শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


সুরের যাদুকর পঞ্চম।

শেষ হয় আশির দশক। আসে ১৯৯০ সাল। কিন্তু কোথায় সেই ব্যস্ততা? পঞ্চমের মিউজিক রুমে কোথায় সেই জনসমাগম? কোথায় গেলেন সেই প্রযোজক এবং নির্দেশকেরা, যাঁরা পঞ্চমের ডেট পাওয়ার জন্য একসময় মুখিয়ে থাকতেন? তাহলে কি মুখ ফিরিয়ে নিল বলিউড? বিলুপ্ত হয়ে গেল সেই জনপ্রিয়তা? শ্রোতাকুল কি পেয়ে গেল পঞ্চমের বিকল্প? প্রশ্নগুলি ক্রমাগত তাড়া করতে থাকে পঞ্চমকে। সান্তনার কথা এই যে, এত কিছুর পরেও ডাক আসতে থাকে কিছু কিছু নির্দেশকের কাছ থেকে। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন শক্তি সামন্ত। ‘দুশমন’ ছবিতে কাজের জন্য ডাক পান পঞ্চম। লেখক ইনদিবরের কথায় সুর দিতে হবে। রাজি হয়ে যান পঞ্চম।

এই ছবির জন্য কিশোরের অবর্তমানে তাঁর পুত্র অমিতকেই গায়ক হিসেবে বেছে নেন তিনি। সঙ্গে নেন আশা ভোঁসলে এবং সাধনা সরগমকে। ভক্তিগীতির ধাঁচে সুর করেন ‘তুনে জব জীবন দিয়া’ গানটিতে। মেলোডি যেন ঝরে পড়ে। তবলার সঙ্গত, ভায়োলিন এবং বাঁশির মূর্ছনা বাকরুদ্ধ করে রাখে শ্রোতাদের। সুরকার আবার প্রমাণ করলেন, তিনি ফুরিয়ে যাননি। তার সংগীতের কলস তখনও কানায় কানায় পরিপূর্ণ। অমিত কুমার গাইলেনও মনপ্রাণ দিয়ে। এই গানটিতে অব্লিগেটর প্রয়োগ গানটিকে এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিল। গানটি একবার শুনে দেখতে পারেন।
এই ছবির ‘ইয়ে ঝিলমিল কাতিল রাতে’ গানটি আবার তেমন ভাবে সাড়া ফেলতে সক্ষম হল না। আশা ভোঁসলে এবং অমিত কুমার দু’জনেই যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন। তা সত্ত্বেও গানটি সেই ভাবে জনপ্রিয়তা পেল না। ফলত, একটু হলেও আঘাত পেয়েছিলেন পঞ্চম। তবুও তুলনামূলকভাবে জনপ্রিয়তা পেল এই ছবির ‘হঠো পে তুমনে পেয়ার লিখা হ্যায়’ গানটি। পঞ্চম ঘরানার সুরে নিজেদের কণ্ঠের প্রতি সুবিচার করলেন অমিত কুমার এবং সাধনা সরগম দু’জনেই।

যদি ধরা যায় ‘জিনে দো’ ছবির লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘মেরে রাজা তু সোজা’ গানটি। একটিবার শুনলেই বুঝতে পারবেন, গানটি সুরকার পঞ্চম ব্যতীত আর কেউ হতেই পারেন না। গানটির আনাচে-কানাচে লুকিয়ে আছে পঞ্চমের সেই নিজস্ব ঘরানার জাদু। আর হবে নাই বা কেন? গায়িকা যে লতা স্বয়ং! গানটি এক কথায় অনবদ্য।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৫৭: আশির দশকের শেষ পর্বে পঞ্চমকে অনেকেই কাজ দিতে চাননি

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৩: সুন্দরবনের পশ্চিমাংশে ম্যানগ্রোভ

একই সালে কিছু বাংলা ছবিতেও কাজ করেন পঞ্চম। তরুণ মজুমদার নির্দেশিত ‘আপন আমার আপন’ ছবিতে ডাক আশে পঞ্চমের। সুর করেন বেশ কিছু গানের। তার মধ্যে একটি হল আশার গাওয়া ‘গুন গুন গুন মন ভ্রমরা’ গানটি। পুরো গানটি জুড়ে মেলোডি যেন রাজত্ব করে গিয়েছে। সুরের কাঠামো এবং বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার আমাদের সেই পুরনো পঞ্চমকে মনে করিয়ে দেয়। বলাই বাহুল্য, আশার কণ্ঠ সেই আবার অনবদ্য। সঙ্গে রয়েছে কোরাসের ম্যাজিক। একই কথা প্রযোজ্য এই ছবির আশার গাওয়া ‘মন বলছে কেউ আসবে’ গানটির ক্ষেত্রে। আগের গানটির মতো এই গানটিতেও কোরাসের মূর্ছনা কানে ধরা দেয়।

‘লড়াই’ ছবির লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘আপন যারা তারাই আমার’ গানটির মধ্য দিয়ে নায়িকার এক নিদারুণ বেদনা প্রতিফলিত হয়েছে। সুরের প্রবাহ এবং ইনস্ট্রুমেন্টেশন শুনলেই একটি সত্য খুব সহজেই অনুধাবন করা যায়। সেটি হল পঞ্চম নিজের খানদানকে কখনো ভলেননি। সেই কারণেই তো এই গানটির জন্য লতা মঙ্গেশকরকে বেছে নেওয়া!
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬২: ধনময়ী জ্ঞানময়ী-র পাশে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫১: সেদিন ‘পথে হল দেরি’ ছবির শুটিংয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটেছিল উত্তম-সুচিত্রার মধ্যে

‘এখানে আমার স্বর্গ’ ছবির গানগুলিতেও সুর করেন পঞ্চম। গীতিকার হলেন স্বপন চক্রবর্তী। আশার গাওয়া ‘বাসর জাগার পালা’ গানটিতে মন প্রাণ ঢেলে সুরারোপ করেন তিনি। যেমন মিলেডি তেমনই রিদম। আর বাকি কাজটি করে দিয়েছেন আশা স্বয়ং। যে কথাটি আগেই উল্লেখ করেছি, এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে পঞ্চমের কোথাও হয়তো মনে হতো যে তার সুর রচনার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও পরিবর্তন নিয়ে আসা প্রয়োজন। শুধু সুরের ক্ষেত্রেই নয়। বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রেও।

এই সময়গুলিতে তাঁকে বঙ্গ অথবা কঙ্গের পরিবর্তে অক্টোপ্যাড ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে বেশিরভাগ গানে। কারণ সময় তখন পরিবর্তনশীল। বদলে যাচ্ছে সমাজ। এবং তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে চলেছে শ্রোতাদের পছন্দ এবং চাহিদা। সনাতন সংগীতের সঙ্গে ‘ডিসকো’ জমানার এক অলিখিত এবং অঘোষিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয়। বদল ঘটছে গানের ভাষারও। সে যেন এক অদ্ভুত সময়।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা

শুধু তো ১৯৯০ সালেই নয়। পঞ্চম বাংলা বাণিজ্যিক ছবির গানে সুর করছেন সেই সত্তরের দশক থেকে। কিন্তু তিনি বেশ টের পাচ্ছিলেন যে বছর কুড়ির মধ্যে সবকিছু কেমন যেন বদলে গিয়েছে। শুধু বম্বেতে নয়। বাংলাতেও। সাংস্কৃতিক এই পরিবর্তন যেন আক্ষরিক অর্থেই সার্বিক। নবাগত নির্দেশক, প্রযোজক, গীতিকার এবং সুরকারদের প্রবেশ ঘটছে একে একে। তাঁরা আসছেন নতুন নতুন ভাবনা এবং পরিকল্পনা নিয়ে। যেগুলি কিনা আক্ষরিক অর্থেই সমসাময়িক।

স্বাভাবিক কারণেই নবপ্রজন্মের কাছে সেগুলি তুলনামূলকভাবে বেশি করে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। সেই কারণেই পূর্ব এবং নব। এই দুই প্রজন্মকেই কীভাবে সুরের মায়াজালের একক সুতোয় বেঁধে ফেলা যায় সেটিই হয়তো ছিল সেই সময়ে পঞ্চমের দিবারাত্রীর ভাবনা। সুগভীর জ্ঞান এবং অত্যাবধি আসা গগনচুম্বি সাফল্য এই দুইই ছিল তখন পঞ্চমের প্রেরণা। এগিয়ে চলার প্রাণশক্তি।—চলবে।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content