বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


মেরুজ্যোতির খেলা। ছবি: অঙ্কনা চৌধুরী।

কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি নিয়ে হাজির বন্ধু সস্ত্রীক। গন্তব্য ক্লিয়ারি সামিট। তবে গন্তব্য অবধি যাওয়ার আর দরকার পড়ল না। শহরের আলো ছাড়াতেই আতশবাজির মতো যেন আকাশ থেকে ঝরে পড়তে লাগলো সৌরঝড় তথা মেরুজ্যোতি। সে কি দৃশ্য। কোনও পার্থিব জিনিসের সঙ্গে যেন তার তুলনা চলে না।
এ যেন সত্যিই ‘প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা। আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি অসীম ছন্দে বেজে উঠে রূপলোক ও রসলোকে নিয়ে এসেছে ভাব মাধুরীর সঞ্জীবন’, আশৈশব আকাশবাণীতে বিরূপাক্ষের কণ্ঠে শুনে আসা মহালয়ার মাতৃবন্দনার এ যেন সত্যিকারের দৃশ্যায়ণ। অথবা ঠিক যেন বড় পর্দায় দেখা মহাভারতের অর্জুনের ধনুক থেকে নিক্ষেপিত আলোকময় এক বাণ, যা হাজার হাজার প্রতিরূপে বিভাজিত হয়ে একসঙ্গে আছড়ে পড়তে চাইছে কৌরবের সেনাবাহিনীর ওপরে। অথবা কোনও বিদেহী আত্মার মিছিল, অন্তরের দীপশিখা জ্বালিয়ে তারা পাড়ি জমিয়েছে পরপারের উদ্যেশ্যে।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-২৭: সে বার মেরুজ্যোতি দেখার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ভাষায় ব্যক্ত করা অসম্ভব

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা

আমরা চারজন কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছি না। শুধু দেখে চলেছি আকাশ জুড়ে রঙের খেলা। কখনও সবুজ, কখনও বেগুনি, কখনো বা কমলা। কালো আকাশের গায়ে যেন এক বিশাল রামধনু ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছে। আর তার সব ক’টা টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে এদিকে-ওদিকে। অথবা মনে পড়ে যায় বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পল জেসন পোলকের কথা। তিনি যেন সেই রামধনুকে গলিয়ে তার সবকটা রংকে নিকষ কালো আকাশের ক্যানভাসে অসংলগ্ন ভাবে ছুঁড়ে ছুঁড়ে একের পর এক নিরন্তর সৃষ্টি করে চলেছেন চলেছেন তাঁর বিখ্যাত স্প্ল্যাটার পেইন্টিংগুলি।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬২: ধনময়ী জ্ঞানময়ী-র পাশে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৩: সুন্দরবনের পশ্চিমাংশে ম্যানগ্রোভ

তবে শুধু মেরুজ্যোতি নয়। উচ্চ অক্ষাংশে হওয়ার কারণে এখানে আরও বিবিধ রকমের মহাজাগতিক কার্যকলাপ দেখা যায়, যা কিনা আমরা পৃথিবীর মেরু অঞ্চল ছাড়া সাধারণত দেখতে পাই না। যেমন একই জায়গায় দাঁড়িয়ে একদিকে বেশ আলো এবং অন্য দিকে আবার ঘন অন্ধকার। এটা মূলত হয় ঘণ্টা দুয়েক, দিনের আলোর শেষে যখন সূর্য ডুবে যায়। ঘটনাটা সব থেকে ভালো দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বসার ঘর থেকে। এটাও একদিন হঠাৎই লক্ষ্য করেছিলাম।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৯: কামিনী রায়, জনৈক বঙ্গমহিলা

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪১: মা সারদার অন্তরঙ্গ সেবক শরৎ মহারাজ

আগেই বলেছি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টি একটা ছোট্ট পাহাড় বরাবর নিচ থেকে ওপরে উঠে গিয়েছে। পাহাড়টির নাম ট্রথ-ইয়েদ্ধা। কম্পিউটার সায়েন্স অর্থাৎ আমার বিভাগটি হল এই ট্রথ-ইয়েদ্ধার মাঝামাঝি পাঁচতলা উঁচু ভবনের একদম ওপরের তলায়। আমার ঘর থেকে জানলা দিয়ে দেখা যায় শহরের আশেপাশের পাহাড়গুলোও। আবার তাদের পিছনে অনেক দূরে আলাস্কা পর্বতমালার কিছুটা অংশও দেখা যায়। ট্রথ-ইয়েদ্ধা আর আশেপাশের পাহাড়গুলোর মধ্যে এক বিস্তীর্ণ উপত্যকা। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। পাহাড়, পর্বতমালা, উপত্যকা—সব মিলিয়ে আমাদের চেনা পৃথিবীরর সে এক অপার্থিব রূপ। —চলবে।
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।

Skip to content