শুক্রবার ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


রবীন্দ্রনাথ ও মহারাজ রাধাকিশোর।

মহারাজ রাধাকিশোরও পিতার মতো সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকা পাঠ করে কবি হেমচন্দ্রের দুরবস্হার কথা জেনে মহারাজা স্বেচ্ছায় রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে অন্ধ কবির জন্য মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক দীনেশচন্দ্র সেনের আজীবন মাসিক বৃত্তিরও ব্যবস্থা হয়েছিল ত্রিপুরা দরবার থেকে। সেই সময় বাংলার বিদগ্ধ সমাজের অনেকের সঙ্গেই রাধাকিশোরের যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। এদের মধ্যে ছিলেন যতীন্দ্র মোহন ঠাকুর, সৌরীন্দ্র মোহন ঠাকুর, রাসবিহারী ঘোষ, জগদীশচন্দ্র বসু, মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর, দ্বারভঙ্গের মহারাজা, কোচবিহারের মহারাজা, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিশিরকুমার প্রমুখ।

যাইহোক, কবির সঙ্গে রাধাকিশোরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে অবশ্য ইংরেজ কর্তৃপক্ষ সুনজরে দেখেনি। তখন দেশ ও সমাজ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ গভীর ভাবে চিন্তা ভাবনা করছেন। সমকালীন নানা প্রবন্ধে তাঁর এ সম্পর্কে মৌলিক চিন্তা ভাবনা ধরা পড়ছে। তিনি কাজ করছেন পল্লী উন্নয়নের বিষয়ে। সে সময় রবীন্দ্রনাথ রাধাকিশোরের চিন্তাধারাকে অনেকটা প্রভাবিত করেছিলেন বলে মনে হয়। দেশীয় রাজ্য ও রাজাদের সম্পর্কেও কবির পৃথক চিন্তা ভাবনা ছিল। তিনি মনে করতেন প্রজাপালন রাজার কর্তব্য। ঐশ্বর্যের অধিকার নয়, কর্তব্যের অধিকারই আসল। ব্রিটিশ অধিকৃত ভারত ভূখণ্ডের দেশীয় রাজাদের এই কর্তব্য আরও দ্বিগুণ ভাবে পালন করা উচিত বলে তিনি মনে করতেন।
রাধাকিশোরকে সে সময় ইংরেজ কর্তৃপক্ষ নানা চাপের মধ্যে রেখেছিল। একদিকে রাজ্যের আর্থিক সংকট এবং অপরদিকে রাজার বিরোধী পক্ষের ইংরেজদের দ্বারস্থ হওয়া-এ সব যেন ইংরেজ সরকারের কাছে তখন অনেক সুযোগ এনে দিয়েছিল। ইংরেজ শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে যুবরাজের শিক্ষাদানের জন্য ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট রাজাকে পীড়াপীড়ি করছিল। রাধাকিশোর এ ব্যাপারেও রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ চান। রবীন্দ্রনাথ তখন দার্জিলিঙে কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের সঙ্গে রাধাকিশোরের সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দেন। রবীন্দ্রনাথ মনে করেছিলেন দুই রাজার মধ্যে বন্ধুত্ব হলে নানা বিষয়ে উভয়েই উপকৃত হবেন। রাজকার্যের বিষয়ে ইংরেজ সরকারের সঙ্গে কোনো সমস্যার সৃষ্টি হলে উভয় রাজা পরামর্শ করতে পারবেন।

১৩০৬ বঙ্গাব্দে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে রাধাকিশোরের সঙ্গে আচার্য জগদীশচন্দ্রের সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটেছিল। রাজা পৌষমাসে কলকাতায় অবস্থান করছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের বিজ্ঞানাগারে আচার্য বসুর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাদি দেখাবার জন্য একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল। রাধাকিশোর এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সেদিন রাজাকে দেখে সবাই পুলকিত হয়েছিলেন। ইংরেজিতে বক্তব্য রেখে জগদীশচন্দ্র কয়েকটি পরীক্ষা উপস্থিত সুধীবৃন্দকে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৩৬: বীরচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৮: মংপুর কমলালেবু পেয়ে অসুস্থ কবি খুব আনন্দ পেয়েছিলেন

মহারাজা তেমন ইংরেজি না জানা সত্ত্বেও এই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগুলোর প্রক্রিয়া বুঝতে পেরেছিলেন এবং নিজহাতে দু’একটি এক্সপেরিমেন্ট করিয়ে দেখিয়ে দিয়ে জগদীশবাবুকে বলেছিলেন, “বাংলাতে আপনার আবিষ্কার সম্বন্ধে যে সব প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, তাহা আমি পড়িয়াছি এবং বিজ্ঞান আলোচনায় আমি বিশেষ আনন্দ পাই,আমিও আপনার একজন ছাত্র”। উত্তরে জগদীশচন্দ্র তখন বলেছিলেন,” এমএসসি ক্লাসের ছাত্রদের এ তথ্যগুলি বুঝাইতে গলদঘর্ম হইতে হয়,মহারাজ কেমন সুন্দর ভাবে এবং সহজে এসব বুঝিতে পাঠিয়েছেন”। তখন গবেষণার জন্য জগদীশচন্দ্রের একটি নিজস্ব বিজ্ঞানাগারের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু গবেষণাগার স্হাপনে অন্যূন কুড়ি হাজার টাকা কোথায় পাওয়া যাবে? মোটামুটি ঠিক হয়,ত্রিপুরা দরবার থেকে দশ হাজার টাকা এবং বাকী দশ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করে সংগ্রহ করা হবে।

মহারাজ রাধাকিশোর তখন কলকাতাতেই অবস্থান করছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এই উদ্দেশ্যে রাজার কাছে গেলে রাজা কবিকে বললেন, “এ বেশ আপনার সাজে না। আপনার বাঁশী বাজানই কাজ, আমরা ভক্তবৃন্দ ভিক্ষার ঝুলি বহন করিব। প্রজাবৃন্দের প্রদত্ত অর্থই আমার রাজভোগ যোগায়-আমাদের অপেক্ষা জগতে কে আর বড় ভিক্ষুক আছে?” সেই সময় রাধাকিশোরের জ্যেষ্ঠ পুত্র যুবরাজ বীরেন্দ্র কিশোরের বিবাহ সন্নিকটে। মহারাজা বলেছিলেন, “বর্তমানে আমার ভাবী বধূমাতার দু’এক পদ অলঙ্কার নাই বা হইল, তৎপরিবর্তে জগদীশবাবু সাগরপার হইতে যে অলঙ্কার ভারতমাতাকে ভূষিত করিবেন, তাহার তুলনা কোথায়!”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৮: পালাবার কোনও পথ নেই

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৫৪: আততায়ী এক, নাকি দুই?

আচার্য জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞানাগারের ব্যবস্থা হয়ে যায় রাজার উদার সহায়তায়। শুধু বিজ্ঞানাগার নয়, জগদীশচন্দ্রের বিলেত যাত্রা সহ তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণা সংক্রান্ত ব্যাপারে মহারাজ কয়েকবার তাঁকে অর্থ সাহায্য করেছেন। যতদূর জানা যায় মহারাজ ‘নিজ তহবিল’ থেকেই এই সব ব্যয় নির্বাহ করতেন।শুধু তাই নয়,এই অর্থ সাহায্যের ব্যাপারে গোপনীয়তা রক্ষা করার শর্ত দিয়েছিলেন মহারাজা। রাধাকিশোরের মৃত্যুর পর কবি ও জগদীশচন্দ্র কৃতজ্ঞ চিত্তে রাজার এই মহানুভবতার কথা প্রকাশ করেন।

শান্তিনিকেতনে ব্রহ্ম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই বার্ষিক এক হাজার টাকা করে অর্থ মঞ্জুর করেছিলেন রাজা। বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানাগারের জন্য যন্ত্রপাতি দান সহ ত্রিপুরা থেকে বৃত্তি দিয়ে ছাত্র পাঠিয়েছিলেন রাধাকিশোর। এসব ছাড়াও রাজা উদার ভাবে সাহিত্য সংস্কৃতির জন্য আর্থিক সহায়তা করেছেন। মহারাজা যে বাংলা ভাষার কতখানি গভীর অনুরাগী ছিলেন তা ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন মন্ত্রী রমণীমোহন চট্টোপাধ্যায়কে রাজার নিজের হাতে লেখা একটি নোট থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

মন্ত্রীকে রাজা লিখেছিলেন, “এখানে আবহমানকাল রাজকার্যে বাংলা ভাষার ব্যবহার এবং এই ভাষার উন্নতিকল্পে নানারূপ অনুষ্ঠান চলিয়া আসিতেছে,ইহা বঙ্গ দেশীয় হিন্দু রাজার পক্ষে বিশেষ গৌরবজনক মনে করি। বিশেষত আমি বঙ্গভাষাকে প্রাণের তুল্য ভালোবাসি এবং রাজকার্যে ব্যবহৃত ভাষা যাহাতে দিন দিন উন্নত হয় তৎপক্ষে চেষ্টিত হওয়া একান্ত কর্তব্য মনে করি। ইংরেজি শিক্ষিত কর্মচারী বর্গের দ্বারা রাজ্যের এই চিরপোষিত উদ্দেশ্য ও নিয়ম ব্যর্থ না হয় সে বিষয়ে আপনি তীব্র দৃষ্টি রাখিবেন।”
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৪ : অকারণে কেউ অন্যের ভালো করতে যায় না

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭০: ভানুপিসি ও শ্রীমার ভক্ত

রাধাকিশোরের বিজ্ঞান মনস্কতা, সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি উদার পৃষ্ঠপোষকতা এবং বাংলা ভাষার প্রতি রাজার গভীর অনুরাগ সম্ভবত প্রবল ভাবে আকৃষ্ট করেছিল রবীন্দ্রনাথকে। দিনে দিনে কবি ও রাজার মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। এক সময় রাজার জন্য মন্ত্রী ঠিক করে দেন কবি। রাজকুমারদের জন্য শিক্ষক নির্বাচন করেন তিনি। তবে রাধাকিশোরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এই ঘনিষ্ঠতা কিন্তু রাজ পারিষদদের সবাই ভালো চোখে দেখেননি। এক সময় কবিকে নিয়ে আগরতলাতে গুঞ্জনও উঠে। রাজার সঙ্গে সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে কবি নানা স্বার্থ সিদ্ধি করছেন এ রকম অভিযোগ ওঠে। যথা সময়ে কবির কানেও যায় এসব কথা। ব্যথিত কবি পত্র দেন রাজাকে।

রাজা অবশ্য এই সব কথা উড়িয়ে দেন নিছক গুজব বলে। ১৩০৮ বঙ্গাব্দের ২৪শে শ্রাবণ কবি রাধাকিশোরকে লেখেন, “মহারাজের সহিত আমি এমন কোনও সম্বন্ধ রাখিতে ইচ্ছা করি না যাতে লোকে স্বার্থ সিদ্ধির অপবাদ দিতে পারে।…” রাজাও বন্ধু কবির মান অভিমান বুঝতে পেরেছিলেন। কিছুদিন পর তিনি রবীন্দ্রনাথকে লেখেন যে, আগরতলা একটি দায়িত্ব বিহীন গুজবের স্হান। এই গুজবকে গুরুত্ব দিলে রাজার উপরই অবিচার করা হবে।—চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content