বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

১৭৬০ সালে সিংহাসনে বসেন কৃষ্ণ মাণিক্য। তিনি উদয়পুর থেকে রাজধানী সরিয়ে আনেন এখনকার পুরনো আগরতলায়। সিংহাসনে বসার কিছুদিনের মধ্যেই চাকলা রোশনাবাদের রাজস্ব সংগ্রহের বিষয় নিয়ে ইংরেজ আশ্রিত বাংলার নবাবের ফৌজদারের সঙ্গে কৃষ্ণ মাণিক্যের সংঘাত শুরু হয়। ফৌজদার রাজাকে শায়েস্তা করার জন্য নবাবের কাছে অতিরিক্ত সৈন্য চেয়ে পাঠান। নবাব তদানীন্তন ইংরেজ গভর্নর ভ্যানসিটার্ট সাহেবকে ফৌজদারের সাহায্যার্থে সৈন্য পাঠাবার জন্য অনুরোধ জানান। ইংরেজরা তখন তাদের প্রাপ্ত চট্টগ্রাম এলাকার সীমা আরও বাড়াবার জন্য চিন্তা ভাবনা করছিল।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেসময় নবাব মীর কাশেমের কাছ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বর্ধমান, মেদিনীপুর এবং চট্টগ্রাম জমিদারি হিসেবে পেয়েছিল। সৈন্য পাঠাবার জন্য নবাবের অনুরোধ তাদের কাছে যেন এক বিরাট সুযোগ এনে দেয়। ইংরেজ গভর্নর তখন চট্টগ্রামের ইংরেজ শাসনকর্তাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে ত্রিপুরা অধিকারের নির্দেশ দেন। চট্টগ্রামের শাসনকর্তা বারলেস্ট সাহেব তখন ২০৬ জন সৈন্য ও দুটি তোপ সহ চট্টগ্রামের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট ম্যাথু সাহেবকে ত্রিপুরা অভিযানে পাঠান। ১৭৬১ সালের ফেব্রুয়ারির ঘটনা এটা। রাজা কৃষ্ণ মাণিক্যও ইংরেজদের প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি সাত হাজার পদাতিক সৈন্য, কয়েকটি তোপ ও বহু সংখ্যক কুকি সৈন্য সহ কৈলারগড় দুর্গে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু সৈন্য সংখ্যা অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধের আগেই ত্রিপুরার রাজা পরাজিত হলেন। এ নিয়ে শোনা যায়, উৎকোচের বিনিময়ে ত্রিপুরার ফৌজের বক্সীকে ইংরেজ বাহিনী হাত করে নিয়েছিল।
যুদ্ধ শুরুর আগেই ত্রিপুরা ফৌজের বক্সী বাহিনীর সৈন্যদের মধ্যে এমন এক ভীতি ছড়িয়ে দেয় যে, ইংরেজদের হাতে তাদের পরাজয় অনিবার্য। তাই এ অবস্থায় প্রাণ নিয়ে পালানোই শ্রেয়। ত্রিপুরার সৈন্যগণ এরপর দুর্গের গুপ্তদ্বার দিয়ে বেরিয়ে অরণ্যে পালিয়ে যায়। বাধ্য হয়ে কৃষ্ণ মাণিক্য ইংরেজ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এই ভাবে প্রায় বিনা যুদ্ধেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সমতল ত্রিপুরায় তাদের অধিকার কায়েম করে। ত্রিপুরায় ইংরেজ যুগের সূচনা ঘটে। ত্রিপুরা অধিকারের পর বিপুল পরিমাণ অর্থ রাজস্ব নির্ধারিত হয়। অবশ্য ইংরেজদের সঙ্গে রাজস্ব সম্পর্কিত এই চুক্তিতে ত্রিপুরার পার্বত্য অঞ্চলের কোনও উল্লেখ ছিল না। রাজ্যের সমতল অঞ্চল অর্থাৎ চাকলা রোশনাবাদের জন্যই তা নির্ধারিত হয়েছিল। পার্বত্য ত্রিপুরার স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ ছিল।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৪: উদয়পুর অভিযানে মগ সৈন্যরা ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দিরের চূড়া ভেঙে দিয়েছিল

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪২: সুন্দরবনের বাঘের ভবিতব্য

মোগলদের মতো ইংরেজরাও চাকলা রোশনাবাদকে জমিদারি হিসেবে ব্যবহার করেছিল। মিঃ লিক সাহেবকে ইংরেজদের পক্ষে ত্রিপুরার রেসিডেন্ট পদে নিয়োগ করা হয়। ধীরে ধীরে ইংরেজ নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় হতে থাকে। বিচার ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন সূচিত হয়। ক্রমে ক্রমে ইংরেজ আইনকানুনও প্রচলিত হতে থাকে। কৃষ্ণ মাণিক্যের মৃত্যুর পর ১৭৮৩ থেকে দু’ বছর রাজ্য পরিচালনা করেন মহারানি জাহ্ণবী দেবী। ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ সরকারের অনুমোদন লাভ করে সিংহাসনে বসেন রাজধর মাণিক্য। ত্রিপুরা তখন কার্যত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়েছিল। বাংলার নবাবের বদলে তখন কোম্পানি তথা ইংরেজরাই হল ত্রিপুরার ভাগ্যনিয়ন্তা। ত্রিপুরায় কে সিংহাসনে বসবে তার অনুমোদন দেবে ইংরেজ। বঙ্গদেশে তখন বিস্তৃত হয়েছে ইংরেজ আধিপত্য।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬২: ধনময়ী জ্ঞানময়ী-র পাশে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা

১৮২৯ সালে রাজ্যভার গ্ৰহণ করেন কৃষ্ণকিশোর। তিনি রাজধানী সরিয়ে আনেন বর্তমান আগরতলায়। তাই রাজধানী আগরতলার জন্ম বৃত্তান্তের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন কৃষ্ণকিশোর। রাজত্বের শুরু থেকেই তিনি নানা ভাবে চাপের মধ্যে ছিলেন। ত্রিপুরা জেলার খন্ডল পরগণায় সশস্ত্র কুকি হামলা এবং পার্বত্য এলাকায় উৎপাদিত বনজ সম্পদের উপর রাজ সরকারের শুল্ক আদায়ের ঘটনা ঘিরে ইংরেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিরোধ বেঁধেছিল কৃষ্ণকিশোরের। এমনকি, এক সময় চট্টগ্রামের কোম্পানি কর্তৃপক্ষ পার্বত্য ত্রিপুরা খাস দখল করে নেবারও প্রস্তাব দিয়েছিল কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে। অবশ্য শেষপর্যন্ত এই প্রস্তাব কার্যকর হয়নি। রাজার জমিদারি সমতল ত্রিপুরায় কুকি আক্রমণের ফলে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ ভীষণ রুষ্ট হয়। রাজাকে বেকায়দায় ফেলার জন্য কোনও কোনও উচ্চাকাঙ্খী রাজপুরুষও ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে থাকেন। সীমান্তে উপযুক্ত রক্ষী না থাকাতেই খন্ডল, ছাগলনাইয়া এলাকায় ভয়াবহ কুকি তান্ডব সম্ভব হয়েছিল বলে অভিমত প্রকাশ করে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ এ জন্য কৃষ্ণকিশোরকে দোষারোপ করে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, অন্য লড়াই: সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৭: তিনটি মেয়ের তিনটি কলম!

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৬: রামায়ণে রামচন্দ্রের যাত্রাপথ সুগম হওয়ার কারণেই কি সীতার উপস্থিতি?

রাজা কুকি তান্ডব প্রতিরোধে অক্ষম বলেও তারা অভিমত প্রকাশ করে। অবশ্য শুধু কৃষ্ণকিশোর নন, সমতল ত্রিপুরা অর্থাৎ চাকলা রোশনাবাদে ইংরেজ আধিপত্যের পর থেকেই তারা রাজাদের নানা ভাবে চাপের মধ্যে রেখেছিল। কৃষ্ণকিশোর একজন বিলাসপ্রিয় ও অমিতব্যয়ী নৃপতি ছিলেন। ব্যাঘ্রের বিবাহ, মল্লযুদ্ধ, তন্ত্রশাস্ত্র—এ সব বিষয়ে প্রবল আগ্রহ ছিল তাঁর। ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে বজ্রাঘাতে রাজার মৃত্যু ঘটে। কৃষ্ণকিশোরের মৃত্যুর পর রাজ্যভার গ্ৰহণ করেন পুত্র ঈশানচন্দ্র।

১৮৫৭ সালের মহা বিদ্রোহের সময় ঈশানচন্দ্র মাণিক্য (১৮৪৯-৬২ খ্রিঃ) এক অভূতপূর্ব সংকটের সম্মুখীন হয়েছিলেন। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের ৩৪ নম্বর পদাতিক বাহিনীর ভারতীয় সিপাহীরা বিদ্রোহ করে অস্ত্রাগার ও কোষাগার লুণ্ঠন করে। কারাগার ভেঙে কয়েদিদের মুক্ত করে তারা। বিদ্রোহীরা সেনা ব্যারাকে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারপর লুণ্ঠিত অস্ত্রশস্ত্র ও নগদ অর্থ নিয়ে তারা ত্রিপুরার দিকে অগ্রসর হয়।
আরও পড়ুন:

ছোটদের যত্নে, সন্তান কম মনোযোগী কিন্তু অতি সক্রিয়? সহজ উপায়ে বাড়িতেই এর চিকিৎসা সম্ভব

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৯: ইন্দুমতী ও সুরবালা

বিদ্রোহীদের আশা ছিল, পার্বত্য ত্রিপুরার স্বাধীন রাজা তাদের সাহায্য করবেন। কিন্তু রাজা বিদ্রোহীদের পরিবর্তে ইংরেজদের সাহায্য করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি বিদ্রোহী সিপাহীদের রাজ্য থেকে বহিষ্কারের আদেশ দেন। বিদ্রোহীরা তখন ত্রিপুরায় অবস্থান না করে কাছাড় হয়ে মণিপুরের দিকে যাত্রা করেন। কয়েকজন সিপাহী অবশ্য শেষপর্যন্ত ত্রিপুরায় থেকে গিয়েছিলেন। রাজার বাহিনী তাদের ধরে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিয়েছিল এবং তাদের ফাঁসি হয়েছিল। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কড়া মনোভাব এবং ব্যবস্থা গ্রহণ সত্ত্বেও ঈশানচন্দ্র কিন্তু ইংরেজদের সন্দেহ মুক্ত হতে পারেননি। রাজাকে বিদ্রোহীদের সাহায্যকারী হিসেবে ইংরেজরা সন্দেহ করেছিল। কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন, তখন ত্রিপুরায় আসা বিদ্রোহী সিপাহীদের বাঁধা দানের মতো উপযুক্ত সৈন্যদল রাজার ছিল না।—চলবে।
ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content