খুব স্বাভাবিক একটা সাধারণ দিনও তুষারঝড়ে খুব বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে কোন সময় ছাড়াই। সেই রকমই একটা ঘটনা ঘটেছিল আমাদের সঙ্গেও। আমাদের বলতে, আমি আর আর সহধর্মিনী। গত দু’ তিন দিন ধরেই আবহাওয়ার খবরে বলছে যে, একটা তুষার ঝড় আসছে। কিন্তু এসে পৌঁছয়নি। এদিকে আমার পত্নী-মহাশয়া কোনওদিন তুষারঝড় দেখেনি বলে সারা দিন ধরে ঝড় দেখবো ঝড় দেখবো করে চলেছে। আমি বার বার তাকে বলেছি, প্রার্থনা করো যেন ওই তুষারঝড় দেখতে না হয়। এর আগের বছর আমার যা অবস্থা হয়েছিল সেটা খুব একটা ভালো অভিজ্ঞতা নয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
ঈশ্বরও যে কখন কার প্রার্থনা কীভাবে স্বীকার করে নেন, তা আর কে বলতে পারে। ওর প্রার্থনাও যে এ ভাবে স্বীকৃত হবে তা সে নিজেও ভাবেনি। সে ভেবেছিল ঘরের মধ্যে বসে কাঁচের জানলার ওপারে দেখবে ঝরঝর করে বরফ পড়ে চলেছে সারা দিন ধরে। হাতে থাকবে চা বা কড়া কফির একটা পেয়ালা। মাঝে মধ্যে লম্বা বরফের জুতো পরে বাইরে বেরিয়ে দেখে আসবে কত ফুট বরফ জমলো। এই রকম সব কল্পনা।
আরও পড়ুন:
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-২০: আলাস্কার শীতের রাস্তায় লুকিয়ে থাকে মরণফাঁদ
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩২: সরকারবাড়ির ছেলেদের সঙ্গে শ্রীমার বুড়ি-বুড়ি খেলা
এ দিকে ঈশ্বরের পরিকল্পনা ছিল অন্য। সেই গল্পই বলবো এ বার। সেদিন ঘুম থেকে উঠেই দেখি হালকা হালকা বরফ পড়ছে। আমাদের সেদিন এখানকার স্থানীয় একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিজ্ঞানমেলার (সায়েন্সফেয়ার) বিচারক হয়ে যাওয়ার কথা। এখানে এটাই রীতি। স্থানীয় বিদ্যালয়ে এরকম কোনও কিছু হলেই বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, তাদের পরিবার, ছাত্রছাত্রী, সবাইকেই আমন্ত্রণ জানায় বিচারের কাজ করার জন্য।
বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েরা কেমন সুন্দর সুন্দর জিনিস বানিয়ে আনে আর আধো আধো কথায় বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির বিভিন্ন রকম তত্ত্বগুলো ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। আমাদের দেখতে বেশ মজা লাগে। তাই যখনই এমন আমন্ত্রণ আসে আমি আর খুব একটা না করি না। তার ওপর, এই অঞ্চলে লোকজনও তো খুব কম। তো ওই বিজ্ঞানমেলার সূত্রে সবার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎও হয়ে যায়।
বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েরা কেমন সুন্দর সুন্দর জিনিস বানিয়ে আনে আর আধো আধো কথায় বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির বিভিন্ন রকম তত্ত্বগুলো ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। আমাদের দেখতে বেশ মজা লাগে। তাই যখনই এমন আমন্ত্রণ আসে আমি আর খুব একটা না করি না। তার ওপর, এই অঞ্চলে লোকজনও তো খুব কম। তো ওই বিজ্ঞানমেলার সূত্রে সবার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎও হয়ে যায়।
আরও পড়ুন:
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৯: খ ব র দা র
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৮: ষাট-বাষট্টি, বড়োজোর সত্তর বছর বাঁচবেন রবীন্দ্রনাথ, বলেছিল এক গণৎকার
সে যাই হোক, আমার বাড়ি থেকে এই প্রাথমিক বিদ্যালয়টি পাঁচ মাইল মতো দূরে। সাধারণত গাড়ি চালিয়ে যেতে সময় লাগে ১০ মিনিট মতো। আর রাস্তায় বরফ থাকলে সেটা হয় ২০মিনিট মতো। তো, সকাল ৯টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম সেখানে। সবার সঙ্গে বেশ দেখা সাক্ষাৎও হল। সব কাজ মিটতে মিটতে লেগে গেলো প্রায় দু-আড়াই ঘন্টা। সব সেরে বেরোলাম ওই ১২টা নাগাদ। বেরিয়েই দেখি খুব জোরে বরফ পড়ছে। আর গাড়ির কাছে গিয়ে দেখি ওই টুকু সময়ের মধ্যেই গাড়ির ওপরে বরফ জমেছে প্রায় এক ফুট থেকে দেড় ফুটের মতো। তখনই আমরা বুঝেছি যে তুষার ঝড় এসে গিয়েছে।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৪: সুন্দরবনের মৃত ও মৃতপ্রায় নদী
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১০: লীলা মজুমদার— নতুন রূপকথার হলদে পাখি
এমন পরিস্থিতিতে ভাবলাম মাত্র তো পাঁচমাইল দূরে। ঠিক পৌঁছে যাবো। রাস্তায় বেরিয়েই প্রথম যে সমস্যাটা হল সেটা হচ্ছে চাকা প্রচণ্ড পিছলে যাচ্ছে। তার আসল কারণ, আমার নিচু গাড়ি এবং ছোট চাকা। ইতিমধ্যে বলে রাখা ভালো যে সবার কথা অমান্য করেই আমি এই আলাস্কার মতো জায়গাতেও একখানি দামি অডি গাড়ি কিনেছি। সেটি একটি সেডান মডেলের গাড়ি। অর্থাৎ মাটি আর গাড়ির তলাটুকুর মধ্যে ব্যবধান খুব কম। তাতে করে সমস্যাটা হল গাড়ির মাঝে মাঝি অঞ্চলটার তলায় যখনই প্রচুর বরফ চলে আসছে গাড়ির দু’ পাশের চাকা আর মাটিতে ভালোভাবে ছুঁচ্ছেনা। তাই গাড়ি খুব আস্তে আস্তে চালালেও গাড়ি পুরো নৌকোর মতো ভাসছে আর টলমল করছে।
তবে এরকম অভিজ্ঞতা আমার আগের বছরও হয়েছে। এমন কিছু নতুন নয়। কাজেই চললাম ওই রকম টলমল করতে করতেই। আমার সহধর্মিনী সবে এসেছে। সে ওই রকম গাড়ি টলমল করতে দেখে ইতিমধ্যেই একবার জানিয়ে দিয়েছে যে, সে আর তুষার ঝড় দেখতে চায় না। মনে মনে ইষ্টনামও জপতে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু বিপদের তখন সবে শুরু। এরপরে যেটা হল সেটা প্রায় প্রাণঘাতীর সমান!
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।