আকাশ ভরা মেরুজ্যোতি। ছবি: অঙ্কনা চৌধুরী।
আলাস্কায় আমার আরেক বাঙালি সহকর্মী থাকেন সপরিবারে। পতি-পত্নী দু’ জনেই এখানে মেরুপ্রদেশীয় পরিবেশ নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁরাও এই মেরুজ্যোতির ব্যাপারে বিরাট উৎসাহী। মুঠোফোনের অ্যাপে কেপি ইনডেক্স ৪ ছুঁয়েছে কি ছোঁয়নি তাদের ফোন চলে এলো। রাতের দিকে এমন হুট করে তাদের ফোন দেখলেই বুঝতে পারি যে, একসঙ্গে মেরুজ্যোতি দেখতে যাওয়ার জন্য ডাকছে। তখন তড়িঘড়ি দুই পরিবারের চার জন সবাই মিলে গাড়ি চালিয়ে চলে যাই, হয় ক্লিয়ারি সামিট, আর নয় তো মার্ফিডোম।
বেশিক্ষণ এই ঠান্ডার রাতে শহরবন্দি আমাদের একমাত্র বিনোদন। তবে বলাই বাহুল্য, সে বিনোদন বড় কম নয়। পরমা প্রকৃতির এমন খেয়াল খুশি প্রাণভরে দেখার জন্যই তো আমরা এসেছি এখানে। পৃথিবীর এই শেষ প্রান্তে, সবার থেকে দূরে শুধু প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে। এ যেন হিন্দি ছায়াছবির গানের সেই ‘আজীব দাস্তান’, যেখানে ‘মুবারকে হামহে কে হাম, কিসিকে নূর হো গ্যায়ে…. কিসিকে ইতনে পাস হো, কে সবসে দূর হো গ্যায়ে।’
আরও পড়ুন:
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-২৬: কেপি ইনডেক্স ৮ ছুঁলেই আলাস্কার আকাশে সে এক স্বর্গীয় অনুভূতি
ঠাকুরবাড়িতে দোলে আসত নাচিয়ে, নাচের তালে তালে হত আবিরের আলপনা
তবে এ বার বলি মেরুজ্যোতি দেখার সবচেয়ে ভালো অভিজ্ঞতার কথা, অর্থাৎ যেদিন কেপি ইনডেক্স ৮ ছুঁয়েছিল, সেদিনের কথা। সেই রূপ আর অনুভূতি ভাষায় ব্যক্ত করা প্রায় অসম্ভব। তবুও চেষ্টা করছি। ছবিও তুলেছিলাম। কিন্তু সে শুধুই দিনটাকে স্মৃতিতে ধরে রাখার জন্য। তাতে তার সৌন্দর্যের সিকিভাগ ও বোঝার উপায় নেই। পাঠকেরা নিজের কল্পনা শক্তি মিশিয়ে এক অতিলৌকিক দৃশ্যপট কল্পনা করে নিতেই পারেন।
আরও পড়ুন:
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫০: অর্ধশতাব্দী ছুঁলো ‘অমানুষ’
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪১: সুন্দরবনে বাঘে-মানুষে সংঘাত
সে যাই হোক, সেদিন রাতে দেখি আমার মুঠোফোনে যথারীতি আমার সহকর্মী তথা বন্ধু প্রবরের ফোন এসে গিয়েছে। দেখেই বুঝলাম মেরুজ্যোতি দেখতে যাওয়ার জন্য বলবে। ভাবলাম যে প্রতিবারের মতো এ বারেও হয়তো অ্যাপ মারফত জানতে পেরেছে যে রাতের দিকে কেপি ইনডেক্স খানিকটা বাড়বে। সেই জন্য তৈরি হয়ে থাকতে বলবে যাতে যখন দরকার তখন বেরিয়ে যাওয়া যায়। আমি আমার গবেষণার কাজে একটু ব্যস্ত ছিলাম। তাই আর ফোনটা তুললাম না। ভাবলাম যে খানিক পরে তাকে ফোন করে কথা বলে নেবো। তারপরে দেখি আবার ফোন বাজছে। পরের বারও তুলিনি। তারপর আবার দেখি তৃতীয় বার ফোন বাজছে। তখন আমি ভাবলাম যে, তাহলে হয়তো কোনও জরুরি দরকারে ফোন করছে।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৭: তিনটি মেয়ের তিনটি কলম!
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৯: ইন্দুমতী ও সুরবালা
তড়িঘড়ি গিয়ে ফোনটা তুললাম। ফোন তোলা মাত্রই সে বলতে শুরু করলো। কোনও রকম সম্ভাষণ কিছু না করেই সটান আমাকে আর আমার সহধর্মিণীকে তক্ষুনি তৈরি হয়ে নিতে বললো। তারা নাকি ইতিমধ্যেই রাস্তায়। এখনই আসছে গাড়ি নিয়ে আমাদের তুলতে। আমি কিছু কারণ জিজ্ঞাসা করার আগেই সে বললো, কেপি ইনডেক্স নাকি আট-এ ঠেকেছে। সে এখানে প্রায় পাঁচ বছরের ওপর রয়েছে। কোনওদিনও এমন দেখেনি। ব্যাস। শোনামাত্র আমি আর আমার সহধর্মিনী সঙ্গে সঙ্গে কোনওরকমে গায়ে শীতবস্ত্র চাপিয়ে নিলাম। মিনিট তিনেকের মধ্যেই গাড়ি নিয়ে চলে এল বন্ধু এবং বন্ধু-পত্নী। গন্তব্য ক্লিয়ারি সামিট। —চলবে।
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।