যেদিকে চোখ যায় শুধুই বরফ। ছবি: অঙ্কনা চৌধুরী।
মেরুজ্যোতি সৃষ্টির পেছনে বৈজ্ঞানিক কারণ হল, মহাজাগতিক বা বলা ভালো সৌরমন্ডলের (সোলারসিস্টেম) মধ্যেই তৈরি হওয়া তড়িৎচুম্বকীয় (ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক) ঝড়। প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে, পৃথিবী নিজেও একটি বড় চুম্বকের মতো। আর আলাস্কা সেই চুম্বকের ঠিক উত্তরমেরুতে অবস্থিত। অর্থাৎ এই অঞ্চল সৌরমণ্ডলের বিভিন্ন রকমের তড়িৎচুম্বকীয় পদার্থকে আকর্ষণ করে।
এ বার সূর্যের দিকে দেখা যাক। সূর্য একটি বিরাট আগুনের পিণ্ড যার মধ্যে বহু গ্যাসীয় পদার্থ এবং ধাতব পদার্থ ভৌত ও রাসায়নিক পদ্ধতিতে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে আবার গলে যাচ্ছে। একে বলা যেতে পারে সৌর কার্যপ্রণালী বা সোলার অ্যাকটিভিটি। এখন এই কার্যপ্রণালীর মাত্রা সূর্যের কিছু কিছু জায়গায় একটু বেড়ে গেলে সেখানে এই ধরণের পদার্থ তৈরি এবং বেড়ে যায়, আবার অন্য জায়গায় তৈরির পরিমাণ কমে যায় বা একই রকম থাকে। তখন সাম্যতা বজায় রাখার জন্য কিছু রাসায়নিক পদার্থ সূর্য থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে। একে বলে সৌর ঝড় বা সোলার স্টর্ম।
আরও পড়ুন:
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-২৩: আলাস্কার অন্ধকার আকাশে যখন সবুজ মেরুজ্যোতি বেরোয়, তখন সব কষ্ট-ভয় নিমেষে দূর হয়ে যায়
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১: রাজমালা ও ইতিহাসের আলোকে ত্রিপুরা
তবে এই ঝড়ের মধ্যে পৃথিবীর বায়ু মন্ডলের মতো ধুলোবালি বা জলকণা বা বৃষ্টি থাকে না। সেই জায়গায় থাকে সূর্য থেকে নির্গত প্রচুর ধাতব পদার্থ যারা চুম্বকের দ্বারা আকৃষ্ট হয়। তার বেশিরভাগটাই ছিটকে এদিক-ওদিক চলে যায়। তবে তারই মধ্যে কিছুটা পরিমাণ পৃথিবীর মেরুর চুম্বকীয় ধর্মের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে ঢুকে পড়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে। এখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে এসে বিভিন্ন রকম পদার্থের সঙ্গে ঘষা লেগে তারা জ্বলে যায় পৃথিবীতে এসে পৌঁছনোর আগেই। সেই জ্বলে গিয়ে যে আলো তৈরি হয় সেটাই দেখা যায় মেরুজ্যোতি হিসেবে। এখানে উত্তরমেরুতে তাকে বলে উত্তরমেরুজ্যোতি বা নর্দার্ন লাইটস বা অরোরা বোরিয়ালিস আর দক্ষিণমেরুতে তাকে বলে দক্ষিণমেরুজ্যোতি বা সাউদার্ন লাইটস বা অরোরা অস্ট্রিয়ালিস।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৬: বহু জনমের মায়া, ধরিল যে কায়া, ওগো ‘শিল্পী’ সে তো শুধু তোমারই ছায়া
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৬: সারদা মায়ের ছোটকাকা ও পুত্রপ্রতিম স্বামীজির জীবনাবসান
এখন ভূচুম্বকীয় ধর্মের জন্য পৃথিবীর মেরু এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আমাদের মাথার ওপরে ঠিক ওপরে মহাকাশে আবার একটি নির্দিষ্ট উপবৃত্তাকার কক্ষপথে এই সৌরপদার্থ গুলি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বেশি মাত্রায় ঢুকতে থাকে। এই উপবৃত্তটিকে বলা হয় অরোরাল ওভাল বা মেরুজ্যোতি-বৃত্ত। সেই কারণেই কেবলমাত্র মেরু অঞ্চলেই এই আলো দেখা যায়। আর ফাইডব্যাংকস শহরটি এই মেরুজ্যোতি-বৃত্তের ঠিক নিচে অবস্থিত। তাই এখানে মেরুজ্যোতি দেখা যায় প্রচণ্ড স্পষ্ট ভাবে সারা শহরের যেকোনো জায়গা থেকেই।
মেরুজ্যোতি। ছবি: অঙ্কনা চৌধুরী।
এই মেরুজ্যোতি হল আমাদের অর্থাৎ এই প্রান্তে বসবাসকারী প্রত্যেকটি মানুষের সাধারণ প্রেম। ভালোবেসে তাকে সবাই ডাকে ‘গ্রিন লেডি’। ছোট থেকে বড়, পুরুষ থেকে নারী, আবালবৃদ্ধবণিতা সবাই তার প্রেমে পাগল। তার প্রেমে বিভোর হয়ে কবিতা লিখতে গিয়ে পাতার পর পাতা ভরিয়ে ফেলে কেউ কেউ। কেউ বা আবার তার ছবিতেই ভরিয়ে ফেলে ক্যামেরা এবং মুঠোফোন। আবার শুধুমাত্র তাকে কিছুক্ষণ মন ভরে দেখার জন্য দেখার জন্য কেউ কেউ ছুটে যাচ্ছে শহরের বাইরে বিপজ্জনক রাস্তায় গাড়ি চালানোর সমস্ত বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে। অথবা চূড়ান্ত ঠান্ডার মধ্যে জীবনের মায়া তুচ্ছ করে হেঁটেই পাড়ি জমাচ্ছে ‘এই শহর থেকে আরো অনেক দূরে’ তার সঙ্গেই কোথাও চলে যাওয়ার জন্য। তাকে ছুঁতে ইচ্ছা করে তবু তাকে ছোঁয়া যায় না। —চলবে।
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।