শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

মহারাজা বীরবিক্রমের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৪১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল কালীপ্রসন্ন সেনগুপ্ত সম্পাদিত ‘পঞ্চমাণিক্য’। ত্রিপুরার পাঁচ জন রাজার কীর্তি ও জীবন কাহিনী রয়েছে এতে। ত্রিপুরায় কাব্য সাহিত্যের মতো গদ্য সাহিত্যও যে রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন তার নিদর্শন হচ্ছে ‘পঞ্চমাণিক্য’ গ্ৰন্থটি। এর গদ্যরূপ—‘‘…যুবরাজের জীবনের আশা ত্যাগ করিয়া সকলেই শোকে অধীর হইয়া উঠিল। এই অবস্হা দর্শন করিয়া জনৈক বৃদ্ধ কুকি নানাবিধ বিষঘ্ন বনৌষধি প্রয়োগ দ্বারা যুবরাজের চিকিৎসা আরম্ভ করিল। তৃতীয় প্রহর বেলা পর্য্যন্ত ঔষধের কোনরূপ ক্রিয়া পরিলক্ষিত হইল না; যুবরাজ জীবিত কি মৃত, তাহা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। এই অবস্থা দর্শনে সকলেরই চিত্ত অত্যধিক ব্যাকুল হইয়া উঠিল।”
রাজ আমলের অপর এক বিখ্যাত লেখক হলেন কর্ণেল ঠাকুর মহিম চন্দ্র দেববর্মা। তিনি ছিলেন বীরচন্দ্রের এডিকং। রাধাকিশোরের সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ রাজকার্যে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি বেশ কিছু মূল্যবান প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। তদানীন্তন সময়ের উল্লেখযোগ্য সাময়িকী ‘সাধনা’, ‘প্রবাসী’, ‘বঙ্গদর্শন’, ‘মানসী’ প্রভৃতিতে তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। মৃত্যুর পর তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধ নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘দেশীয় রাজ্য’ গ্ৰন্থ। তদানীন্তন বঙ্গদেশের বিশিষ্ট পণ্ডিত, সাহিত্যিক-সহ সমাজের অনেকের সঙ্গেই কর্ণেল মহিম চন্দ্রের যোগাযোগ ছিল।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-২৮: রাজকন্যার কবিতার প্রশংসায় রবীন্দ্রনাথ

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ছাগল ক্ষুরি ও ধানি ঘাস

‘দেশীয় রাজ্য’ গ্ৰন্থে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একবার তাঁর সোনার চেনের সঙ্গে ঝোলানো সোনার মোহরে বাংলা অক্ষর দেখে পুলকিত হয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর সহর্ষে উপস্থিত সবাইকে বলেছিলেন—‘‘ইহাতে যে বাংলা ভাষা ছাপা। তবে আমার বাংলা রাজভাষা!” যাইহোক, সাবলীল গদ্যের জন্য আজও মহিমচন্দ্রের ‘দেশীয় রাজ্য’ গ্রন্থটি পাঠকদের কাছে সমাদৃত। তাঁর গদ্যের নমুনা—‘‘বীরচন্দ্রের মৃত্যুর পর রাধাকিশোর মাণিক্য ত্রিপুরার সিংহাসন লাভ করিলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমারো জীবনের পার্শ্ব পরিবর্ত্তন হইল। বৃদ্ধ মহারাজের বাৎসল্যরসের চালে ৩০ বৎসর পর্য্যন্ত অতিবাহিত হইয়াছিল। হঠাৎ আমাকে শুয়া পোকা হইতে পূর্ণ প্রজাপতির রূপ ধারণ করিতে হইল।নতুন নতুন জটিল সমস্যা এবং কার্য্যভার আমার স্কন্ধদেশ চাপিয়া বসিল।…”
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৯: ভারতের বিপ্লবী মেয়েরা এবং অন্তরে রবীন্দ্রনাথ

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৫২: পুলক রাখিতে নারি (কেল)

এ বার আসা যাক কৈলাসচন্দ্র সিংহের ‘রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস’ গ্ৰন্হের কথায়। তবে রাজন্য পৃষ্ঠপোষকতা নয়, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে রচিত এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৮৯৬ সালে। সুপ্রাচীন কাল থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ত্রিপুরার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যেমন ছড়িয়ে আছে গ্ৰন্হটিতে, তেমনই সেই আমলের বাংলা গদ্য সাহিত্যেরও এক সেরা নিদর্শন এটি।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৩: বেলুড়মঠে শ্রীমায়ের অভিনন্দন

গদ্যের নমুনা—‘‘… সেই সাধু পুরুষের বাক্যে উৎসাহিত হইয়া সমসের গাজী প্রথমেই জমিদার নাছির মহম্মদের কন্যার পাণি গ্রহণাভিলাষী হইলেন। জমিদার সমসেরের অন্যায় অভিলাষ শ্রবণে, তাহাকে বধ করিবার জন্য সৈন্য প্রেরণ করিলেন। জমিদার সৈন্যের আগমন বার্ত্তা শ্রবণে সমসের ও ছাদু পলায়ন করিলেন। তাঁহারা কিছুকাল বেদরাবাদ পরগণায় লুক্কায়িত থাকিয়া কতকগুলি দুষ্ট লোক সংগ্ৰহ করেন। সেই সকল দুষ্ট লোকের সাহায্যে ছাদু জমিদার নাছির মহাম্মদ ও তাঁহার পুত্র গণের বিনাশ সাধন করেন। তদন্তর সমসের বলক্রমে নাসির মহাম্মদের কন্যাকে বিবাহ করিয়া দক্ষিণ শিক অধিকার করেন। ত্রিপুরেশ্বর এই সংবাদ শ্রবণে তাহার বিরুদ্ধে একদল সৈন্য প্রেরণ করিলে সমসের বলে ও কৌশলে মহারাজার উজিরকে বাধ্য করিয়া কয়েক সহস্র মুদ্রা ‘নজর’ প্রদান পূর্বক দক্ষিণশিকের জমিদারীর সনন্দ গ্রহণ করিলেন।…”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮২: খটকা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

কৈলাসচন্দ্র সিংহ ছিলেন সেযুগের একজন বিখ্যাত পণ্ডিত, ইতিহাসবিদ ও সুলেখক।রাজমালা ছাড়াও তিনি আরও কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।—চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content