বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

ত্রিপুরার মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৃপতি ছিলেন ধন্য মাণিক্য (১৪৯০-১৫১৫ খ্রিস্টাব্দ)। তাঁর আমলে রাজ্যের সীমা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল। বঙ্গাধিপতি হুসেন শাহকেও তিনি যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন। পার্শ্ববর্তী এলাকা সমূহ জয় করে সেসব ত্রিপুরার সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন তিনি। উদয়পুরে মাতা ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির প্রতিষ্ঠা তাঁর অক্ষয় কীর্তি হয়ে আছে। ধন্য মাণিক্য বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে বেশ কিছু ধর্মগ্ৰন্থ বাংলাতে অনূদিত হয়েছিল। ‘উৎকল খন্ড পাঁচালী’, ‘যাত্রা রত্নাকরনিধি’ এবং ‘প্রেত চতুর্দশীর গীত’ তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত হয়। ত্রিপুরায় সঙ্গীতচর্চার প্রসারে ধন্য মাণিক্য মিথিলা থেকে রাজ্যে কয়েকজন সংগীতজ্ঞ এনেছিলেন।
ত্রিপুরার ইতিহাসে নানা কারণে উজ্জ্বল হয়ে আছেন গোবিন্দ মাণিক্য। ত্রিপুরায় আবহমানকাল থেকে চলে আসা নরবলি প্রথা তিনিই রদ করেছিলেন। ১৬৬০ থেকে ১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দু’দফায় রাজত্ব করেছিলেন তিনি। মাঝে কিছুকাল সিংহাসনে ছিলেন তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই ছত্র মাণিক্য। ত্রিপুরার রাজপরিবারে ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব, মোগল পরিবারে সংঘাত, সুজার পলায়ন, ত্রিপুরার রাজাকে ঔরঙ্গজেবের হুমকি সম্বলিত পত্র-গোবিন্দ মাণিক্যের রাজত্বকালে যেন ঘটনার ঘনঘটা। এই পটভূমিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘রাজর্ষি’ ও ‘বিসর্জন’।মহারাজা গোবিন্দ মাণিক্য সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি বাংলাতে অনুবাদ করিয়েছিলেন ‘বৃহন্নারদীয় পুরাণ’। এই গ্রন্হ রচয়িতার নাম অবশ্য পাওয়া যায়নি। তবে একটি ভণিতায় রয়েছে—
শ্রী শ্রী যুত গোবিন্দ মানিক্য নরেশ্বরে।
নারদীয় অর্থ সব লোকে বুঝিবারে।।
পাচালী করাইল রাজা অনুমতি দিয়া।
পণ্ডিত সকলে কৈল পুরাণ দেখিয়া।।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-২২: মাণিক্য রাজাদের বাংলার পৃষ্ঠপোষকতা

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৪: যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না?

ভণিতা থেকে স্পষ্টতই ধারণা করা যায় যে, একাধিক পণ্ডিত ব্যক্তি সম্মিলিত ভাবে এই গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। রাজাদেশে অনূদিত বৃহন্নারদীয় পুরাণের কয়েকটি লাইন—
পরাজিত হৈয়া রাজা ছাড়ি নিজ দেশ,
পত্নী সঙ্গে ঘোর বনে করিল প্রবেশ।
রাজ মহিষীর গর্ভ দেখিয়া লক্ষ্মণ,
অতিশয় ভীত হৈয়া যত শত্রুগণ।
মন্ত্রণা করিয়া গর্ভ নাশের কারণ,
অলক্ষিতে করাইল গরল ভোজন।…


শুধু গ্ৰন্থ রচনাই নয়, তা যাতে সাধারণ্যে প্রচরিত হয় সেজন্য রাজা গ্ৰন্থটির বেশ কিছু প্রতিলিপিও করিয়েছিলেন।

উল্লেখ করা যায় যে, তখন মুদ্রণযন্ত্র ছিল না, পাঠকদের চাহিদা মেটানোর একমাত্র অবলম্বন ছিল হাতে লেখা পুঁথি। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত আগরতলার ‘রবি’ পত্রিকার একটি প্রবন্ধে কালীপ্রসন্ন সেন লিখেছেন—’ত্রিপুরার মহারাজা গোবিন্দ মাণিক্য যখন বৃহন্নারদীয় পুরাণ বাংলাতে অনুবাদ করান, তার আগে ও পরে প্রায় দেড় শতাধিক বছরের মধ্যে রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত, বিবিধ পুরাণ ইত্যাদি বাংলাতে অনুবাদ করা হয়েছিল। এই যুগকে অনুবাদের যুগ বলা যেতে পারে।’
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৪: রাজা দশরথ, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা সকলেই কি এক একটি জীবনবোধের প্রতীক?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫২: হিতকারী মূর্খ বন্ধুর থেকে একজন পণ্ডিত শত্রু থাকা ভালো

কালীপ্রসন্ন বাবু জানান, বৃহন্নারদীয় পুরাণ গ্রন্থটি পরবর্তী সময়ে রাধাকিশোর মাণিক্যের আদেশে পন্ডিত চন্দ্রোদয় বিদ্যাবিনোদ মহাশয়ের দ্বারা সম্পাদিত ও প্রকাশিত হয়েছিল। শুধু ত্রিপুরা কেন, ডিমাছা রাজসভা, জয়ন্তিয়া, কোচবিহার রাজসভার উদ্যোগেও বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বাংলাতে অনুবাদ করা হয়েছিল। সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দ মাণিক্যের পৃষ্ঠপোষকতায় বৃহন্নারদীয় পুরাণের বঙ্গানুবাদ হয়েছিল। আবার অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ডিমাছা রাজমাতা চন্দ্রপ্রভার দেবীর আদেশে পণ্ডিত ভুবনেশ্বর বাচস্পতি বাংলাতে অনুবাদ করেছিলেন নারদীয় পুরাণ—যা ‘শ্রীনারদি রসামৃত’ হিসেবে পরিচিত।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৭: কথা কিছু কিছু

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪৭: ও বন্ধু তুমি শুনতে কি পাও?

গোবিন্দ মাণিক্যের রাজসভা পণ্ডিতের ‘বৃহন্নারদীয় পুরাণ’ রচনার প্রায় চার দশক পর কাছাড়ে ডিমাছা রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত একই পুরাণ গ্ৰন্থের বাংলা রূপটি কেমন ছিল তা দেখা যেতে পারে। ডিমাছা রাজসভার পণ্ডিত ভুবনেশ্বর বাচস্পতির রচনার কয়েকটি লাইন—
মিত্র সহ রাজা তুমি সুদাস তনয়।
পতিদান মাগি আমি করিআ বিনয়।।
স্বামী বিনা য়বলার জিবন বিফল।
বালা বৈধব্য রাজা জেন তুসানল।।
পিতামাতা নাহি জানি আর বন্ধুজন।
পতি মর গতি বন্ধু পতি সে জিবন।।


এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ত্রিপুরা, কাছাড় এবং কোচবিহার রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় নারদীয় পুরাণ বাংলাতে অনূদিত হয়েছিল। বিভিন্ন প্রান্তীয় রাজ্যের রাজা ও রাজপরিবার বৈষ্ণব ধর্ম প্রভাবিত ছিলেন বলেই সম্ভবত নারদীয় পুরাণ অনুবাদের রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। রাজাগণ চাইতেন বাংলাতে অনূদিত হোক পুরাণ। তা হলে প্রজাবৃন্দ তা শ্রবণ করবেন। পুণ্য হবে সকলের। মঙ্গল হবে রাজ্যের।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৩: মিলাডা—বিদেশিনীর হরফ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

দ্বিতীয় ধর্ম মাণিক্যের (১৭১৪-২৯ খ্রিস্টাব্দে) রাজত্বকালে ত্রিপুরার সমতল অঞ্চলে পাকাপাকি ভাবে মোগল অধিকার কায়েম হয়। সমতল এলাকার নাম হয় ‘রোশনাবাদ’, অর্থাৎ আলোর ভূমি। পূর্ব পুরুষদের মতো তিনিও ছিলেন ধর্মপ্রাণ এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। দ্বিতীয় ধর্ম মাণিক্য বাংলা ভাষায় মহাভারতের পদ্যানুবাদ করিয়েছিলেন। জগৎ মাণিক্যও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি বাংলাতে কাব্য অনুবাদ করিয়েছিলেন পদ্মপুরাণের অন্তর্গত ‘ক্রিয়াযোগসার’। গ্ৰন্থটি রচিত হয়েছিল ১৭২৬ খ্রিস্টাব্দে। জগৎ মাণিক্য এই পুঁথির নকল প্রজাদের ঘরে ঘরে রাখার আদেশ দিয়েছিলেন। কাব্যের ক’টি লাইন এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে—
পালিনু সকল পৃথ্বী সপ্তদীপ সমে।
সংহারিনু বৈরীপক্ষ আপন বিক্রমে।।
আপনার গোত্র যত করিনু পালন।
বহু দান করি তুষ্ট করিনু ব্রাহ্মণ। ।
তুষিলাম সর্ব্ব দেব করি যজ্ঞ দান।
সর্ব লোক তুষ্ট হৈয়া করিল বাখান।।
এখানে আমাতে হৈল জরা পরবেশ।
না হই রাজ্যে যোগ্য দুর্ব্বল বিশেষ।।

—চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content