বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

রাজকার্যে বাংলা ভাষা ব্যবহারের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে ত্রিপুরার। অন্যান্য প্রান্তীয় রাজ্যেও অবশ্য রাজসভার কাজে বাংলার ব্যবহার ছিল, কিন্তু ত্রিপুরা নিঃসন্দেহে এ ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। সুদূর অতীত থেকে, মাণিক্য রাজবংশের প্রতিষ্ঠার প্রায় শুরু থেকেই ত্রিপুরার রাজকার্যে বাংলার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। অপেক্ষাকৃত আধুনিক যুগে তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। মহারাজা বীরচন্দ্র রাজকার্যে বাংলার ব্যবহার আইন করে অবশ্য প্রয়োজনীয় করে তুলেছিলেন। বীরচন্দ্রের পুত্র মহারাজ রাধাকিশোরও রাজকার্যে বাংলার ব্যবহার যাতে অব্যাহত থাকে সেজন্য মন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
‘রাজমালা’ অনুসারে রত্ন ফা ত্রিপুরার প্রথম রাজা যিনি ‘মাণিক্য’ উপাধি ধারণ করেছিলেন। আবার আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে মহা মাণিক্য প্রথম ‘মাণিক্য’ উপাধি গ্রহণ করেন। যাইহোক, পঞ্চদশ শতকের রাজা রত্ন মাণিক্যের (১৪৬৪-৮৮ খ্রি:) সময় থেকেই বঙ্গের মুসলমান শাসকদের সঙ্গে ত্রিপুরার যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। স্বাভাবিক ভাবেই রাজকার্যের ভাষাতেও তখন থেকেই পার্সি ও বাংলার প্রভাব পড়তে থাকে। গৌড়ে বসবাস কালে রত্ন ফা’র সঙ্গে কয়েকজন বাঙালির ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৩০: বাংলাতে রাজাদের চিঠিপত্র

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— রামবাণ ও পানি তাঙ্কি

ত্রিপুরার সিংহাসনে বসার পর রত্ন ফা তাদেরকে ত্রিপুরায় নিয়ে আসেন এবং বিপুল পরিমাণ নিষ্কর ভূমিদান সহ নানা রকম সাহায্য করেন। রাজানুকূল্যে তারা স্থায়ী ভাবে ত্রিপুরাতেই বসতি পত্তন করেন। কালক্রমে রাজকার্যেও নিযুক্ত হন তারা। পরবর্তী কালে তাদের বংশধরদের ক্ষেত্রেও বহূলাংশে এই ধারা অব্যাহত থাকে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ধারণা করা যায় যে, রত্ন মাণিক্যের আমল থেকেই ত্রিপুরার রাজসভার কাজে বাংলা ভাষার প্রভাব পড়তে থাকে। ত্রিপুরার রাজাদের মধ্যে প্রথম রত্ন মাণিক্যের মুদ্রাই আবিষ্কৃত হয়েছে। সেই সব মুদ্রায় বাংলার ব্যবহার রাজার বাংলার পৃষ্ঠপোষকতার কথাই যেন মনে করিয়ে দেয়। ১৩৮৬ শকাব্দ থেকে ১৩৮৯ শকাব্দ পর্যন্ত সময়কার প্রচারিত তাঁর কিছু মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। এর সব ক’টাতেই ছিল বাংলা লিপির ব্যবহার।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৯: শাসক বেকায়দায় পড়লেই প্রতিপক্ষকে সন্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদিও রাজনীতিতে সে সব মানা হয় না

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রাচীন মুদ্রার ভিত্তিতে এটা নিরূপিত হয়েছে যে, পঞ্চদশ শতক থেকেই ত্রিপুরার ঐতিহাসিক যুগের সূচনা ঘটেছে। আর তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সেই ঐতিহাসিক সূচনা লগ্ন থেকেই রাজাদের স্মারক মুদ্রা, শিলালিপি,রাজকীয় মোহর ইত্যাদিতে বাংলা লিপির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ত্রিপুরায় বাংলা গদ্যের প্রাচীনতম নিদর্শনও মেলে রাজকীয় সনদে। মহারাজা কল্যাণ মাণিক্যের ১৬৫১ খ্রিষ্টাব্দের সনদে রয়েছে এই প্রাচীন গদ্যের নিদর্শন। সনদটির ক’টি লাইন—“…রাজধানী হস্তিনাপুর সরকার উদয়পুর পরগণা নূরনগর মৌজে বাউরখাড় অজ্জঙ্গলাতে শতদ্রোণ ভূমি প্রীঁতে শ্রীমুকুন্দ বিদ্যাবাগীশ ভট্টাচার্যকে দিলাম ইহা আবাদ করিয়া পুত্র পৌত্রাদিক্রমে ভোগ করিয়া আশীর্ব্বাদ করিতে রহূক এহি ভূমির মাল খাজনা গয়রহ সমস্ত নিষেধ…”
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

মুভি রিভিউ: মামুটির মাল্টিস্টারার ছবি ‘সিবিআই ৫: দ্য ব্রেন’ গতানুগতিক থ্রিলার

ত্রিপুরার এই রাজকীয় সনদটি তৈরির প্রায় শতবর্ষ আগে ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে কোচবিহারের মহারাজা নরনারায়ণ আহোম রাজা চুকামফা স্বর্গদেবকে যে পত্র লেখেন তার কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে—“…লেখনং কার্য্যঞ্চ। এথা আমার কুশল। তোমার কুশল নিরন্তরে বাঞ্ছা করি। অখন তোমার আমার সন্তোষ সম্পাদক পত্রাপত্রি গতায়াত হইলে উভয়ানুকূল প্রীতির বীজ অঙ্কুরিত হইতে রহে। তোমার আমার, কর্ত্তব্যে বার্দ্ধতাক পাই পুষ্পিত ফলিত হইবেক। আমরা সেই উদ্যোগত আছি। তোমারও এগোট কর্ত্তব্য উচিত হয়না কর তাক আপনে জান। অধিক কি লেখিম। …”

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আহোম রাজাকে লেখা কোচ রাজার ঐতিহাসিক পত্র, যা কিনা বাংলা গদ্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে তার সঙ্গে ত্রিপুরার রাজা কল্যাণ মাণিক্যের সনদের ভাষার সাযুজ্য রয়েছে। আবার ১৬৩১ খ্রিস্টাব্দে গৌহাটির তদানীন্তন ফৌজদার নবাব আলোয়ার খাঁকে এক আহোম নৃপতির লেখা পত্রের কিছু অংশ হচ্ছে—“…সস্নেহ লিখনং কার্য্যঞ্চ।আগে এথা কুশল। তোমার কুশল সততে চাহি। পরং সমাচার পত্র এহি। এখন তোমার উকিল পত্র সহিত আসিয়া আমার স্থান পহূঁছিল। আমিও প্রীতিপ্রণয় পূর্ব্বক জ্ঞাত হইলাম।…”
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

ষোড়শ সপ্তদশ শতকের শতাব্দী কাল মধ্যে প্রান্তীয় রাজ্য সমূহের রাজসভার কাজে ব্যবহৃত ভাষা বাংলা গদ্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ত্রিপুরা,কোচবিহার এবং আহোম—শতাব্দী কালের মধ্যে তিন রাজ্যের ব্যবহৃত রাজকার্যের বাংলা এখানে উল্লেখ করা হল এ সম্পর্কে একটা ধারণা নেওয়ার জন্য। ১৯৭৬ সালে ত্রিপুরা সরকার প্রকাশিত ‘রাজগী ত্রিপুরার সরকারী বাংলা’ গ্রন্থের সম্পাদকীয়তে সুপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন—“…একশো বছরের ব্যবধান সত্ত্বেও কামতা-অহোমরাজের চিঠির ভাষার সঙ্গে ত্রিপুরার সনদী গদ্যের মতো কোচবিহার, মণিপুর, কাছাড় প্রভৃতি উত্তর পূর্ব ভারতের আরও কয়েকটি রাজ্যে তৎকালে প্রচলিত গদ্যের সাদৃশ্য দেখা গেছে।…কল্যাণ মাণিক্যের সনদে বাংলা গদ্যের যে নমুনাটি পাওয়া যায়,তা সতের শতকের প্রথম ভাগে প্রচলিত বাংলা গদ্যের প্রামাণ্য নজির হিসেবে গণ্য।…”—চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content