেখেনি আর সে হেলিকপ্টারেও চড়েনি কোনওদিন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৮: গার্হস্থ্যজীবনে জ্যেষ্ঠ রামচন্দ্রের ভাবমূর্তি, তাঁর দেববিগ্রহে উত্তরণের একটি অন্যতম কারণ?

এপ্রিল ফুল
যেই ভাবা সেই কাজ। খবর নিয়ে জানলাম যে রাজ্যের দক্ষিণ প্রান্তে রয়েছে ম্যাটানুস্কা হিমবাহ। ফেয়ারব্যাঙ্কস থেকে প্রায় ঘন্টা ছয়-সাতেক গাড়ি করে যেতে হবে চিকালুন বলে একটা জায়গায়। সেখানে রয়েছে শীপ মাউন্টেন। সেখানে একটা জায়গা থেকে হেলিকপ্টার করে যাওয়া যায় ম্যাটানুস্কা হিমবাহের মধ্যে। স্ত্রীকে লুকিয়ে তাদের সঙ্গে একদিন কথা বললাম। আমার কথা শুনে তারা বুদ্ধি দিল যে গ্লেসিয়ার-পুল দেখার জন্য। যে হেলিকপ্টার চালিয়ে আমাদের নিয়ে যাবে সেই পাইলট বললো যে হিমবাহের অনেকটা ভেতরে নাকি একটা জায়গা আছে সেখানে গ্রীষ্মকালে কিছু সপ্তাহের জন্য হিমবাহের বরফ গলে গিয়ে একটা হ্রদের মতো হয়ে যায়। আর সেই হ্রদ পুরো আসমানী নীল রঙের হয়। মানে রোমাঞ্চকর এবং রোমান্টিক এই দুইয়ে মিলে প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর জন্য একেবারে আদর্শ জায়গা।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫৪: রবীন্দ্রনাথের ‘মুকুট’ ত্রিপুরার ইতিহাসাশ্রিত গল্প

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৪: মৌটুসি
তো বিবাহ বার্ষিকীর দিন যাত্রা শুরু করলাম। স্ত্রীকে বলেছি আলাস্কার দক্ষিণ দিকে রয়েছে মনোরম গ্লেন হাইওয়ে। সে দিকটায় যাওয়া হবে। আর ঘর থেকেই বিবাহবার্ষিকীর কেক ও তুলে নেওয়া হয়েছে। স্ত্রীকে বলেছি যে রাস্তায় যে জায়গাটা মনে হবে খুব সুন্দর সেখানেই আমরা বিবাহবার্ষিকী উদযাপন করবো। গ্রীষ্মকালে এই জিনিসটা আমরা মাঝে মাঝেই করে থাকি। কোথাও না কোথাও বেরিয়ে পড়ি। যে জায়গাটা দেখতে ভালো লাগে সেখানেই দাঁড়িয়ে অনেক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আবার বাড়ি ফিরে আসি। রাত একটা নাগাদ বেরিয়ে পড়া গেল।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৯: যে-আঁধার আলোর অধিক

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৭০: বিচারক
চিকালুনে হেলিকপ্টারে ওঠার সময় বেলা ১১টা। হাতে প্রায় দশ ঘন্টা সময়। ছ-সাত ঘন্টা গাড়ি চালানোর মধ্যে ঘণ্টা দুয়েক রাখলাম মাঝে মধ্যে একটু দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। তারপরেও আরও হাতে থাকছে ঘণ্টা দেড় দুয়েক মতো। তাছাড়া এই সময় রাস্তায় কাজ হয় বহু জায়গায়। সেখানে এক ঘণ্টা মতো দেরি হতেই পারে। যাই হোক, বলাই বাহুল্য যে ঠিক ওই সূর্যাস্তের সময়টাতেই আমরা বেরোলাম। আকাশে তখন মেঘের খেলা। ইংরেজি মতে রাত বারোটার পরেই শুরু হয়ে গেছে বিবাহ বার্ষিকী। কাজেই বাড়িতে যারা যারা আলাস্কার সময়টা জানে তারা সকলেই শুভেচ্ছা জানাতে শুরু করেছে। গাড়িতে যেতে যেতেই তাদের সঙ্গে কথা বার্তাও চলতে লাগলো। অবশ্য খুব বেশিক্ষণ কথা বলা যায় না। গোটা রাস্তার প্রায় সত্তর থেকে আশি শতাংশ জায়গায় ফোন বা ইন্টারনেট পরিষেবার বাইরে। —চলবে।
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।