রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ত্রিপুরার রাজাদের মতো রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যেও বাংলা সাহিত্য চর্চার ধারা ছিল। বীরচন্দ্রের জ্যেষ্ঠ কন্যা অনঙ্গমোহিনী দেবী ছিলেন সেই আমলের এক বিশিষ্ট কবি। রাজকুমারীর কাব্য প্রতিভার কথা সেদিন ত্রিপুরার গন্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বৃহত্তর বঙ্গদেশে। এমনকি রবীন্দ্রনাথও অনঙ্গমোহিনীর কাব্যের প্রশংসা করেছিলেন। পিতার অনুপ্রেরণাতেই রাজকুমারী কাব্য রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। ১৮৯৮ সালে অনঙ্গমোহিনীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কণিকা’ প্রকাশিত হয়। এছাড়াও তাঁর আরও দুটি কাব্যগ্রন্থ রয়েছে। ১৯০৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘শোকগাঁথা’ এবং ১৯০৭ সালে ‘প্রীতি’। ‘কণিকা’তে সন্নিবিষ্ট বর্ষা কবিতায় কবি বর্ষার রূপ বর্ণনা করেছেন এই ভাবে—
সবুজ শ্যামল ক্ষেতে ভিজিয়ে কুষণে,
নিড়াইছে ক্ষেত্রচয় গেয়ে গ্রাম্য গান,
অদূরেতে কৃষকের কুঁড়ে ঘরগুলি,
রাখিয়াছে নিরন্তর স্নেহ পাখা খুলি…
দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘শোকগাঁথা’ প্রকাশের এক বছর আগে অনঙ্গমোহিনীর স্বামীর মৃত্যু ঘটেছিল। গ্রন্হটিতে সন্নিবিষ্ট কবিতার ছত্রে ছত্রে যেন ধরা পড়েছে কবি শোকোচ্ছ্বাস। গ্রন্থের উৎসর্গ অংশে তিনি লিখেছেন—
হৃদয়ের ভাঙ্গা ঘরে,
বিষাদ বরষা ঝরে,
শোক-বায়ু হু হু করে সদা করে খেলা;
গণিতেছি গত দিন,
একাকিনী সাথিহীন,
জানি না ফুরাবে কবে জীবনের বেলা!
নিড়াইছে ক্ষেত্রচয় গেয়ে গ্রাম্য গান,
অদূরেতে কৃষকের কুঁড়ে ঘরগুলি,
রাখিয়াছে নিরন্তর স্নেহ পাখা খুলি…
দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘শোকগাঁথা’ প্রকাশের এক বছর আগে অনঙ্গমোহিনীর স্বামীর মৃত্যু ঘটেছিল। গ্রন্হটিতে সন্নিবিষ্ট কবিতার ছত্রে ছত্রে যেন ধরা পড়েছে কবি শোকোচ্ছ্বাস। গ্রন্থের উৎসর্গ অংশে তিনি লিখেছেন—
বিষাদ বরষা ঝরে,
শোক-বায়ু হু হু করে সদা করে খেলা;
গণিতেছি গত দিন,
একাকিনী সাথিহীন,
জানি না ফুরাবে কবে জীবনের বেলা!
স্বামী বিয়োগ ব্যথায় কাতর এক হৃদয়ের ভাষাই যেন ধরা পড়েছে প্রায় প্রতিটি কবিতায়। যেমন ‘চিরস্মৃতি’ কবিতায় তিনি বলেছেন—
চিরতরে চলে গেছে হৃদয়ের রাজ,
অতল বিষাদে মোরে ডুবাইয়ে আজ!
নিয়ে গেছে সুখ সাধ সুখের বাসনা,
রেখে গেছে জন্ম শোধ হৃদয় বেদনা।
সে মম পুষ্পিত শুভ্র বসন্ত জীবন,
গেছে যবে,সাথে গেছে আমার ভুবন!
সেকালের বঙ্গদেশের গুণীজনেরা সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ত্রিপুরার রাজপরিবারের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। ‘শোকগাঁথা’ কাব্যগ্ৰন্হের ভূমিকায় বিজয়চন্দ্র মজুমদার লিখেছেন—”ত্রিপুরার রাজপরিবারে সরস্বতীর বিশেষ কৃপা। সঙ্গীতে, চিত্রে, কাব্যে রাজপরিবারের সুখ্যাতি বঙ্গদেশ ব্যাপী। রাজপরিবারের মহিলাগণও যে উহাতে অনুরাগিনী এবং কবিত্ব প্রতিভায় দীপ্তিমতী, রাজকুমারী অনঙ্গমোহিনী দেবীর কবিতায় তাহা প্রতিষ্ঠিত হইতেছে।” রবীন্দ্রনাথও অনঙ্গমোহিনীর কাব্যের প্রশংসা করেছেন। ‘কণিকা’ ও ‘শোকগাঁথা’ উপহার পেয়ে তিনি কবিকে লিখেছেন— …আপনার এই কবিতাগুলির মধ্যে কবিত্বের একটি স্বাভাবিক সৌরভ অনুভব করি। ইহাদের সৌন্দর্য্য বড় সরল এবং সুকুমার— অথচ কলা নৈপুণ্যও আপনার পক্ষে স্বভাবসিদ্ধ।…”
অতল বিষাদে মোরে ডুবাইয়ে আজ!
নিয়ে গেছে সুখ সাধ সুখের বাসনা,
রেখে গেছে জন্ম শোধ হৃদয় বেদনা।
সে মম পুষ্পিত শুভ্র বসন্ত জীবন,
গেছে যবে,সাথে গেছে আমার ভুবন!
সেকালের বঙ্গদেশের গুণীজনেরা সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ত্রিপুরার রাজপরিবারের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। ‘শোকগাঁথা’ কাব্যগ্ৰন্হের ভূমিকায় বিজয়চন্দ্র মজুমদার লিখেছেন—”ত্রিপুরার রাজপরিবারে সরস্বতীর বিশেষ কৃপা। সঙ্গীতে, চিত্রে, কাব্যে রাজপরিবারের সুখ্যাতি বঙ্গদেশ ব্যাপী। রাজপরিবারের মহিলাগণও যে উহাতে অনুরাগিনী এবং কবিত্ব প্রতিভায় দীপ্তিমতী, রাজকুমারী অনঙ্গমোহিনী দেবীর কবিতায় তাহা প্রতিষ্ঠিত হইতেছে।” রবীন্দ্রনাথও অনঙ্গমোহিনীর কাব্যের প্রশংসা করেছেন। ‘কণিকা’ ও ‘শোকগাঁথা’ উপহার পেয়ে তিনি কবিকে লিখেছেন— …আপনার এই কবিতাগুলির মধ্যে কবিত্বের একটি স্বাভাবিক সৌরভ অনুভব করি। ইহাদের সৌন্দর্য্য বড় সরল এবং সুকুমার— অথচ কলা নৈপুণ্যও আপনার পক্ষে স্বভাবসিদ্ধ।…”
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, পর্ব-২৭: সঙ্গীত রচয়িতা বীরবিক্রম
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬২: শ্রীমার দক্ষিণ ভারত থেকে প্রত্যাবর্তন
১৩১৮ বঙ্গাব্দের ১৭ শ্রাবণের এই পত্রে অনঙ্গমোহিনীকে কবি আরও লিখেছেন—”আপনি নিশ্চয় জানেন, আপনার পিতা আমাকে স্নেহ করিতেন এবং আপনার ভ্রাতা স্বর্গীয় মহারাজও আমাকে বন্ধু বলিয়া গণ্য করিয়েছিলেন, আপনাদের পরিবারের সহিত আমার এই আন্তরিক প্রীতি সম্বন্ধ আছে বলিয়া আপনার কবিত্য পরিচয়ে আমি বিশেষ ভাবে তৃপ্তিলাভ করিয়াছি। আপনার এই কবিত্ব শক্তির পূর্ণ বিকাশের মধ্যে আপনার জীবনের সমস্ত দুঃখ বেদনা সার্থকতা লাভ করুক এই আমার কামনা।” মহারাজা বীরচন্দ্রের কনিষ্ঠা কন্যা মৃণালিনী দেবী, অপর কন্যা গিরিবালা দেবীও বাংলাতে কাব্য রচনা করতেন। তাদের কাব্য জনসাধারণের কাছে প্রকাশ না পেলেও অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি থেকে বোঝা যায়, মাধুর্য ছিল তাঁদের কাব্যেও।
ত্রিপুরার রাজারা যেমন কাব্য চর্চা করেছেন, তেমনই রানিদেরও কেউ কেউ কাব্য চর্চা করেছেন। রাধাকিশোর মাণিক্যের রানি তুলসীবতী দেবী প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না থাকলেও এ রাজ্যে নারী শিক্ষা প্রসারে তাঁর অবদান অক্ষয় হয়ে আছে। আগরতলায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা তুলসীবতী বালিকা বিদ্যালয়টি যেন সেই ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে। মহারানি তুলসীবতী মুখে মুখে সংগীত রচনা করতে পারতেন। হোলির সংগীত রচনায় তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল সেদিন। তাঁর রচিত এরকম একটি সংগীত হল—
ঘেরি ঘেরি সখী সবে পুলকে মাতিল যবে,
আবির কুমকুম কস্তুরী দিতেছে শ্যামের অঙ্গে,
লাল লাল হল তনু,আকুলিত রাই কানু,
চূড়া কুন্ডলে হেলে বাজে মোহন বাঁশিরে!
হেরি অপরূপ রাই-কানুরূপ
তুলসীবতী যেন রাঙাপদ হেরে রে।
রাধাকিশোর মাণিক্যের পুত্র নরেন্দ্র কিশোর দেববর্মণ পূর্ব পুরুষদের মতোএকজন সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। তিনি নিজেও কাব্য চর্চা করতেন। তিনিও রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক সংগীত রচনা করেছেন। যেমন—
সুনীল অম্বর, শ্যামসুন্দর, তরুণ-অরুণ-রাই।
দিবস যামিনী, শ্যাম বিনোদিনী, দেখি বলিহারী যাই।।
ত্রিপুরার রাজারা যেমন কাব্য চর্চা করেছেন, তেমনই রানিদেরও কেউ কেউ কাব্য চর্চা করেছেন। রাধাকিশোর মাণিক্যের রানি তুলসীবতী দেবী প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না থাকলেও এ রাজ্যে নারী শিক্ষা প্রসারে তাঁর অবদান অক্ষয় হয়ে আছে। আগরতলায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা তুলসীবতী বালিকা বিদ্যালয়টি যেন সেই ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে। মহারানি তুলসীবতী মুখে মুখে সংগীত রচনা করতে পারতেন। হোলির সংগীত রচনায় তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল সেদিন। তাঁর রচিত এরকম একটি সংগীত হল—
আবির কুমকুম কস্তুরী দিতেছে শ্যামের অঙ্গে,
লাল লাল হল তনু,আকুলিত রাই কানু,
চূড়া কুন্ডলে হেলে বাজে মোহন বাঁশিরে!
হেরি অপরূপ রাই-কানুরূপ
তুলসীবতী যেন রাঙাপদ হেরে রে।
রাধাকিশোর মাণিক্যের পুত্র নরেন্দ্র কিশোর দেববর্মণ পূর্ব পুরুষদের মতোএকজন সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। তিনি নিজেও কাব্য চর্চা করতেন। তিনিও রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক সংগীত রচনা করেছেন। যেমন—
দিবস যামিনী, শ্যাম বিনোদিনী, দেখি বলিহারী যাই।।
আরও পড়ুন:
পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮২: খটকা
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৬:কোনও একটি দাবিতে বিরোধীরা জোট বাঁধুক কখনও চায় না শাসক
রাজ আমলে ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত সুবিখ্যাত ‘রবি’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। কাব্য সাহিত্যের মতো গদ্য সাহিত্যেও ত্রিপুরার রাজপরিবারের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। মহারাজা ঈশানচন্দ্র মাণিক্যের (১৮৪৯-৬২) পুত্র নবদ্বীপ চন্দ্র দেববর্মার ‘আবর্জ্জনার ঝুড়ি’ বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ত্রিপুরার উল্লেখযোগ্য বাংলা গদ্য সাহিত্যের নিদর্শন হয়ে আছে। ‘আবর্জ্জনার ঝুড়ি’ এবং ‘বাংলা ভাষার চারি যুগ’—এই দুটি রচনার মধ্যে তাঁর প্রশংসনীয় গদ্যশৈলীর পরিচয় পাওয়া যায়। ‘আবর্জ্জনার ঝুড়ি’তে সন্নিবিষ্ট বিভিন্ন রচনাকে লেখক নিজেই বলেছেন আবর্জ্জনা। কিন্তু পাঠকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় মনে হবে তা।
লেখক রচনা সমূহে তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। কখনও সূক্ষ্ম শ্লেষাত্মক ভঙ্গীমায় তুলে ধরেছেন নানা অভিজ্ঞতার কথা। যেহেতু লেখক ছিলেন রাজপুত্র, তাই স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর জীবনীমূলক রচনাগুলোতে স্থান পেয়েছে রাজনৈতিক অবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্হা ইত্যাদি। ১৩২৪ বঙ্গাব্দের ‘ত্রিবেণী’ পত্রিকার কার্তিক ও অগ্রহায়ন সংখ্যায় লেখাটির কিছু অংশ প্রকাশিত হয়। তার প্রায় অর্ধশতাধিক বছর পর ‘আমাদের ত্রিপুরা’তে লেখাটির কয়েক কিস্তি প্রকাশিত হয়। ২০০৪ সালে ত্রিপুরা সরকারের উপজাতি সাংস্কৃতিক গবেষণা কেন্দ্র ও সংগ্রহশালার উদ্যোগে ‘আবর্জ্জনা ঝুড়ি’ গ্রন্হকারে প্রকাশিত হয়। লেখকের গদ্যশৈলী পাঠকদের আকৃষ্ট করবে। এখানে তাঁর গদ্যের কিছুটা নমুনা তুলে ধরা হচ্ছে।
যেমন—”পিতৃদেবের জন্য একটি নতুন গৃহ প্রস্তুত হইয়াছিল। ১২৭২ ত্রিপুরাব্দের ১৬ শ্রাবণ প্রভাতে পিতৃদেব আমাদের সকলকে সঙ্গে করিয়া নতুন গৃহে প্রবেশ করেন। কর্তাপ্রভু সেদিন বিরাট ঘটায় মহোৎসব করিয়াছিলেন। সমস্ত দিন মহোৎসবের হরিনাম ধ্বনিতে রাজপ্রাসাদ প্রতিশব্দায়মান রহিল। পরদিন প্রভাতে আবার পিতৃদেবের স্বর্গ-প্রয়াণের সংবাদ আর একবার হরিধ্বনির মহারোল রাজভবন প্রতিধ্বনিত করিয়া, ঊর্ধ্বলোকে চলিয়া গেল।”
লেখক রচনা সমূহে তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। কখনও সূক্ষ্ম শ্লেষাত্মক ভঙ্গীমায় তুলে ধরেছেন নানা অভিজ্ঞতার কথা। যেহেতু লেখক ছিলেন রাজপুত্র, তাই স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর জীবনীমূলক রচনাগুলোতে স্থান পেয়েছে রাজনৈতিক অবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্হা ইত্যাদি। ১৩২৪ বঙ্গাব্দের ‘ত্রিবেণী’ পত্রিকার কার্তিক ও অগ্রহায়ন সংখ্যায় লেখাটির কিছু অংশ প্রকাশিত হয়। তার প্রায় অর্ধশতাধিক বছর পর ‘আমাদের ত্রিপুরা’তে লেখাটির কয়েক কিস্তি প্রকাশিত হয়। ২০০৪ সালে ত্রিপুরা সরকারের উপজাতি সাংস্কৃতিক গবেষণা কেন্দ্র ও সংগ্রহশালার উদ্যোগে ‘আবর্জ্জনা ঝুড়ি’ গ্রন্হকারে প্রকাশিত হয়। লেখকের গদ্যশৈলী পাঠকদের আকৃষ্ট করবে। এখানে তাঁর গদ্যের কিছুটা নমুনা তুলে ধরা হচ্ছে।
যেমন—”পিতৃদেবের জন্য একটি নতুন গৃহ প্রস্তুত হইয়াছিল। ১২৭২ ত্রিপুরাব্দের ১৬ শ্রাবণ প্রভাতে পিতৃদেব আমাদের সকলকে সঙ্গে করিয়া নতুন গৃহে প্রবেশ করেন। কর্তাপ্রভু সেদিন বিরাট ঘটায় মহোৎসব করিয়াছিলেন। সমস্ত দিন মহোৎসবের হরিনাম ধ্বনিতে রাজপ্রাসাদ প্রতিশব্দায়মান রহিল। পরদিন প্রভাতে আবার পিতৃদেবের স্বর্গ-প্রয়াণের সংবাদ আর একবার হরিধ্বনির মহারোল রাজভবন প্রতিধ্বনিত করিয়া, ঊর্ধ্বলোকে চলিয়া গেল।”
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৮: যেথা আমি যাই নাকো / তুমি প্রকাশিত থাকো
মহারাজা ঈশানচন্দ্র মাণিক্যের মৃত্যুর পর একটি বিতর্কিত ‘রোবকারী’ মূলে সিংহাসনে বসেছিলেন প্রয়াত রাজার ভাই অর্থাৎ নবদ্বীপচন্দ্রের কাকা বীরচন্দ্র। পরবর্তী সময়ে রাজত্বের উত্তরাধিকার নিয়ে বীরচন্দ্রের সঙ্গে ভ্রাতুষ্পুত্র নবদ্বীপচন্দ্রের আইনি লড়াই হয়েছিল। কিন্তু নবদ্বীপচন্দ্র শেষপর্যন্ত মামলায় হেরে গিয়েছিলেন। তারপর মাকে নিয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন কুমিল্লায়। সেখানেই পাকাপাকি ভাবে বসবাস করতে থাকেন নবদ্বীপচন্দ্র। শেষ বয়সে অবশ্য মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোরের অনুরোধে আগরতলায় এসে তিনি ত্রিপুরার মন্ত্রী পদের দায়িত্ব ভার পালন করেছিলেন।
মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের পুত্র বড় ঠাকুর সমরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মণও সে যুগের একজন বিশিষ্ট লেখক ছিলেন। তাঁর রচিত বিভিন্ন গ্রন্হে প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাসের নানা উপকরণ ছড়িয়ে আছে। ১৯২৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘আগ্রার চিঠি’ গ্রন্থ। তারপর একে একে প্রকাশিত হয় ‘ভারতীয় স্মৃতি’, ‘ত্রিপুরার স্মৃতি’,’জেবুন্নিসা বেগম’ গ্রন্থ সমূহ। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘ত্রিপুরার স্মৃতি’ গ্রন্হে লেখক ত্রিপুরার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্হানের বিবরণ সহ প্রত্নতাত্ত্বিক বিবরণ তুলে ধরেছেন। ত্রিপুরার পাঠকদের কাছে আজও গ্রন্হটির বিপুল জনপ্রিয়তা রয়েছে।
মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের পুত্র বড় ঠাকুর সমরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মণও সে যুগের একজন বিশিষ্ট লেখক ছিলেন। তাঁর রচিত বিভিন্ন গ্রন্হে প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাসের নানা উপকরণ ছড়িয়ে আছে। ১৯২৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘আগ্রার চিঠি’ গ্রন্থ। তারপর একে একে প্রকাশিত হয় ‘ভারতীয় স্মৃতি’, ‘ত্রিপুরার স্মৃতি’,’জেবুন্নিসা বেগম’ গ্রন্থ সমূহ। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘ত্রিপুরার স্মৃতি’ গ্রন্হে লেখক ত্রিপুরার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্হানের বিবরণ সহ প্রত্নতাত্ত্বিক বিবরণ তুলে ধরেছেন। ত্রিপুরার পাঠকদের কাছে আজও গ্রন্হটির বিপুল জনপ্রিয়তা রয়েছে।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৮: নন্দিতা কৃপালনি— বিশ শতকের বিদুষী
‘আগ্ৰার চিঠি’ গ্রন্থটিতে লেখক ঐতিহাসিক তথ্য, পুরাতত্ত্ব ইত্যাদির পাশাপাশি আগ্রার মানুষের জীবনচিত্রও তুলে ধরেছেন। গদ্যের নমুনা” এ দেশের স্ত্রী লোকেরা সচরাচর ঘাগরা পরে,মাঝে মাঝে চুনরি শাড়ি পরিতেও দেখা যায়। আঙ্গিয়া গায়ে দিয়া তার উপর ওড়নাতে সমস্ত গা ঢাকা। ঘোমটা ছাড়া খালি মাথায় চলাফিরা করে না। মুসলমান স্ত্রীলোকদিগের মধ্যে অনেকেই পুরুষের মতো ইজার পরিয়া পিরাণ গায়ে দেয়, তার উপর উড়না উড়ে।কখনও কখনও আঙ্গিয়াও গায়ে দেয়।” বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে সমরেন্দ্র চন্দ্রের রচিত গ্রন্থসমূহ সেই সময়কালের ত্রিপুরার বাংলা গদ্য সাহিত্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
এমনকি আজও সেইসব গ্রন্হ জনপ্রিয়। বর্তমান কালেও তাঁর কোনো কোনো গ্রন্থ পুনর্মুদ্রিত হচ্ছে। বাংলা,সংস্কৃতের মতো আরবি, ফারসি ও ইংরেজিতে সমরেন্দ্র চন্দ্রের ভাল দখল ছিল। তিনি তাঁর ‘ত্রিপুরার স্মৃতি’ গ্রন্থটি উর্দুতে অনুবাদ করেছিলেন। এই গ্রন্হটিতে বাংলা গদ্যের নমুনা—”… জ্ঞাত হওয়া যায় যে, গোবিন্দ মাণিক্য রাজ্যভ্রষ্ট হইয়া চট্টগ্রামের পার্ব্বত্য প্রদেশে গমন পূর্ব্বক তথায় বাস করিয়াছিলেন। তৎপ্রদেশের অন্তর্ব্বর্তী একটি গিরি শ্রেণির পাদদেশে প্রবাহিত ‘কাসলং’ নামক নদীর শাখা ‘মাইনী’ নদীর তীরে কতিপয় ফলবৃক্ষ,সরোবর ও ইষ্টক নির্ম্মিত ভবনাদির ধ্বংসাবশেষ দৃষ্টিপথে পতিত হয়।…”
এখানে উল্লেখ করা যায় যে, নবদ্বীপ চন্দ্র কিংবা সমরেন্দ্র চন্দ্রের সাহিত্য কীর্তি কোনোটাই কিন্তু রাজা বা রাজদরবারের পৃষ্ঠপোষকতায় হয়নি।তবে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ত্রিপুরায় সেই আমলে সাহিত্য চর্চার যে ধারা গড়ে উঠেছিল তাতেই তারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।—চলবে।
এমনকি আজও সেইসব গ্রন্হ জনপ্রিয়। বর্তমান কালেও তাঁর কোনো কোনো গ্রন্থ পুনর্মুদ্রিত হচ্ছে। বাংলা,সংস্কৃতের মতো আরবি, ফারসি ও ইংরেজিতে সমরেন্দ্র চন্দ্রের ভাল দখল ছিল। তিনি তাঁর ‘ত্রিপুরার স্মৃতি’ গ্রন্থটি উর্দুতে অনুবাদ করেছিলেন। এই গ্রন্হটিতে বাংলা গদ্যের নমুনা—”… জ্ঞাত হওয়া যায় যে, গোবিন্দ মাণিক্য রাজ্যভ্রষ্ট হইয়া চট্টগ্রামের পার্ব্বত্য প্রদেশে গমন পূর্ব্বক তথায় বাস করিয়াছিলেন। তৎপ্রদেশের অন্তর্ব্বর্তী একটি গিরি শ্রেণির পাদদেশে প্রবাহিত ‘কাসলং’ নামক নদীর শাখা ‘মাইনী’ নদীর তীরে কতিপয় ফলবৃক্ষ,সরোবর ও ইষ্টক নির্ম্মিত ভবনাদির ধ্বংসাবশেষ দৃষ্টিপথে পতিত হয়।…”
এখানে উল্লেখ করা যায় যে, নবদ্বীপ চন্দ্র কিংবা সমরেন্দ্র চন্দ্রের সাহিত্য কীর্তি কোনোটাই কিন্তু রাজা বা রাজদরবারের পৃষ্ঠপোষকতায় হয়নি।তবে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ত্রিপুরায় সেই আমলে সাহিত্য চর্চার যে ধারা গড়ে উঠেছিল তাতেই তারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।—চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।