রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


ছবি: অঙ্কনা চৌধুরী।

এই অধ্যায় শেষ করার আগে যাকে নিয়ে না বললেই নয়, তিনি হলেন আমাদের সবার আদরের চাঁদমামা। শীতকালে মাসের পর মাস অন্ধকারের মধ্যে বসে বসে চাঁদের যে রূপ দেখি, বাংলার কবিদের মতো আমার প্রতিভা থাকলে শুধু চাঁদের ওপরই দু’ তিনটে কবিতা লিখেই ফেলতে পারতাম। কিন্তু সে প্রতিভা বলাই বাহুল্য যে আমার নেই। কাজেই প্রথমেই বলে রাখি যে, এখানকার চন্দ্রোদয়ের অসাধারণ দৃশ্য আমার ভাষায় প্রায় অব্যক্ত। তবুও এই গদ্যময় মানব জীবনে তার কাব্যিক রূপকে বর্ণনা করার একটু ইচ্ছা জাগে বৈকি। তাতে সূর্যোদয়ের রং নেই, মেঘের খেলা নেই। আলো ঝলমল পৃথিবীর রূপও তাতে ফুটে ওঠে না। কিন্তু সাদা বরফের প্রেক্ষা পটে অর্ধবর্ষব্যাপী সে অপরূপ স্নিগ্ধতাকে ভাষার বন্ধনে বছরের পর বছর আটকে রাখার ইচ্ছা হয়।
একদিকে পৃথিবীর যতরকমের ধুলোময়লা মলিনতা সব যেন ঢেকে যায় এই শীতকালে। হয় রাতের আঁধারে তাকে আর বোঝা যায় না অথবা সাদা বরফের নিচে তারা তলিয়ে যায় ধরিত্রী গহ্বরে। চারিদিকে যেন এক অদ্ভুত পবিত্রতা। যে মাটিকে গতকাল মাড়িয়ে গিয়েছি নোংরা করে গিয়েছি তাকে পরের দিনই প্রকৃতি ঢাকা দিয়ে দেয় নতুন বরফের চাদরে। রোজই যেন এক নতুন শ্বেতশুভ্র পৃথিবী শান্তির বার্তা বহন করে আনে। যত পাপ সব যেন ধুয়ে যায় একনিমেষে। আর তার ওপরে চাঁদের স্নিগ্ধ আলো যেন তাকে আরো পবিত্র করে তোলে। যেন আরও শান্তি।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-২৯: উপত্যকার ট্রথ-ইয়েদ্ধার দিকটা বেশ অন্ধকার, ধূসর মলিন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৬: যন্ত্রণাদগ্ধ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রাঁচিতে পেয়েছিলেন সান্ত্বনার প্রলেপ

লোক নেই, জন নেই, চিৎকার নেই, শহুরে ব্যস্ততার লেশটুকুও নেই। শুধুই একরাশ শান্তি যাকে রাতের পর রাত অনুভব করা যায় কোনও একঘেয়েমি ছাড়াই। শুধুই একরাশ পবিত্রতা যাকে মাসের পর মাস গায়ে হাতে পায়ে মেখে নেওয়া যায় কোনো ক্লান্তি ছাড়াই। আর শুধু একরাশ স্নিগ্ধতা যার দিকে তাকিয়ে এই সুদীর্ঘ নিশিযাপন করা যায় কোনও মানসিক অবসন্নতা ছাড়াই। ছোটবেলা থেকে সূর্যোদয়ের মনোরম দৃশ্য দেখার জন্য ছুটে ছুটে গিয়েছি দীঘার সমুদ্রসৈকত থেকে দার্জিলিঙের পাহাড় পর্যন্ত। কিন্তু চাঁদ ও যে কোনও জায়গায় এতো সুন্দর হয়ে উঠতে পারে তা এখানে আসার আগে আমার জানা ছিল না।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২১: গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী—এক শক্তির গল্প

শীতকালে এখানে চাঁদ ওঠে একদম দিগন্তের থেকে। আর চাঁদটা ওঠে ঠিক এই এত্তটা বড় হয়ে। দিগন্তে তাকে অনেকটা বড় দেখা যায়। আবার আস্তে আস্তে যখন মাথার ওপরে আসে তখন আবার ছোট হয়ে যায়। এই ঘটনাটাকে বলা হয় লুনার অপটিক্যাল ইল্যুশন বা চাঁদের আলোক বিভ্রান্তি। অর্থাৎ পদার্থবিদ্যার বা আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে আলোক বিজ্ঞানের নিয়মানুযায়ী এবং চাঁদ ও পৃথিবীর কৌণিক অবস্থান বিচার করলে তাকে বড় দেখার কোনওই কারণ নেই। অথচ তবুও তাকে অনেকটা বড় মনে হয়। তাই এই ঘটনাকে আলোক বিভ্রান্তি বলেই ধরা হয়। এখন, নিম্ন অক্ষাংশে অর্থাৎ, নিরক্ষরেখার যত কাছাকাছি যেতে থাকবো আমরা চাঁদকে ততই কম দিগন্তের কাছে দেখতে পাবো।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬১: মহাভারতের রাক্ষসরা কী আজও বর্তমান? প্রসঙ্গ— বকরাক্ষসবধ

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৪: সারদা মায়ের মানসিক দৃঢ়তা

ভারত বা অন্যান্য ক্রান্তীয় দেশ গুলো থেকে সেটা কখনওই দেখা যায় না। একটু ভালো করে চিন্তা করলেই দেখা যাবে যে চাঁদকে আমরা কিন্তু সবসময়ই দেখি প্রায় মধ্য গগনে মাথার ওপরে। এর কারণ হল চাঁদের কক্ষপথের যে সমতল সেটা পৃথিবীর কক্ষপথের সমতলের সঙ্গে পাঁচ ডিগ্রি কোণে আনত এবং এই কৌণিক অবস্থানের জন্যই পৃথিবীর সব জায়গা থেকে দিগন্তের কাছে চাঁদকে দেখা সম্ভব নয়। অপেক্ষাকৃত উচ্চ অক্ষাংশের জায়গা গুলো থেকে দিগন্তের কাছে চাঁদকে দেখার সম্ভাবনা থাকলেও যখন চাঁদ ওই দিগন্তের কাছাকাছি থাকে তখন সূর্যের আলো থাকে অনেকটা। তাই তাকে ভালো করে দেখাই যায় না।

কিন্তু এই উত্তর মেরুতে আবার পৃথিবী ও সূর্যের আপেক্ষিক অবস্থানের জন্য শীতকালে সবসময়েই রাত। কাজেই চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙে দেয় প্রতিদিন আর এই মন জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে আমরাও গল্প করি সারাদিন বা বলা ভালো সারারাত, রাতের পর রাত। তার ওপরে, আমার ঘরের দেওয়াল জোড়া জানলাটা পূর্বমুখী আর সামনেটা পুরোটা খোলা। তাই চাঁদের এই আহ্নিক গতির অসাধারণ রূপ আমরা দেখি শীতকালের প্রায় প্রতিদিনই। কাজেই সবার থেকে দূরে, আমাদের এই ছোট্ট পরিবারে তৃতীয় ব্যক্তি বলতে শুধুমাত্র ওই চাঁদ মামা। তাই শীতকালের প্রতি রাতে তাকে ঘিরেই আমাদের বেঁধে বেঁধে থাকা, রাজ্যের প্রেম, মান-অভিমান, খুনসুটি, রোমাঞ্চ, সবকিছুই।

ছবি: অঙ্কনা চৌধুরী।

দাম্পত্য জীবনের শুরুতে আমাদের দু’ জনের সব রকমের অনুভূতির প্রায় সবটুকুই তাকে ঘিরে। জানলা দিয়ে তার চুইয়ে পড়া স্নিগ্ধ আলোয় সময়ের হিসেবে ছাড়াই শুরু করা যায় ক্যান্ডেল লাইট ডিনার। আবার দিনের যেকোনও সময়েই চন্দ্রাহতের (লুনাটিক) মতো বেরিয়ে পড়া যায় অজানা রোমাঞ্চের উদ্দেশ্যে। আবার কখনও বা শুধুমাত্র তার দিকে চেয়েই কেটে যায় সারা রাত, মেরুপ্রদেশের শীতকালের প্রতি রাত। আর সঙ্গে চলতে থাকুক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে চিরদিনের সেই গান:
এই রাত তোমার আমার
ওই চাঁদ তোমার আমার
শুধু দুজনে।
তুমি আছো আমি আছি তাই
অনুভবে তোমারে যে যাই
শুধু দুজনে।

—চলবে।
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।

Skip to content