আলাস্কার আকাশ।
আমি পিএইচডি করছিলাম যে অধ্যাপকের সঙ্গে অর্থাৎ আমার পিএইচডি অ্যাডভাইসর ছিলেন কাজের ব্যাপারে প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী। আমি একপ্রকার নিশ্চিত ছিলাম, তিনি আমাকে আলাস্কা যাওয়ার ছুটি কোনও মতেই সে-সময় দেবেন না। তাই ওই অভিবাসন সংক্রান্ত মিথ্যে কথা বলতে হয়েছিল। যদিও এমন মিথ্যাচার খুব একটা কৃতিত্বের ব্যাপার নয় মোটেই। অধ্যাপক হিসেবেও আমার এটা বলতে বেশ লজ্জাই লাগছে। কিন্তু এই ঘটনাটা বেশ মজার এবং এটা থেকেই বোঝা যাবে যে আমি আলাস্কা আসার ব্যাপারে কতটা পাগল এবং একরোখা ছিলাম।
আরও একটা ব্যাপার হল, এই সময় আলাস্কা ঘুরতে এসেই আমি আমার বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ ইউনিভার্সিটি অফ আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস সম্পর্কে প্রথম জানতে পেরেছিলাম। তার আগে আমার ধারণাও ছিল না যে আলাস্কায় কোনও বিশ্ববিদ্যালয় আছে বলে। যদিও সব কিছু জানতে পারিনি। তবুও তখন থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি একটা সুপ্ত ভালোলাগা তৈরি হয়েছিল। একবারের জন্য হলেও ভেবেছিলাম যে যদি কখনও সুযোগ পাই, তাহলে এখানে আসব কাজ করতে, আমার ছোট বেলার ইচ্ছে পূরণ করতে।
আরও পড়ুন:
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৩৯: নির্জন প্রান্তরেই আমার মনের কথা শুনতে পাই
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৩: দুই মহর্ষির দ্বন্দ্বে কি ‘ইতি ও নেতি’র বিরোধেরই প্রতিফলন?
বিষয়টি একটু খুলেই বলি। আমি তখন পিএইচডি করছিলাম যুক্ত রাষ্ট্রের একদম দক্ষিণে লুইজিয়ানা রাজ্যে লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটি বা সংক্ষেপে এলএসইউ-তে। আমার পিএইচডি অ্যাডভাইসর ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষ। আমার অভিজ্ঞতায় সে দেশের প্রায় সমস্ত মানুষই সহজাত ভাবেই বেশ কঠোর পরিশ্রমী এবং খুব নিয়মানুবর্তী হয়। আমার অ্যাডভাইসরও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। কাজের ব্যাপারে ফাঁকিবাজি একদম দেওয়া যেত না।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৬: নান্দনিক শিক্ষায় উৎসাহী ছিলেন শ্রীমা
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫২: হিতকারী মূর্খ বন্ধুর থেকে একজন পণ্ডিত শত্রু থাকা ভালো
এখন একই বিভাগে পোড়ানো এবং পড়াশোনা করার সুবাদে জন্য উনি আমার অন্যান্য অনেক বন্ধুবান্ধবকেই চেনেন। নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ, কথা-বার্তাও হয়। মানে সব স্কুল কলেজেই যা হয় আরকি। অধ্যাপকরাও ছাত্রছাত্রীদের চেনেন আর ছাত্রছাত্রীরাও অধ্যাপক দেড় চেনে। কাজেই আমি যদি আমার কোনও বন্ধুবান্ধবকে কিছু বলে আসি এই আলাস্কা আসার ব্যাপারে, আর সেটা যদি তাদের মুখ ফস্কে কোনও ভাবে আমার অ্যাডভাইসরের কানে গিয়ে পৌঁছয় তাহলে আর রক্ষে থাকবে না। কি যে করবেন তিনি তা আমি ভাবতেও পারি না।
আরও পড়ুন:
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৪: যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না?
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৫: বার্নার্ড শ ও শার্লটি—যদি প্রেম দিলে না প্রাণে/১
তাই সব ঝামেলা এড়াতে, সেখানে সবাইকে বলেছিলাম যে আমি যাচ্ছি হিউস্টন শহরে ভারতীয় দূতাবাসে (কনস্যুলেট) অভিবাসন সংক্রান্ত কিছু কাজ মেটাতে। সেটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওই আড়াইশো মাইল মতো দূরে। এলএসইউ (লুইজিয়ানা) এর কাছে দূরপাল্লার যে বাস-ডিপো আছে, সেখান থেকে বাসে করে ঘণ্টা তিন-চারেকের দূরত্ব।
আরও পড়ুন:
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৮: কালীর হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে মহানায়ক বলেছিলেন, ‘কাউকে বলো না’
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার
আমি হিউস্টন এসেছিলাম। কিন্তু সেখান থেকে আর ভারতীয় দূতাবাসে না গিয়ে গেলাম বিমানবন্দরে আর সেখান থেকে সোজা পাড়ি জমালাম চারহাজার মাইল উত্তরে দেশের একদম উত্তর প্রান্তে আলাস্কায় যার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মূলভূখণ্ডের কোনও যোগই নেই। আমার সমাজমাধ্যমে আমার অ্যাডভাইসর সহ আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের যত বন্ধু ছিল তাদের সবাইকে বন্ধুর তালিকা থেকে বের করে দিয়েছিলাম যাতে ভুলবশতও আমার এই গোপন আলাস্কা ভ্রমণের ব্যাপারে কেউ ঘুনাক্ষরেও কিছু টের না পায়। সে বার আমি এসেছিলাম অ্যাঙ্করেজ শহরের দিকে। —চলবে।
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।