
আলাস্কা পর্বতমালা।
সূর্যের উত্তরায়ণ (সামার সলস্টাইস) এবং দক্ষিণায়ণের (উইন্টার সলস্টাইস) কথাটা এই ফাঁকে বলে রাখলে ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধা হবে। উত্তরায়নের অর্থ হল, ওই সময় পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ (নর্দার্ন হেমিস্ফিয়ার) থেকে মনে হবে যে সূর্য তখন বিষুবরেখা বা নিরক্ষরেখা (ইকুয়েটর) থেকে রোজ একটু একটু করে উত্তরে অর্থাৎ উত্তর মেরুর (নর্থপোল) দিকে যাচ্ছে। ২২ ডিসেম্বর থেকে ২১ জুন পর্যন্ত সূর্যের উত্তরায়ণ চলতে থাকে।
এরই মধ্যে, উত্তরায়ণের শেষ দিন অর্থাৎ ২১ জুন হল সবচাইতে বড় দিন। উত্তরায়ণের ঠিক পরেই ২২ জুন থেকে ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলতে থাকে সূর্যের দক্ষিণায়ণ পর্ব (উইন্টার সলস্টাইস)। আর দক্ষিণায়নের শেষ দিন অর্থাৎ ২১ ডিসেম্বর হলো সবচাইতে ছোট দিন। অন্যদিকে এই উত্তরায়ণ এবং দক্ষিণায়ণ পর্বের ঠিক মাঝামাঝি দিন দুটো হলো বিষুব-অবস্থা (ইকুইনক্স)। বছরের এই দিন দুটোয় দিন এবং রাতের দৈর্ঘ্য একদম সমান সমান হয়। উত্তরায়ণ পর্বের ঠিক মাঝখানে অর্থাৎ ২১ মার্চ হল মহাবিষুব (স্প্রিং ইকুইনক্স বা মার্চ ইকুইনক্স) আর দক্ষিণায়ণ পর্বের ঠিক মাঝে ২১ সেপ্টেম্বর হল জলবিষুব (ফল ইকুইনক্স বা সেপ্টেম্বর ইকুইনক্স)।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৯: তমসো মা জ্যোতির্গময়: গ্রীষ্মকালে আলাস্কায় রোজদিন

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫২: ঠাকুর পরিবারের বালকদের অভিনয়ের সূত্রেই সৃষ্টি হয় ‘বিসর্জন’
এই জলবিষুব আর মহাবিষুবের দিন দুটো আর তার আগে পরে সবমিলে দেড় থেকে দু’ মাস মতো করে সময় সূর্য প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী পূর্বদিকে ওঠে আর পশ্চিম দিকে অস্ত যায়। মানে বছরে মোট তিন থেকে চার মাস সময় সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত হয় অন্যান্য জায়গার মতোই। বাকি আট থেকে ন’-মাস পুরোপুরি অন্যরকম। দক্ষিণায়ণের একদম শেষের দিনগুলো আর উত্তরায়ণের প্রথম দিনগুলোতে অর্থাৎ প্রায় নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সূর্য দক্ষিণ দিকে ওঠে আর সেদিকেই অস্ত যায়। এই সময়টা শীতকাল। অর্থাৎ কিনা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময় লাগে মাত্র দুই থেকে তিন ঘণ্টা। এই সময়টা বেশ মজার।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৫: বনবাসে অর্জুনের অসংযত জীবন, আশ্রয়দাতার বিশ্বাসভঙ্গ কি অনুসরণযোগ্য আচরণ?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮৯: উদ্বোধনের ঠাকুরঘরে মা সারদার সঙ্গে স্বামী অরূপানন্দের কথোপকথন
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণে আলাস্কা পর্বতমালা। আমার জানলা দিয়ে ঠিক সোজাসুজি তাকালে চার-পাঁচটা বেশ উঁচু পর্বতশৃঙ্গ বা পাহাড়ের চূড়া দেখা যায়। ওই সময় আমি রোজই দেখি একদম বাঁ দিকের চূড়ার থেকে সূর্যটা উঠল। পাশাপাশি দু-তিনটে চূড়া কোনওরকমে পার করে আবার ডানদিকের চূড়ার গা বেয়েই আবার ঢলে পড়ল অস্তাচলে।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯১: গো-শালিক

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৮: দুর্গম গিরি কান্তার ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’
কি অদ্ভুত প্রকৃতির খেয়াল। আমার এখনও সত্যিই খুব অবাক লাগে এই ভেবে যে এ-আমি কোথায় চলে এসেছি যেখানে কিনা মানুষের প্রচলিত সব ধ্যানধারণাকেও বর্জন করতে হয়। আমার স্ত্রীও ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়েই চাকরি পেয়েছে। তার জানলা দিয়ে এই ব্যাপারটা আরও ভালো লক্ষ্য করা যায়। তাই যখনই আকাশ পরিষ্কার থাকে সে তার মুঠোফোনে শুধু সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের ছবি তুলে যায়। আর রোজ বাড়িতে এসে খেলাচ্ছলে আমরা সেই ছবি বিশ্লেষণ করতে বসি। রোজই দেখার চেষ্টা করি যে আজ আগের দিনের থেকে সূর্যোদয়ের জায়গাটা থেকে সূর্যাস্তের জায়গাটার মধ্যে দূরত্ব বাড়ল কিনা।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৬: নীল রাত্রি, নীল অন্ধকার
সূর্যোদয়ের জায়গাটা থেকে সূর্যাস্তের জায়গাটার মধ্যে দূরত্ব বাড়তে বাড়তে কবে দক্ষিণ ছেড়ে সূর্য আবার পূর্ব দিকে উঠবে আর পশ্চিমে অস্ত যাবে, এই সব সাতপাঁচ ভাবনা। নেহাতই ছেলেমানুষি। কিন্তু এই ছেলেমানুষির সঙ্গে সঙ্গেই তৈরি হতে থাকে আমাদের সুন্দর আনন্দঘন মুহূর্তগুলো। সুদীর্ঘ নিশীথের ছোট্ট ছোট্ট অকারণ আনন্দ।—চলবে।
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।