ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস থেকে সেই দৃশ্য।
মনে হচ্ছিল আমাদের লক্ষ্য ফেয়ারব্যাঙ্কসের সোনার খনি। হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন আমি ঝাঁপ দিয়েছি সমুদ্রে। সমুদ্র তখন ঠান্ডায় জমে বরফ হয়ে আছে। সে কি অদ্ভুত সুন্দর। তার ওপরে ঝলমলে রোদ্দুর এসে পড়ছে। চারিদিক তা যেন হীরের মতো চকচক করছে। আর আমি সেই হীরের মতো বরফের মেঝের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছি। সূর্যের আলো বরফে প্রতিফলিত হয়ে এসে আমার চোখ ঝলসে দিচ্ছে। দূরে কিছু আর দেখতে পাচ্ছি না। আর ঠিক তখনই একটা বিশাল তিমি তার সর্ব শক্তি দিয়ে আশপাশের বরফ ভেঙে এসে আমায় আক্রমণ করেছে। আমি বাঁচার চেষ্টা করছি অথচ ঠান্ডায় আমার সব কিছু যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে, আর ঠিক তখনই একটা কাঠের উমিয়াক নৌকো করে আমার এস্কিমো সঙ্গীর দল চলে এলো আমাকে বাঁচাতে। ওদিকে দূরে বনভূমিতে আমি দেখতে পাচ্ছি একটা বিরাট ম্যামথ আর একটা ডাইনোসর নিজেদের মধ্যে লড়াই করছে। তার পিছনেই যেন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে সুউচ্চ ডেনালি পর্বতশৃঙ্গ। স্থান কালের অসীম বক্রতায় যেন আমি কোথায় তলিয়ে যাচ্ছি। কোথায় কি থাকা উচিত তার কোনও হিসেবে আর নেই। যা কিছু ঘটনা আলাস্কার ইতিহাস সম্পর্কে জেনেছি সবটুকু একসঙ্গে আমার চোখে সামনে যেন চলে এল। আমি যেন আরও বিভোর হয়ে যেতে থাকলাম।
সম্বিৎ ফিরলো হঠাৎ দু’ একটা ছিটে বৃষ্টির ফোটা গায়ে এসে পড়তে। নিজের মনে মনেই হেসে উঠলাম। এবার হোটেলে ফেরা উচিত। বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লেগে গেলে কালকের ইন্টারভিউতে মুশকিল হয়ে যাবে। তাই গাড়িতে উঠে চলে এলাম হোটেলে। পরের দিন সকালেই চলে গেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেদিন আর বড় একটা কল্পনার জগতে যাওয়ার সুযোগ পাইনি। সারাদিন ধরে চলল এর সঙ্গে, ওর সঙ্গে সাক্ষাৎকার, গবেষণার কথা। সেখানেও ফেয়ারব্যাঙ্কস সম্পর্কে জানতে পারলাম অনেক কিছুই।
আরও পড়ুন:
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৩৪: আমি হেঁটে চলেছি কোনও এক আলাস্কান এস্কিমো যাযাবরদের সঙ্গে
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—খলসি ও করঞ্জা
তবে সবচেয়ে অনুপ্রাণিত হলাম যেটা জেনে সেটা হল, যে এই অঞ্চলে বেঁচে থাকাটাই একটা গবেষণার মতো। বরফের ওপর পরিবহণ থেকে শুরু করে বাড়ি বানানো পর্যন্ত, এত ঠান্ডায় চাষবাস থেকে শুরু করে ব্যবসা বাণিজ্য করা পর্যন্ত, প্রত্যন্ত অঞ্চলে মেরুজ্যোতি দেখতে আসার জন্য পর্যটন থেকে শুরু, আজ মেরুজ্যোতি দেখা যাবে কিনা তার অনুমান করা থেকে শুরু করে, মেরুজ্যোতি বিশ্লেষণ করে এই সৌরমণ্ডল তথা মহাবিশ্বের ইতিবৃত্ত সম্পর্কে জানা পর্যন্ত সবটাই এখানে গবেষণা, সবটাই একটা অ্যাডভেঞ্চার। এইটা বুঝতে পারার পর থেকে আরও বেশি মরিয়া লাগছিলো এখানে চাকরিটা পাওয়ার জন্য। একে তো মেরুতে আসা আমার শৈশবের স্বপ্ন, তার ওপরে এমন জীবনযাত্রার মধ্যে মিলে মিশে থাকা গবেষণা ও অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ, বলাই বাহুল্য আমি সেদিন নিজের সবটুকু দিয়ে দিয়েছিলাম ইন্টারভিউয়ের জন্য।
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭০: পাভেল কোথায়?
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৮: খেলার ছলে এসেছিনু যেথা ‘হারজিৎ’-র পর্ব রাখিনু সেথা
ইন্টারভিউ যেমন চলার চলছিল। প্রচলিত নিয়ম মেনেই একজনের পর একজনের সঙ্গে আমার প্রশ্নোত্তরের পর্ব চলছিল। তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই যেমন গবেষণার খুঁটিনাটি নিয়েও কথা হচ্ছিল আবার তেমনি স্থানীয় বিষয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও কথা বার্তা হচ্ছিল। সকাল আটটা থেকে শুরু করে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত সারাদিন এমনই চলবে। বিভিন্ন অধ্যাপক এবং গবেষকদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার হওয়ার পর একটা সময় এল যখন আমাকে আমাদের কলেজের অধ্যক্ষ বা ডিনের সঙ্গে কথা বার্তা বলতে হবে। তো দেখলাম যে এই ডিন মহাশয় বেশ আমুদে লোক। খুব হইচই করতে ভালোবাসেন। নিজের একটা গানের দল বা ব্যান্ডও আছে। তার সঙ্গে সাক্ষাৎকার শুরু হতেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি যদি ক্লান্ত না থাকো তাহলে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়টা ঘুরতে ঘুরতেই তোমার সঙ্গে কথা হতে পারে।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৪: পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে
এমন ধারা-বর্জিত, অপ্রচলিত, আটপৌরে ভঙ্গিমায় সাক্ষাৎকারে একটু অসুবিধাই হয়। কারণ অনেক সময়েই অসতর্ক ভাবে ভুলভাল কিছু বলে ফেললে মুশকিল হয়ে যায়। কিন্তু এতো সুন্দর দেখতে লেগেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরটা ইন্টারনেটে, সেটাকে সেদিনই হেঁটে ঘোরার সুযোগটা আর ছাড়তে পারলাম না। চাকরি হবে কি হবে না সে তো আর জানি না সেদিন। কাজেই কাজেই এসেছি যখন তখন সবটা ঘুরে একবার দেখে নেওয়া যাক। তো, ডিন মহাশয় আমাকে ঘুরে ঘুরে এক এক করে সব কিছু দেখাতে লাগলেন। —চলবে।
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।