শুক্রবার ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

জরুরি অবস্থা জারির পর দেশের শীর্ষস্থানীয় বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি প্রথম সারির বেশ ক’জন সাংবাদিককেও জেলে পুরে দেওয়া হয়েছিল। ইন্দিরা ও তাঁর অনুগামীদের বিরুদ্ধে যারা কলম ধরেছিলেন সেদিন তাদের অনিবার্য ঠিকানা ছিল জেল।

ত্রিপুরার বহুল প্রচারিত ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকার সম্পাদক ভূপেন দত্ত ভৌমিককে সেদিন ‘মিসা’ আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ত্রিপুরার কর্মচারী আন্দোলনের পক্ষে এই দৈনিক পত্রিকাটি সেদিন এক সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। এ ছাড়া ত্রিপুরার কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে সিপিএম-এর আন্দোলন, কংগ্রেসের অন্তর্দলীয় কোন্দল, সরকারের দুর্বলতা ইত্যাদি বিষয়ে ‘দৈনিক সংবাদ’ বলিষ্ঠ ভাবে নানা সংবাদ প্রকাশ করছিল। পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভে উঠে এসেছিল সুখময়বাবুর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার প্রতি নানা তীর্যক সমালোচনাও। জরুরি অবস্থার সুযোগে সুখময়বাবু এ সবের বদলা নিলেন সম্পাদক ভূপেনবাবুকে জেলে পুরে।
জরুরি অবস্থার সময়ে পত্রিকার খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে সেন্সরশিপ আরোপিত হয়েছিল। কী খবর বা কী সম্পাদকীয় প্রকাশিত হবে তা আগেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দেখিয়ে নিতে হতো। তারপর চালু হল ‘সেলফ সেন্সরশিপ’। নানা বিধিনিষেধের মধ্যে নিজেদের দায়িত্বেই খবর প্রকাশ করতে হবে। সারা দেশের সঙ্গে ত্রিপুরাতেও এসব ব্যবস্থা কঠোর ভাবে বলবৎ ছিল। শুধু সংবাদপত্র কেন, সে সময়ে সাহিত্য পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনের প্রকাশিতব্য লেখাও সেন্সর করিয়ে নিতে হয়েছিল। কঠোর বিধিনিষেধ অবশ্য পর্যায়ক্রমে কিছুটা শিথিল হয়েছিল। কিন্তু দৈনিক সংবাদ বরাবরই মুখ্যমন্ত্রী সুখময় সেনগুপ্তের কোপানলে ছিল।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১১: কলকাতায় ত্রিপুরার রাজনীতি

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৯: ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ওড়া, কেওড়া, চাক কেওড়া ও কৃপাল

দেশে জরুরি অবস্থা চলাকালীন সময়ে সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন বসেছিল গুয়াহাটিতে। বলা যায় এই অধিবেশনের মাধ্যমেই সেদিন কংগ্রেস রাজনীতিতে অভিষিক্ত হয়েছিলেন সঞ্জয় গান্ধী। সেই সময় আমি ত্রিপুরার ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকার তরুণ সাংবাদিক। গুয়াহাটি গিয়েছিলাম কংগ্রেস অধিবেশনের সংবাদ কভার করতে। গুয়াহাটি থেকে বাড়ি ফিরে আসার কিছুদিন পর পত্রিকার সম্পাদক ভূপেন দত্ত ভৌমিকের একটি চিঠি পেলাম।

ছবি: প্রতীকী।

অসমের নগাঁও জেল থেকে তিনি লিখেছেন,—”…তোমার নাম গুয়াহাটি অধিবেশনের সংবাদ পরিবেশনায় দেখতে পেয়েছি। এত বড় ব্যাপারের মধ্যে পাল্লা দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করার মধ্যে একটা বিশেষ মাদকতা আছে সন্দেহ নেই, তবে এখনতো কলমের মুখে ক্যাপ পরিয়ে রাখা হয়েছে। তবু নিজের চোখে সব দেখতে পেয়েছ এর দাম আগামী দিনের সংবাদ রচনায় অনেক। চোখ মন খোলা রেখে দেখলে ও বুঝতে চেষ্টা করলে তোমাদের চোখ দিয়েই রাজ্যবাসী ভারত দেখতে পাবে। স্তুতিবাচক বিশেষণ সমৃদ্ধ সংবাদ দিয়ে ব্যক্তিপূজার আসর সাজিয়ে কারা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের পূজা করছে-তারা সেটা কি উদ্দেশ্যে করছে সেটা কারও অজানা নয়।…গ্রাম ত্রিপুরার জীবনচিত্র রচনায় তোমার মধ্যে সেই খোলা চোখের আলো দেখেছিলাম বলেই তোমার লেখার ভক্ত ছিলাম আমি। সম্প্রতি তোমার লেখার মধ্যে গ্রাম কেন হারিয়ে যাচ্ছে? গ্রামের মানুষের কথা, প্রতিকারের সম্ভাব্য পথের কথা তাদের হয়ে তাদের ভাষায় বলো।…”
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৯: বাইনাচ-গানেরও কদর ছিল ঠাকুরবাড়িতে

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৩: মহাভারতে উল্লিখিত মিথ্যাশ্রয়ের প্রাসঙ্গিকতা কী আজও আছে?

জরুরি অবস্থার দিনগুলোতে প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতা এবং পত্র পত্রিকায় সরকারের সমালোচনা বন্ধ হয়ে গেলেও তাতে যে কংগ্রেসের মোটেই লাভ হয়নি, বরং বিপুল ক্ষতিই হয়েছিল তা বোঝা গিয়েছে পরবর্তী সময়ে নির্বাচনী ফলাফলের মাধ্যমে। জরুরি অবস্থার বিধিনিষেধ শিথিল করে ১৯৭৭ সালের মার্চ মাসে লোকসভার ভোট ঘোষণা করা হয়। জেলে আটক নেতাদেরও মুক্তিদান শুরু হয়। তখন রাজনৈতিক তৎপরতা বাড়তে থাকে। দেশের পরিস্থিতিও দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে। জরুরি অবস্থায় গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়ায় মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ জমা হয়েছিল তার বিস্ফোরণের অনিবার্য মাধ্যম ছিল নির্বাচন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৬: শ্রীমায়ের দুই ভ্রাতৃবধূর কথা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৩: তরু দত্ত— এক আনন্দ বিষাদের তরুলতা

ভোট ঘোষণার পর বিরোধীদের রাজনৈতিক তৎপরতা যেমন প্রচণ্ড ভাবে বেড়ে যায়, তেমনই শাসক কংগ্রেস দলেও অন্তর্দলীয় ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। কংগ্রেস দলের প্রবীণ নেতা জগজীবন রাম কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে এসে নতুন দল গঠন করেন। সেই দলের নাম হয় কংগ্রেস ফর ডেমোক্রেসি অর্থাৎ সিএফডি। ওড়িশার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নন্দিনী সতপতি-সহ আরও অনেক বিক্ষুব্ধ কংগ্রেস নেতা এই সিএফডি-তে যোগ দেন। দেশের প্রত্যন্ত রাজ্য ত্রিপুরাতেও তার প্রভাব পড়ে। ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ সিএফডি-তে যোগ দিয়ে পশ্চিম ত্রিপুরা লোকসভা আসনে নির্বাচনের প্রার্থী হন। কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ বিধায়করাও মুখ্যমন্ত্রী সুখময়বাবুকে জব্দ করার একটি সুযোগ খুঁজছিলেন তখন।

প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সুখময় সেনগুপ্ত। ত্রিপুরা।

জরুরি অবস্থার ফলশ্রুতিতে সারা দেশেই অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো মানুষের মনে মনে বয়ে চলেছিল ক্ষোভ। তখন সেটা প্রকাশের পথ ছিল রুদ্ধ। তাই যখনই সুযোগ এল তখন ভোটের বাক্সে ঘটল ক্ষোভের বিস্ফোরণ। কংগ্রেস শোচনীয় ভাবে পরাজিত হল নির্বাচনে। লোকসভা ভোটের ফলাফল রাজ্যে রাজ্যে রাজনীতির নতুন সমীকরণের সম্ভাবনাও উস্কে দিল। কেন্দ্রে জনতা পার্টি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হল। প্রধানমন্ত্রী হলেন মোরারজি দেশাই। কেন্দ্রের পালাবদলের প্রভাব পড়ে ত্রিপুরাতেও। কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ বিধায়করা এমনিতেই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। বিক্ষুব্ধ বিধায়করা শচীন্দ্রলাল সিংহের সিএফডি-তে যোগ দিলে সুখময়বাবুর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। মুখ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। ত্রিপুরায় এক নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা ঘটল।—চলবে।
ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content