শনিবার ১ মার্চ, ২০২৫


শামসের গাজি। ছবি: সংগৃহীত।

অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ত্রিপুরার ইতিহাসের এক বর্ণাঢ্য চরিত্র শামসের গাজির বীরত্ব, সাধারণ প্রজা থেকে তাঁর ত্রিপুরার সিংহাসন লাভ ইত্যাদি নিয়ে রচিত হয়েছিল ‘গাজিনামা’। সেখ মনোহর নামে এক গ্ৰাম্য কবির স্বতঃপ্রণোদিত সৃষ্টি হচ্ছে ‘গাজিনামা’। দ্বিতীয় বিজয় মাণিক্যের রাজত্বকালের (১৭৪৬-৫১ খ্রিঃ) শেষ পর্যায়ে সমসেরের প্রবল উত্থান ত্রিপুরার ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
রাজপরিবারের মধ্যে ষড়যন্ত্র, বিদ্রোহ কিংবা কখনও গুপ্তহত্যার মতো ঘটনায় ইতিহাসের চাকা উল্টোপথে ঘুরেছে। কিন্তু রাজপরিবারের সঙ্গে সংস্রবহীন সম্পূর্ণ বাইরের একজন সাধারণ প্রজা নিজের বুদ্ধি আর বাহুবলে ত্রিপুরার সর্বময় কর্তা হয়ে উঠেছিলেন, এটা যেন যুগপৎ অবিশ্বাস্য এবং কৌতুহলোদ্দীপক।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-২৫: ইতিহাসাশ্রিত কাব্য কৃষ্ণমালা

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮০: বুধন মাহাতো কেস

পিতামহের কাছে সমসের গাজির বীরত্বের কাহিনি শুনে গ্রাম্যকবি সেখ মনোহর সমসেরের অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং কাব্যটি রচনা করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে অথবা ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ‘গাজিনামা’ রচিত হয়েছিল। সমসের ছিলেন এক ফকিরের সন্তান। কবি তাঁকে ‘পীরের নন্দন’ বলে উল্লেখ করেছেন। দক্ষিণ শিকের জমিদার নাছির মহম্মদের পুত্রদের সঙ্গে সমসের একই মোক্তবে পড়াশোনা করতেন জমিদারের পৃষ্ঠপোষকতায়। সেসময় তাঁর অসাধারণ প্রতিভার প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৫: পতন আসন্ন হলেই সবার বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়

দশভুজা, পর্ব-৩৬: মৃণালিনী— রবি ঠাকুরের স্ত্রী-র লেখকসত্তা

অল্পকালের মধ্যেই জমিদার পুত্রদের ছাপিয়ে যায় সমসের। জমিদার তাঁকে তপশিলদার নিউযুক্ত করেন। একদিন গদা হুসেন খন্দকার নামে এক ফকির শামসেরকে একটি তরবারি ও অশ্ব দিয়ে বলেন যে, জমিদার নাছির মহম্মদের মৃত্যু হবে। সমসের জমিদারি পাবে। রাজার সঙ্গে শামসেরের যুদ্ধ হবে। আল্লা দয়া করলে সমসের রাজা হবে। ‘গাজিনামা’র কবি লিখেছেন—
নাছির যাইব মারা পাইবা জমিদারী।
রাজা বংশ ভঙ্গ হৈব হৈবা অধিকারী।।
কিন্তু রাজার সঙ্গে তোমার হৈব মহারণ।
আল্লা এ করিলে হৈবা রার্জ্যের ভাজন।।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬০: শ্রীমার রামেশ্বরম যাত্রা

শেষ পর্যন্ত ফকিরের ভবিষ্যৎবাণী সত্যে পরিণত হয়েছিল। ত্রিপুরার রাজা হয়েছিলেন সমসের। শামসেরের রাজত্বে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা তথা শাসনে তাঁর দক্ষতা, দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে তাঁর উদ্যোগ ইত্যাদি কাব্যে উল্লেখ রয়েছে। শামসেরের রাজত্বে প্রজাদের অবস্হার বর্ণনা কবি এই ভাবে দিয়েছেন—
লোকের বিচার গাজি করে ভাল মতে।
হকেত বেহক কেহ পারে করিতে।।
গাজির দোহাই পারে নগরে বাজারে।
গজে নাহি মরে লোক ব্যাগ্রে নাহি ধরে।।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

অর্থ লোভের বশবর্তী হয়ে শামসের অবশ্য বিভিন্ন এলাকায় দলবল নিয়ে ডাকাতিও করতেন। আর এতেই শামসেরের বিপর্যয় ঘনীভূত হয়। বাংলার নবাবের কাছে তাঁর নামে নানা অভিযোগ যায়। কবি অবশ্য লিখেছেন শামসেরের বক্তব্যে নবাব সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু শামসেরের শত্রু নবাবের এক সভাসদ তাঁকে রংপুর নিয়ে যায় এবং তোপের মুখে বেঁধে হত্যা করে। শামসেরের সময়কালের কিছু কিছু ঐতিহাসিক উপাদানের জন্য ‘গাজিনামা’ এক উল্লেখযোগ্য কাব্য। —চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content