বুধবার ২৭ নভেম্বর, ২০২৪


রবীন্দ্রনাথ ও মহারাজ রাধাকিশোর।

১৩১২ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে রাধাকিশোরের আহ্বানে রবীন্দ্রনাথ তৃতীয়বারের মতো আগরতলায় আসেন। সে সময় রাজ্যের ঋণ সংগ্রহের ব্যাপারে রাধাকিশোর নানা চিন্তাভাবনা করছিলেন। ভাবছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী নিয়োগের ব্যাপারেও। রবীন্দ্রনাথ আগরতলায় আসার আগেই মহারাজকে এসব বিষয়ে পত্র দিয়ে তাঁর দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। ঋণ নেবেন রাজা, কিন্তু এজন্য কবির দুশ্চিন্তা কম নয়! ব্যাঙ্ক অফ বেঙ্গল থেকে ঋণ পাওয়ার যাবে না বলে প্রচার হয়েছে। কবি মনে করছেন এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার।

এ ব্যাপারে কবির অভিমত হল, যদি ঋণ সংগ্রহের জন্য গভর্নমেন্টের শর্ত স্বীকার করতে নিতান্ত বাধ্য হতেই হয় মহারাজকে, তবে জমিদারী শাসনের জন্য গভর্নমেন্টের লোককে গ্রহণ করে মহারাজের নিজের নির্বাচিত একজন সুদক্ষ লোককে যেন মন্ত্রীপদে বসানো হয়। এই দুইয়ে যেন এক করা না হয়। তখন কবির আত্মীয় রমণীমোহন চট্টোপাধ্যায়কে ত্রিপুরার মন্ত্রীপদে নিয়োগের কথা চলছে। রাজনৈতিক ও স্বার্থ প্রণোদিত নানা চক্রান্তে মহারাজ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন সে জন্য কবি বিশ্বস্ত, দক্ষ, নিষ্ঠাবান, সর্বোপরি তাঁর আত্মীয়কে মহারাজের সাহায্যের জন্য পাঠাতে চাইছেন। রমণীমোহন তখন কলকাতা পুরসভার প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে আসীন। সেই স্হায়ী কাজ থেকে ছুটি নিয়ে তাকে ত্রিপুরায় আসতে হবে। রবীন্দ্রনাথ সেই ব্যবস্থাই করেছিলেন। কবি আরও চাইছিলেন, রমণীমোহনকে নিয়োগের পূর্বে যেন ঋণ সংগ্রহের বিষয়টি স্থগিত রাখা হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় ত্রিপুরার মন্ত্রীপদে অধিষ্ঠিত হবেন এটা আগরতলায় তখন কেউ কেউ চাইছিলেন না। তাই এর বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত ভাবে প্রচারও শুরু হয়ে গিয়েছিল।

মূলত রাজার কানে তোলার জন্য এসব প্রচার চললেও যথারীতি তা কবির কানেও যায়। ত্রিপুরায় নানা ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ রাধাকিশোরকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, “রমণীকে না হউক কোনও একজন দৃঢ়চিত্ত যোগ্য লোককে মন্ত্রীপদে রাখিতে হইবে।” রবীন্দ্রনাথ রাধাকিশোরকে আরও লেখেন—”ইহা অনুভব করিতেছি একটা জাল বয়ন হইতেছে-লেশমাত্র কাল বিলম্ব না করিয়া মহারাজা মনস্হির করুন—দ্বিধামাত্র করিবেন না-এই জাল ছিন্ন করিবার ব্যবস্থা করুন। যতই বিলম্ব হইবে দুর্বল হইয়া পড়িবেন।”

১৩১২ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ রাধাকিশোরকে এমন কিছু পত্র দিয়েছিলেন যাতে শুধু ত্রিপুরার সমকালীন ঘটনাবলীই ধরা পড়েনি, ধরা পড়েছেন এক অন্য রবীন্দ্রনাথ, যিনি একাধারে রাজনীতিজ্ঞ, অর্থনীতিজ্ঞ এবং অভিজ্ঞ রাজ্য পরিচালনায়ও। ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রেই হয়তো আমরা কবির এই অচেনা দিকটি দেখতে পেয়েছি। সে সময় রবীন্দ্রনাথ মহারাজাকে একটি গোপনীয় পত্র দিয়ে তা পড়ার পর নষ্ট করে ফেলতেও বলেছিলেন। এই পত্রে কোনও সন তারিখও ছিল না। তবে সংশ্লিষ্ট গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, ১৩১২ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে আগরতলা আসার অল্প কিছুদিন আগে সম্ভবত জৈষ্ঠের শেষ দিকে কবি রাজাকে এই গুরুত্বপূর্ণ পত্রটি দিয়েছিলেন।

তাতে তিনি লিখেছিলেন—”…মহারাজের রাজ্য পরিচালনার সাহায্য কার্যে এমন একজন অর্থনীতিজ্ঞ কর্ম কুশল দূরদর্শী, স্হির বুদ্ধি, উৎসাহী লোককে নিযুক্ত করুন যাহার বুদ্ধি ও কর্তব্য জ্ঞানের প্রতি মহারাজ সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভর করিতে পারেন। তাহার প্রতি যথার্থ রূপে কর্তৃত্ব ভার দিতে হইবে। নানা পক্ষের নানা মত নানা স্বার্থের দ্বারা রাজ্যের মঙ্গলকে প্রতিপদে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হইতে দিবেন না।…আমি দেখিতে পাইতেছি নানা পক্ষের নানা বিরোধ ও সংঘর্ষ মহারাজকে নিয়তই উৎপীড়িত করিতেছে,আশঙ্কা হইতেছে পাছে ক্রমশই জাল জটিল হইয়া পড়ে ও মহারাজকে কোনো প্রকার অসম্মানের মধ্যে জড়িত হইয়া পড়িতে হয়। পরের বন্ধনে একদিন ধরা দেওয়ার চেয়ে নিজের শাসনে নিজকে সুকঠিন ভাবে বদ্ধ করা কর্তব্য। মহারাজের শরীর দীর্ঘকাল হইতে অসুস্থ হইতেছে দেখিয়া আমার মন উদ্বিগ্ন হইতেছে।…নানা লোকের আকর্ষণে বিক্ষিপ্ত চিত্ত না হইয়া যে কোনো একজন ব্যক্তির উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস স্হাপন করিতে পারিলে মহারাজ শান্তি ও স্বাস্থ্য লাভ করিতে পারিবেন বলিয়া আমার বিশ্বাস। আমি পূর্বে যাঁহার নাম করিয়াছিলাম তাঁহাকেই রাখিবার জন্যই যে অনুরোধ করিতেছি তাহা নহে-আমার বক্তব্য এই যে একজনের প্রতি অব্যাহত কর্তৃত্বভার না দিলে কোনোমতে রাজকার্যে শৃঙ্খলা ঘটিতে পারে না।…”
ত্রিপুরার তৎকালীন আর্থিক অবস্থা,রাজধানীর ঘটনা প্রবাহ সবকিছু সম্পর্কেই কবি খোঁজ খবর রাখতেন নিয়মিত। প্রয়োজনে পরামর্শ দিতেন রাজাকে। ‘আশঙ্কা হইতেছে পাশে ক্রমশই জাল জটিল হইয়া পড়িতে হয়’-কবির চিঠির এই অংশে ধরা পড়েছে তাঁর উদ্বেগ, আশঙ্কা! ত্রিপুরার উন্নয়নের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ যেমন আন্তরিক ভাবেই আগ্রহী ছিলেন, তেমনই মহারাজের ভালো-মন্দ সম্পর্কেও তিনি সর্বদা ভাবতেন। ‘নানা লোকের আকর্ষণে বিক্ষিপ্ত চিত্ত না হয়ে’ যে কোনও একজন ব্যক্তির উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস স্হপনের কথা রাজাকে বলেছিলেন কবি। রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় রমণীমোহন চট্টোপাধ্যায়কে মন্ত্রীপদে নিয়োগের বিষয়টি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।
আগরতলায় কেউ কেউ তখন এর ঘোর বিরোধী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার জন্য একজন সুদক্ষ মন্ত্রীর প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। শুধু তাঁর আত্মীয় বলে নয়,কবি চেয়েছিলেন একজন দক্ষ লোক ত্রিপুরায় আসুক মহারাজকে সুদৃঢ় ভাবে সহায়তা করার জন্য।কবি আরও চেয়েছিলেন ত্রিপুরার সামগ্রিক স্বার্থেই তাঁর হাতে যেন যথার্থভাবে অর্পিত হয় কর্তৃত্ব ভার।
ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগের সূত্রে রবীন্দ্রনাথ যেন রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। রাজা তাঁর রাজ্যের আর্থিক সংকট দূর করার জন্য কার কাছ থেকে ঋণ নেবেন, কি ভাবে সেই ঋণ শোধ হবে সেসব নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যেমন গভীর ভাবে চিন্তা করেছেন-তেমনই রাজ্যের মন্ত্রীপদে নিয়োগ নিয়েও ভেবেছেন তিনি। চিন্তা করেছেন মন্ত্রীর দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়েও। ‘চক্রান্ত সঙ্কুল জটিল’ রাজসভার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার পর কবি অনুভব করেছিলেন—’এই কর্মের পথ যেমন দুর্গম তেমনি কণ্টকাকীর্ণ। এই পথে পা ফেলিবা মাত্র চক্রান্ত কাহাকে বলে তাহার স্বাদ আমাকেও পাইতে হইল।’

ত্রিপুরায় এসে রবীন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতা হয়েছিল এখানে দলাদলি প্রবল।এই অবস্থায় মহারাজের অনিষ্ঠ অবশ্যম্ভাবী। মহারাজের ঋণ সংগ্রহ এবং তাঁর চাকলা রোশনাবাদের জমিদারী প্রসঙ্গেও কবি পরামর্শ দিয়েছিলেন তাঁকে। কবির প্রাসঙ্গিক চিঠিপত্রে উল্লেখিত হয়েছে নানা চক্রান্তের আভাষ। ১৩১২ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে কবি রাধাকিশোরকে এক পত্রে লিখছেন—”…চাকলা রোশনাবাদ নূতন লোকের হস্তে ঋণ শোধের জন্য আবদ্ধ রাখা অনাবশ্যক, তাহার একাংশ মাত্র রাখাই মহারাজের অভিপ্রেত ইহাই ম্যাজিস্ট্রেটকে বুঝাইয়া বলিবার কথা ছিল। কিন্তু যে সকল লোকের দ্বারা গভর্নমেন্টের সহিত মহারাজের কথা চলিতেছে মহারাজের সহিত তাহাদের অভিপ্রায়ের পার্থক্য থাকাতে সমস্তই পণ্ড হইয়া যাইতেছে— কেবল তাহাই নহে চেষ্টাপূর্বক কর্তৃপক্ষের নিকট মহারাজকে বিরক্তিভাজন করা হইতেছে। আমি স্পষ্টই দেখিতে পাইলাম শ্রীযুক্ত শরৎ বসুকে পদচ্যুত করিবার উদ্দেশ্যে মহারাজের জমিদারীকে মহারাজের আয়ত্ব ভ্রষ্ট করার উদ্যোগ চলিতেছে।…বস্তুতঃ বিশ্বাসযোগ্য সুযোগ্য লোককে নিযুক্ত করিবার পূর্বে গভর্নমেন্টের সঙ্গে মহারাজ কোন কথা চালাইবেন কি করিয়া আমি তাহাই ভাবিতেছি। যাঁহারা ভারপ্রাপ্ত হইয়াছেন তাঁহারা প্রতিকূল ভাবে চলিতেছেন।…”

এই চিঠিটি দেয়ার ক’দিন পরই কবি রাজাকে অপর একটি চিঠিতে লিখেন—”…মহারাজের রাজ্যে ব্যবস্থা স্হাপন করিতে হইবে ঈশ্বর ইহা ব্রতস্বরূপ আমার প্রতি অর্পণ করিয়াছেন তাহা আমি অনুভব করিতেছি; আমার চিত্ত কর্ম হইতে অবকাশ লইবার জন্য ব্যগ্র হইয়াছিল কিন্তু আমি স্পষ্ট বুঝিয়াছি মহারাজের এই কাজ আমাকে সাধন করিতে হইবে,আমি ইহাতে ধর্মে বাধ্য মহারাজও আমাকে ইহা হইতে নিষ্কৃতি দিতে পারিবেন না।আমাদের বর্তমান বৈষয়িক সমস্ত ঝঞ্ঝাটের মধ্যেও মহারাজের রাজ্যের চিন্তা আমাকে কিছুতেই পরিত্যাগ করিতেছে না। কেবল মহারাজকে নহে,আমার নিজকে উদ্বেগ হইতে মুক্ত করিবার জন্য আমাকে মহারাজের কর্মে চিত্ত নিয়োগ করিতে হইবে।ত্রিপুরার ইতিহাসে আমার পিতামহের যে যোগ ছিল সেই যোগ আমাকেও রক্ষা করিতে হইবে বিধাতার এই অভিপ্রায়বশতই অকস্মাৎ স্বর্গীয় মহারাজ বিনা পরিচয়েই আমাকে ত্রিপুরার সহিত আবদ্ধ করিয়া দিয়াছেন।”
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৩৮: পুত্র বীরেন্দ্রর বিয়েতে রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানান মহারাজ রাধাকিশোর

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০১: খামখেয়ালির গিরীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ দূরে থেকেও ত্রিপুরার রাজসভার সমস্ত বিষয় যেন স্পষ্ট বুঝতে পারতেন।কে ষড়যন্ত্র করছে,কে অর্থ আত্মস্যাৎ করছে সব খবর রাখতেন কবি। ত্রিপুরার প্রতি কবির এই আগ্রহ যেন রীতিমত বিস্ময় সৃষ্টি করে। মহারাজের সচিব স্যান্ডস সাহেব কী করছেন, তিনি মহারাজের অর্থ শোষণ করছেন কিনা সেসব বিষয়েও বিস্তৃত খবরাখবর রাখতেন কবি। ত্রিপুরার রাজার সঙ্গে চিঠি চালাচালির সূত্রেই যেন ধরা পড়েন এক অন্য রবীন্দ্রনাথ, তিনি রাজনীতিক। ত্রিপুরার তদানীন্তন আরও ক’জন রাজপুরুষের সঙ্গে পত্র যোগাযোগ ছিল কবির। হয়তো তাদের মাধ্যমেও কবি অনেক খবরাখবর সংগ্রহ করতেন। এমনকি কবিকে নিয়ে প্রাসাদ পরিমন্ডলে কি আলোচনা হতো সেই খবরও কবি পেয়ে যেতেন। মহারাজের পারিষদবর্গে সবাই যে কবির শুভাকাঙ্খী ছিলেন এমনটা নয়। বরং রবীন্দ্রনাথ রাজ্যের সামগ্রিক কল্যাণে মহারাজকে যে সব পরামর্শ দিতেন তা পারিষদবর্গের কারও কারও মনপুতঃ ছিল না। এতে কারও কারও স্বার্থহানি হবার আশঙ্কা ছিল। সঙ্গতভাবেই এইসব রাজপুরুষ কবি বিরোধী সমালোচনায় মুখর ছিলেন।

১৩১২ বঙ্গাব্দের ১৬ শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথ রাধাকিশোরকে এক পত্রে লিখছেন—”…এখন আমার ঠিক কর্মের সময় নহে।এখন সংসারের সমস্ত জাল গুটাইয়া লইবার জন্য মন প্রায়ই ব্যাকুল হয়।ঠিক এই সময়ে বিবিধ চক্রান্ত সঙ্কুল জটিল রাজসভার ব্যাপারে ঈশ্বর যে কেন আমাকে ক্ষণকালের জন্যও আকর্ষণ করিলেন তাহা তিনিই জানেন। এই কর্মের পথ যেমন দুর্গম তেমনি কন্টকাকীর্ণ। এই পথে পা ফেলিবা মাত্র চক্রান্ত কাহাকে বলে তাহার স্বাদ আমাকেও পাইতে হইল।…আমি স্যান্ডস সাহেবকে তিলমাত্র বিশ্বাস করি না। আমি নানা স্হান হইতে শুনিয়াছি যে স্যান্ডস সাহেব নানা কৌশলে মহারাজের অর্থ শোষণ করে।…ত্রিপুরায় গিয়া আমি ইহা দেখিলাম যে সেখানে দলাদলি খুব প্রবল হইয়াছে,এরূপ অবস্থায় মহারাজের তরফে তাকানো কোনো দলের পক্ষে সম্ভবপর হয় না, অপর দলকে ব্যর্থ করা ও নিজের দলের জন্য বল সংগ্রহ করা ইহাই প্রত্যেক পক্ষের প্রধান চিন্তনীয় হয়। এমন স্হলে মহারাজের অনিষ্ঠ অবশ্যম্ভাবী। আমি অল্পদিনে কোনোমতেই বুঝিতে পারি নাই কাহারা মহারাজের যথার্থ সুহৃদ। আমার মনে কেবলি এই কথা জাগিয়াছে যে, মহারাজ সঙ্কটজালে জড়াইয়া পড়িয়াছেন।…ইহাও দেখিলাম গভর্নমেন্টের সহিত মহারাজের সমস্ত কথাবার্তা…স্যান্ডস প্রভৃতি দুই একজন লোকের দ্বারা চালিত হইয়া থাকে। তাহারা ইচ্ছা করিলে এই ক্ষমতার এমন অপব্যবহার করিতে পারে যে তাহা মহারাজের পক্ষে সম্পূর্ণ বিপজ্জনক এমন স্হলে লেশমাত্র সন্দেহের কারণ থাকিলেও অতিমাত্র সাবধান হওয়া রাজার কর্তব্য। এই জন্যই আমি মনে করিয়াছিলাম স্হানীয় দলাদলির সহিত সম্পর্কশূন্য,নিস্বার্থ,সুশিক্ষিত, সুদক্ষ লোক মহারাজের সম্প্রতি একান্ত আবশ্যক হইয়াছে। আমি যতদূর জানি রমণীর ন্যায় যোগ্য ব্যক্তি দুর্লভ এই মনে করিয়া রমণীর নাম করিয়াছিলাম।…”

ত্রিপুরা সম্পর্কে কবি কতটা আন্তরিক ছিলেন এই সব চিঠিপত্রে তা অনুধাবন করা যায়।সেই সময়ের ত্রিপুরার রাজনীতি, অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কেও খানিকটা ধারণা পাওয়া যায় কবির চিঠিপত্রে। দূরে থেকেও কবি যে ত্রিপুরার ‘চক্রান্ত সঙ্কুল জটিল রাজসভার’ নানা খবরাখবর সংগ্রহ করতেন তারও আভাস মেলে কবির চিঠিপত্রে। যাইহোক, ১৩১২ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে রবীন্দ্রনাথ মনোনীত রমণীমোহন চট্টোপাধ্যায় ত্রিপুরার রাজমন্ত্রী রূপে নিযুক্ত হলেন। নব নিযুক্ত মন্ত্রীর কার্যভার গ্রহণ উপলক্ষ্যে নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ-সহ কবি আগরতলায় এসেছিলেন। এটি ছিল তাঁর চতুর্থবারের আগরতলা সফর। আগরতলায় প্রাক্তন মন্ত্রীর বিদায় ও নতুন মন্ত্রীর অভ্যর্থনা সভা এবং মন্ত্রী নিয়োগ দরবারে রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত ছিলেন। সে বছরেই চৈত্র মাসে কবি আবার আগরতলা এসেছিলেন। বরিশালে একটি সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার উদ্দেশ্যে পূর্ববঙ্গ সফরকালে কবি সেবার সংক্ষিপ্ত সফরে আগরতলা আসেন। এটি ছিল তাঁর পঞ্চম সফর।অর্থাৎ ১৩১২ বঙ্গাব্দে কবি তিনবার আগরতলা সফর করেছিলেন।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৯: মাথার কান

দশভুজা, দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৪: আনন্দী—এক লড়াইয়ের নাম

ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগের সূত্রে কবি যেন এক পার্বত্য রাজ্যের সুখ দুঃখের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েছিলেন। শুধু রাজা কেন,রাজ্যের প্রজাদের মঙ্গল অমঙ্গল কিসে হবে সেইসব চিন্তাভাবনাও কবির মনকে আচ্ছন্ন করে রাখতো। সেই রাজ্যের রাজধানীতে কবিকে নিয়ে কি আলোচনা সমালোচনা হতো সে খবরও তিনি পেয়ে যেতেন। দুঃখিত হতেন কবি। কিন্তু তবু যোগাযোগ ছিন্ন করেননি। মনের দুঃখের কথা চিঠি লিখে জানাতেন রাজাকে, চিঠি লিখতেন পারিষদবর্গের কাছেও। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও শিল্পসংস্কৃতির ক্ষেত্রে রাধাকিশোরের উদার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য কবি মহারাজার কাছে আর্থিক সাহায্য চেয়েছেন।রাজাও আর্থিক সংকটের মধ্যেও বঙ্কিমের ‘বঙ্গদর্শন’ পুণঃপ্রকাশ ও জগদীশচন্দ্রের গবেষণার জন্য সাহায্য করেছেন। কিন্তু পারিষদবর্গের অন্যরকম সন্দেহ ছিল। রবীন্দ্রনাথ রাজার কাছ থেকে টাকা পয়সা নিচ্ছেন। এ নিয়ে প্রাসাদ পরিমন্ডলে ফিসফাস গুঞ্জন,নানা সমালোচনা। দূরে থেকেও কবি সব খবর পেতেন। তিনি স্পষ্ট ভাবে সংশ্লিষ্ট সব মহলকে তা জানিয়েও দিতেন।

ত্রিপুরার রাজার পারিষদবর্গ যে কবিকে অমূলক সন্দেহের চোখে দেখতেন এবং কবিকে নানা প্রসঙ্গে সাহায্যের বিষয়ে রাজার শুভ প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করার ষড়যন্ত্র হতো তা ধরা পড়েছে কবির চিঠিপত্রে। রাজপারিষদ কর্ণেল মহিম ঠাকুরের সঙ্গে কবির নিবিড় সম্পর্ক থাকলেও তাঁর কিছু ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেছেন কবি।মহিম ঠাকুরকে কবি লিখেছেন—”…মহারাজ আমাকে মান্যবন্ধুভাবে দেখিয়া তদনুরূপ ব্যবহার করিতে নিজে স্বভাবতঃই ইচ্ছুক কিন্তু শুনিতে পাই তোমরা তাহাতে বাধা দিয়া তাঁহাকে সুদূর রাখিতে চেষ্টা কর। সুতরাং মহারাজের সহিত আমার প্রিয় সম্বন্ধ লোকচক্ষে হীন করিয়া তুলিতেছে।…”

ত্রিপুরার মঙ্গল সাধনে নিয়ত চিন্তা করতেন কবি। পরামর্শ দিতেন রাজাকে, রাজপারিষদবর্গকেও। নানা কল্যাণকর কাজে কবি রাজার কাছ থেকে সাহায্য নিতেন। কিন্তু কবি কি ত্রিপুরার রাজকার্যে হস্তক্ষেপ করতেন? ১৩১৩ বঙ্গাব্দের ২রা আষাঢ় কবি মহিম ঠাকুরকে লিখছেন—”তোমাদের রাজ্যের কোন খবর পাইনে। বিলিতি একটা প্রবাদ আছে যে No news is good news. আমি তাই মনে করে নিশ্চিত হয়ে থাকি। তা ছাড়া দূর থেকে তোমাদের রাজকার্যে হস্তক্ষেপ করা সঙ্গত মনে করিনে। প্রায় সকল কর্ম থেকেই আমি অবসর নিয়েছি। এখন কেবল বিদ্যালয়ের ছাত্রদের পড়াচ্ছি।”

হয়তো তদানীন্তন রাজপারিষদবর্গের কেউ কেউ মনে করতেন কবি ত্রিপুরার রাজকার্যে হস্তক্ষেপ করতেন। কিন্তু রাজা নিজেই যে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিভিন্ন সময়ে কবির পরামর্শ নিতেন এটাই হল ঘটনা। ১৩১১ বঙ্গাব্দের ১৪ই বৈশাখ মহারাজ রাধাকিশোর কবিকে যে চিঠি লেখেন তাতেও এ রকম পরামর্শের প্রসঙ্গ রয়েছে। রাজা লিখছেন—”… পলিটিক্যাল এজেন্টের পরামর্শে মহিম ও যতীকে তাড়াতাড়ি আজমীর পাঠাইলাম না। ভালোই হইয়াছে। আপনার সহিত পরামর্শ করিবার সুবিধা পাইয়াছি।” পঞ্চম বারের আগরতলা সফরকালে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মহারাজ রাধাকিশোর রাজ্যের বাজেট প্রস্তুতির বিষয়েও আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। সম্ভবত রাজ্য পরিচালনার প্রশাসনিক বিষয়ে কবির ধ্যান ধারণা রাধাকিশোরকে ভীষণ ভাবে আকৃষ্ট করেছিল। সেই সঙ্গে আর্থিক প্রসঙ্গেও কবির একটা স্বচ্ছ ধারণা ছিল। চিঠিপত্র আর আলাপ আলোচনায় ঘনিষ্ঠতার সূত্রে সেদিন সব প্রকাশ পেয়েছে। রাজ্যের জন্য ঋণ গ্রহণ, মন্ত্রী নিয়োগ, রাজকুমারদের শিক্ষাদীক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে কবির পরামর্শ নিয়েছেন রাজা।

এমনকি ত্রিপুরার বাজেট সম্পর্কে মহারাজ রাধাকিশোরের কাছে কবি একটি বিস্তৃত নোট পাঠিয়েছিলেন। এই নোটে তিনি লেখেন—”… রাজ্যের মধ্যে দুইটি স্বাভাবিক ভাগ আছে।একটি মহারাজের স্বকীয়,আর একটি রাষ্ট্রগত। উভয়কে জড়ীভূত করিয়া রাখিলে পরস্পর পরস্পরকে আঘাত করিতে থাকে এই উপলক্ষ্যে প্রভূত অনিষ্ঠ উৎপন্ন হয় এবং এই দুই বিভাগের সন্ধিস্হলে নানা প্রকার দুষ্ট চক্রান্তের অবকাশ থাকিয়া যায়।যাহা মহারাজের স্বকীয়-অর্থাৎ সংসার বিভাগ;নিজ তহবিল, পরিচরবর্গ এবং মহারাজের ভ্রমণাদি ব্যাপার যাহার অন্তর্গত-তাহার উপরে মন্ত্রী বা আর কাহারও হস্তক্ষেপ করিবার অধিকার দেওয়া চলে না। এই জন্য মহারাজার স্বকীয় বিভাগকে মন্ত্রীর অধিকার হইতে স্বতন্ত্র করিয়া মন্ত্রীর প্রতি রাষ্ট্রবিভাগের সম্পূর্ণ ভারার্পণ করা আবশ্যক হইবে।

মহারাজের স্বকীয় এবং রাষ্ট্রীয় বিভাগের সীমা যদি সুনির্দিষ্ট হয় তবে মন্ত্রী তাঁহার বিভাগের অর্থ ও সামর্থ্যের পরিমাণ নিশ্চিত রূপে জানিয়া তদুপযোগী ব্যবস্থা করিতে পারিবেন এবং মহারাজের আশ্রিত ও আশ্রয় প্রত্যাশীগণ রাষ্ট্র বিভাগকে নিজের স্বার্থ সাধনক্ষেত্র নহে নিশ্চয় জানিয়া সেদিক হইতে লুব্ধ দৃষ্টি প্রত্যাখ্যান করিবে।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

মহারাজের স্বকীয় বিভাগের ব্যয় পরিমাণ সম্পূর্ণ নিরূপণ করিয়া দিলে রাজস্বের অবশিষ্ট অংশ দ্বারা মন্ত্রী ঋণ শোধ ও রাষ্ট্র চালনার সমস্ত ব্যয় নির্বাহ করিবেন। মন্ত্রীর প্রতি রাজ্যভার অর্পণ করিয়া মহারাজ নিজের রাজক্ষমতা সংকোচ করিতেছেন এ কথা যাহারা নানা কৌশলে ও নানা আভাসে মহারাজের মনে মুদ্রিত করিতেছে তাহারা স্বার্থান্বেষী ও মহারাজের শত্রুদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সাংঘাতিক। মঙ্গলের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া নিজের নিয়মের দ্বারা নিজেকে সংযত করাই রাজোচিত-তাহাই রাজধর্ম্ম। মহারাজ রাজ্যের সমস্ত ভার যদি স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করেন তবে মন্ত্রীকে কেবলমাত্র মন্ত্রণা কার্যে নিযুক্ত করিয়া চলে-নতুবা তাঁহার প্রতি সম্পূর্ণ ভারার্পণ না করিলে কোনোমতেই রাজ্যের মঙ্গল হইবে না এবং রাজকার্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা থাকিবে না। যখনই মন্ত্রীকে এই ভার গ্রহণের অনুপযুক্ত বোধ করিবেন সেই মুহূর্তেই তাঁহাকে নিষ্কৃতিদান করিবেন কিন্তু যতক্ষণ তিনি মহারাজের মন্ত্রীপদে প্রতিষ্ঠিত আছেন ততদিন কোনোমতেই তাঁহাকে সাধারণের নিকট লেশমাত্র খর্ব করিয়া নিজের সমুন্নত রাজপ্রতাপকে অবমানিত হইতে দিবেন না।ইহাতে কর্মেরও বিঘ্ন হয়,মর্যাদারও হানি ঘটে।

আমি সানুনয়ে মহারাজের নিকট নিবেদন করিতেছি যে অনুচরবর্গ নানা অবকাশে অনেক মিথ্যা, অনেক অর্দ্ধসত্য, অনেক অত্যুক্তি মহারাজের কর্ণগোচর করিয়া থাকে। এবং অনেক সময় অনেক হিতৈষাবশতও মহারাজের নিকট রাজকার্যের সমালোচনা করিয়া থাকে। এই সকল আলোচনার ফল মনের মধ্যে গোপন রাখিবেন না। অথবা এই সকল অনধিকার চর্চার প্রতি নির্ভর করিয়া অকস্মাৎ বিচলিত হইবেন না। ছোট বড় সকল প্রকার সংশয় স্হলেই মন্ত্রীর বক্তব্য শুনিবেন-ক্ষুদ্রতম কণ্টকটিকেও হৃদয়ের প্রান্ততম দেশে পোষণ করিবেন না। মন্ত্রীর সহিত মহারাজের সম্বন্ধ যদি সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয় তবে কোনদিন তজ্জন্য অনুতাপ করিতে হইবে না।…”

রাজ্যের বাজেট প্রণয়নের পূর্বে এর মূলনীতি সম্পর্কে কবি স্পষ্টভাবে রাজাকে যে নোট পাঠিয়েছিলেন তা তৎকালীন দেশীয় রাজ্যগুলোর পক্ষে,তাদের আর্থিক শৃঙ্খলার প্রশ্নে ভীষণ জরুরি ছিল। এমনকি আজকের দিনের ধ্যান ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় তার গ্রহনযোগ্যতা রয়েছে। আর্থিক সামর্থ্যকে দু’ভাগে ভাগ করে এক ভাগ মহারাজের নিজস্ব এবং অপর ভাগ রাষ্ট্রের জন্য বরাদ্দ করার কথা বলেছেন কবি। রাষ্ট্রীয় ভাগের নির্দিষ্ট পরিমাণ মন্ত্রী জানবেন এবং এই সঙ্গতির মধ্যেই তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা-সহ প্রজা কল্যাণে ব্যয় করবেন। মহারাজের স্বকীয় বিভাগের ব্যয় আগেই নির্দিষ্ট করে দিলে রাজস্বের বাকি অর্থ দিয়ে মন্ত্রী ঋণ শোধ সহ রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যয় নির্বাহ করবেন। এখানে উল্লেখ করা যায় যে,সেই সময়ে ত্রিপুরা ঋণের দায়ে জর্জরিত ছিল। আর্থিক সংকটে ছিল বিপর্যস্ত। একদিকে পুরনো ঋণ শোধ, অপরদিকে নতুন করে ঋণ সংগ্রহের তাগিদ-এই টানাপোড়েনে ভুগছিল ত্রিপুরা। এ রকম অবস্থায় রাজ্যের বাজেট কেমন হতে হবে কবি তার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন রাজাকে।

রাজ্যের বাজেট কি হবে তা নিয়ে কবি যখন রাজাকে নোট পাঠান তখন অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে, এই রাজ্যের সঙ্গে কবির যোগসূত্র কত গভীর ছিল! শুধু আর্থিক ব্যবস্থা নয়, রাজ্য প্রশাসন কী ভাবে চালিত হওয়া উচিত কবি সে সম্পর্কেও স্পষ্ট অভিমত দিয়েছিলেন রাজাকে। প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে কবির এই অভিমত শুধু তদানীন্তন ত্রিপুরার প্রেক্ষাপটে কেন, এ যেন চিরকালীন দেশ শাসনের সূত্র। যার মাধ্যমে প্রশাসন পরিচালিত হবে তাঁর উপর চাই গভীর আস্হা, বিশ্বাসবোধ। যদি অবিশ্বাস জন্মে, আস্হায় সামান্যতম চিড় ধরে তবে প্রশাসনিক কর্ণধারকে সঙ্গে সঙ্গেই সরিয়ে দিতে হবে। না হলে সামগ্রিক প্রশাসনিক কাঠামোটাই নড়বড়ে হয়ে পড়বে।’ যখনই মন্ত্রীকে এই ভার গ্রহণের অনুপযুক্ত বোধ করিবেন সেই মুহূর্তেই তাঁহাকে নিষ্কৃতি দান করিবেন। কিন্তু যতক্ষণ তিনি মহারাজের মন্ত্রীপদে প্রতিষ্ঠিত আছেন ততদিন কোনোমতেই তাঁহাকে সাধারণের নিকট লেশমাত্র খর্ব করিয়া নিজের সমুন্নত রাজপ্রতাপকে অবমানিত হইতে দিবেন না।ইহাতে কর্মের বিঘ্ন হয় মর্যাদার হানি ঘটে।’-কবির বাজেট নোটের উল্লিখিত অংশ যদিও লেখা হয়েছিল তৎকালীন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে,তবু আজকের দিনের প্রশাসন পরিচালনায়ও এই কথা সমান ভাবেই প্রযোজ্য।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গুঞ্জন উঠেছিল কেন ত্রিপুরার রাজপরিবারে? রবীন্দ্রনাথ কি কারও বাড়া ভাতে ছাই দিতে চেষ্টা করেছিলেন? কবির বিভিন্ন চিঠি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তিনি মহারাজের ‘অনুচরবর্গের’ প্রতি বরাবরই বিরূপ ছিলেন। বাজেট নোটেও তিনি লিখেছিলেন—’আমি সানুনয়ে মহারাজের নিকট নিবেদন করিতেছি যে অনুচরবর্গ নানা অবকাশে অনেক মিথ্যা,অনেক অর্দ্ধসত্য,অনেক অত্যুক্তি মহারাজের কর্ণগোচর করিয়া থাকে।’ কবি হয়তো মহারাজকে ‘অনুচরবর্গে’র পরিবেষ্টন থেকে মুক্ত করতে চেষ্টা করেছিলেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই মহারাজের ‘অনুচরবর্গ’ তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। তারা কবি সম্পর্কে মহারাজের কান ভারী করে গিয়েছেন। কিন্তু অনুচরবর্গের প্রতি কবি এত বিরূপ ছিলেন কেন?সব রাজারই অনুচর, পারিষদবর্গ থাকে। যুগে যুগেই চলে আসছিল তা।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৪ : অকারণে কেউ অন্যের ভালো করতে যায় না

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭১: মা সারদার নলিনীর মানভঞ্জন

এমনকি আজকের দিনেও ‘কিচেন কেবিনেট’ শব্দবন্ধ সকলের কাছেই পরিচিত। কবি হয়তো আজকের ধ্যান ধারণা মতো সেদিনকার রাজ প্রাসাদের এক কিচেন কেবিনেটকেই আঘাত করতে চেয়েছিলেন। তাই আগরতলায় সেদিনের চক্রটি ফুঁসে উঠেছিল কবির বিরুদ্ধে। রাজ্য পরিচালনায় কবি কেমন লোক চেয়েছিলেন? রাজাকে এ সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন—”এমন লোকের প্রয়োজন যে ব্যক্তি রাজ্যের শত্রুদের সহিত বা কোনো প্রকার স্হানীয় দলের সহিত কোনরূপ সম্পর্ক না রাখিয়া নির্ভয়ে নিঃসঙ্কোচে বলের সহিত কাজ করিয়া যাইতে পারিবে-যাহাদিগকে দলন করা আবশ্যক তাহাদিগকে নির্মম ভাবে দলিত করিতে পারিবে।”

মহারাজের পারিষদবর্গের আলোচনার বিষয় হইয়াও কবি যে ত্রিপুরার মঙ্গল চিন্তা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারেননি সে কথাও তিনি রাজাকে বলেছেন। তবে ত্রিপুরার রাজ প্রশাসন সম্পর্কে কবির প্রবল ব্যক্তিগত আগ্রহ স্বাভাবিকভাবেই কৌতুহল সৃষ্টি করে। ১৩১৩ বঙ্গাব্দের ১৪পৌষ কবি মহারাজাকে লিখছেন—”…মহারাজের রাজ্য শাসন ব্যবস্থা সম্বন্ধে আমার বক্তব্য গতকাল মুখে জানাইয়াছি। কৌন্সিলের দ্বারা কোথাও কাজ চলে না। কৌন্সিলের সহায় স্বরূপ করিয়া একজন কর্তা কাজ করিয়া থাকেন।কিন্তু সে স্হলেও কৌন্সিলের সদস্যগণকে নিস্বার্থ হিতৈষিতার সহিত অধিনায়কের বশ্যতা স্বীকার করিতে হয়।নচেৎ কূট চক্রান্ত পরস্পর বিরোধ ও উচ্ছৃঙ্খলতার সীমা থাকে না। মহারাজের বর্তমান পারিষদবর্গের প্রতি মহারাজের কি যথার্থ শ্রদ্ধা আছে? ইহারা কি এতবড় দায়িত্ব গ্রহণের যোগ্য? ইহাদের হাতে আত্মসমর্পণ করিয়া কি মহারাজের মঙ্গল হইবে? মহারাজ নিয়ত প্রশ্রয় দিয়া ইহাদের বলবৃদ্ধি করিয়া দিয়াছেন, কোথায় ধীরে ধীরে সেই বল খর্ব করিবেন, নিজেকে স্বার্থপর দীনচরিত্র ক্ষুদ্রমনা ব্যক্তিদের জাল হইতে মুক্ত করিবেন, না, রাজ্যশাসনভার ইহাদের হাতে সমর্পণ করিয়া ইহাদের প্রলয় শক্তিকে দুর্জয় করিয়া তুলিবেন?…মহারাজের নিকট আমার সানুনয় প্রার্থনা এই যে ত্রিপুরারাজকে চিরদিনের মতো দায়গ্রস্ত ও পঙ্গু হইতে দিবেন না। এখন ইহাকে কঠোর ব্যবস্থায় খাড়া করিয়া তুলিতে হইবে।মহারাজের চারদিকে যাহারা রহিয়াছে তাহারা মহারাজের মঙ্গল লইয়া খেলা করিতেছে—তাহারা তাড়াতাড়ি, রাজ্যের পতনের পূর্বেই নিজের স্বার্থসিদ্ধি করিয়া লইবার জন্য উন্মুখ হইয়া উঠিয়াছে আমার এই বিশ্বাস। এ বিশ্বাস যদি মিথ্যা হয় তবে ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করুন।কিন্তু যেমন করিয়াই হোক ইহারা কোনো প্রকার গুরুতর দায়িত্ব লইবার যোগ্য নহে-কারণ ইহারা লঘুচরিত্রের লোক ইহাদের বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা থাকিতে পারে কিন্তু বুদ্ধির গাম্ভীর্য্য নাই, এই জন্যই আমি মহারাজকে অনুনয় করিতেছি ইহাদের হাতে নিজেকে ধরা দিয়া অনুতাপের কারণ ঘটাইবেন না।বন্ধন রচনা করা সহজ,ছেদন করা অত্যন্ত কঠিন। এখন যদি পূর্বাপর বিবেচনা করিয়া না দেখেন পরে আর সময় পাইবেন না।…”

রাজ্যের জন্য ঋণ সংগ্রহ, মন্ত্রী নিয়োগ ইত্যাদি নানা বিষয়ে কবি রাজাকে পরামর্শ দিয়েছেন। রাজনৈতিক ও স্বার্থ প্রণোদিত নানা চক্রান্তে যাতে মহারাজা ক্ষতিগ্রস্ত না হন সে জন্য কবি বিশ্বস্ত, দক্ষ, নিষ্ঠাবান, সর্বোপরি তাঁর আত্মীয় রমণী মোহন চট্টোপাধ্যায়কে ত্রিপুরার মন্ত্রী পদে পাঠাতে উদ্যোগী হয়েছেন।কিন্তু কবির আত্মীয় ত্রিপুরার মন্ত্রী পদে আসবেন এটা আগরতলায় তখন কেউ কেউ চাইছিলেন না। এর বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত ভাবে প্রচারও শুরু হয়ে গিয়েছিল। এক সময় কবির কানে যায় তা। রাজাকে সতর্ক করে দিয়ে কবি লেখেন—”…ইহা অনুভব করিতেছি একটা জাল বয়ন হইতেছে-লেশমাত্র কাল বিলম্ব না করিয়া মহারাজ মনস্হির করুন-দ্বিধামাত্র করিবেন না-এই জাল ছিন্ন করিবার ব্যবস্থা করুন। যতই বিলম্ব হইবে ততই দুর্বল হইয়া পড়িবেন।” অপর এক চিঠিতে রাধাকিশোরকে কবি লিখেছেন—” আমি স্যান্ডস সাহেবকে তিলমাত্র বিশ্বাস করি না।আমি নানা স্হান হইতে শুনিয়াছি যে স্যান্ডস নানা কৌশলে মহারাজের অর্থ শোষণ করে।…ইহাও দেখিলাম গভর্নমেন্টের সহিত মহারাজের সমস্ত কথাবার্তা…স্যান্ডস প্রভৃতি দুই একজন লোকের দ্বারা চালিত হইয়া থাকে। তাহারা ইচ্ছা করিলে এই ক্ষমতার এমন অপব্যবহার করিতে পারে যে তাহা মহারাজের পক্ষে সম্পূর্ণ বিপজ্জনক এমন স্হলে লেশমাত্র সন্দেহের কারণ থাকিলেও অতিমাত্র সাবধান হওয়া রাজার পক্ষে কর্তব্য।…”

রাধাকিশোরের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে আমরা যে রাজনীতিক রবীন্দ্রনাথের দেখা পাই তিনি আবার দেশীয় রাজ্য ত্রিপুরার বাজেটের মূল নীতি কি হবে তাও নির্ধারণ করে দেন। রাজ্যের শাসন বিভাগ ও রাজ সংসার বিভাগ নির্দিষ্ট ভাবে পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজনীয়তার উপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। রবীন্দ্রনাথ দূরে থেকেও ত্রিপুরার রাজসভার বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত খোঁজ খবর রাখতেন। কে ষড়যন্ত্র করছে, চক্রান্ত করছে, রাজার সচিব রাজকোষের অর্থ শোষণ করছেন কিনা সেসব বিষয়েও কবি বিস্তৃত খবর রাখতেন। ত্রিপুরার প্রতি কবির এই আগ্রহ যেন রীতিমত বিস্ময় সৃষ্টি করে। রাজার সঙ্গে পত্র যোগাযোগের সূত্রেই কবি যেমন রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন, তেমনই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের স্বাদও পেয়েছিলেন তিনি। ত্রিপুরার আরও ক’জন রাজপুরুষের সঙ্গে পত্র যোগাযোগ ছিল কবির। হয়তো তাদের মাধ্যমেও কবি অনেক খবরাখবর সংগ্রহ করতেন।এমন কি কবিকে নিয়ে প্রাসাদ পরিমন্ডলে কি আলোচনা হতো কবি সেই খবরও পেয়ে যেতেন।—চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content