শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


সুরের যাদুকর পঞ্চম।

কিশোর কুমারের অকালপ্রয়াণ দিয়ে যেন পঞ্চমের জীবনের আরও একটি অধ্যায়ের অবসান ঘটলো। ১৯৭৫ সালে তিনি বাবা শচিন দেব বর্মণকে হারিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেই সময় কিশোর তাঁর পাশে ছিলেন। বলা যেতে পারে, একটি ভরসার জায়গা। এমনিতেই শচীনকর্তাকে কিশোর অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। একদম নিজের বাবার মতো দেখতেন তাঁকে। সুতরাং শচীন দেবের ইহলোক ত্যাগ করার পর তিনি পঞ্চমকে যথেষ্টই মনোবল যুগিয়েছেন, মানসিকভাবে পাশে থেকেছেন। সেই কিশোর আর নেই। খুব স্বাভাবিকভাবেই, পঞ্চম ভেঙে পড়েছিলেন ভিতরে ভিতরে। মাঝে মাঝেই মনে পড়ত কিশোরের কথা। তাঁর সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলি বারবার উঠে আসতো স্মৃতির পাতা থেকে। ১৯৮৭ সালের শেষ সময়গুলি এই ভাবেই কেটে যায় তাঁর।

কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। সে তো চলতে থাকে তার নিজের পথে, নিজের গতিতে। সেই নিয়ম মেনে পঞ্চমও ধীরে ধীরে ব্যস্ত হয়ে পড়তে থাকেন তাঁর কর্মযজ্ঞ নিয়ে। আসে নতুন বছর, অর্থাৎ ১৯৮৮ সাল। নতুন নতুন ছবিতে ডাক আসতে থাকে।
মুক্তি পায় ‘না মুমকিন’ ছবিটি। এই ছবিতে কিশোর কুমারের কণ্ঠ আবারও আমরা শুনতে পাই। তবে এই রেকর্ডিং তাঁর প্রয়াণের আগেই সম্পন্ন করা হয়ে গিয়েছিল। তাঁর কণ্ঠে ‘আ্যয় জিন্দেগি হুই কাঁহা ভুল’ গানটি শুনলে দু’চোখ যেনো একটু হলেও শিক্ত হয়ে ওঠে। আনজানের লেখা এই গানটি গাইতে গিয়ে কিশোর হয়তো বুঝেছিলেন যে, তাঁর জীবনের সূর্য পৌঁছে গিয়েছে পশ্চিম আকাশে। পুরো গানটিতে কিশোরকে খুব উদাসীন বলে মনে হয়েছে। ঠিক জানা নেই, গানের কথাগুলির মধ্যে তিনি কোথাও হয়তো নিজের জীবনের সঙ্গে কোনও সাদৃশ্য খুজে পেয়েছিলেন কিনা।

দৃশ্যের চাহিদা অনুযায়ী গেয়েছেন ঠিকই, তবু এই গানটিতে তিনি যেন তাঁর নিজের কথাই বলেছেন। আর পঞ্চমের সুর এবং সার্বিক অ্যারেঞ্জমেন্টটিও লক্ষ্য করার মতো ব্যাপার। যে অংশগুলিতে কিশোর গাইছেন, সেই অংশগুলিতে যথসামান্য ইনস্ট্রুমেন্ট ব্যবহার করেছেন পঞ্চম। হয়তো কিশোরকে একটু বেশি জায়গা দিতে চেয়েছেন তিনি। অন্তিম অংশে যখন কিশোর গাইছেন ‘তেরি কসম, দুনিয়া মে হাম, আয়েঙ্গে না দোবারা’, তখন কেমন একটি অদ্ভুত অনুভুতির সঞ্চার হয়। তখন মনে হয় কিশোর হয়তো বুঝেছিলেন যে, তাঁর সূর্য এ বার সত্যিই অস্তমিত। মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৫৬: আচমকা ‘বন্ধু’ কিশোরের প্রয়াণে ভেঙে পড়েছিলেন পঞ্চম

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪২: সুন্দরবনের বাঘের ভবিতব্য

‘রামা ও রামা’ ছবিতে অমিত কুমারের সঙ্গে জয়শ্রী শিবরামকে গাইয়েছিলেন আরডি। গানটি ছিল ‘রামা ও রামা, তুনে ইয়ে ক্যায়সি দুনিয়া বানাই’। গানটিতে যেমন রয়েছে মেলোডি, তেমনই আছে সম্পূর্ণ নতুন রিদমের ছোঁয়া। নতুন বলছি কারণ ছন্দটি পঞ্চমের নিরিখে নতুন। এইরকম রিদমের প্রয়োগ পঞ্চমের ক্ষেত্রে পূর্বে খুব একটিও শোনা যায়নি। কারণ একটাই। নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করা। সেটিই ছিল তাঁর সেই সময়ের মরিয়া প্রচেষ্টা।

১৯৮৯ সালে মুক্তি পায় বিধু বিনোদ চোপড়া নির্দেশিত ছবি ‘পারিন্দা’। ‘তুম সে মিলকে, আইসা লাগা তুমসে মিলকে’ গানটি যারপরনাই জনপ্রিয় হয়। আশা ভোঁসলে এবং সুরেশ ওয়াদকর অসাধারণ ভাবে উপস্থাপিত করেন গানটি। নবপ্রজন্ম লুফে নেয় এই গানের মেলোডি।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৭: তিনটি মেয়ের তিনটি কলম!

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৫: ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা

এই ছবির ‘পেয়ার কে মোড় পে ছড়োগে’ গানটিতে কিন্তু আবার পাওয়া যায় পঞ্চম ঘরানার ছোঁয়া। ‘মেলোডি ম্যাজিক’ যেনো পৌঁছে গিয়েছে তুঙ্গে। তবলার ছন্দকে আশ্রয় করে এগিয়ে গিয়েছে গানটি। আশার অনবদ্য উপস্থাপনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মন মাতানো হুইসলিং এবং সমুদ্রের জলস্রোতের শব্দ। জায়গা বিশেষে বাস গিটার এবং ট্রাম্পেট এক অবর্ণনীয় আবেগের সঞ্চার করে। কি অসম্ভব গভীরতা!

‘বহুরানি’ ছবির ‘দুনিয়া কি নজরও সে ছুপকে মিলে’ গানটি শুনেছেন? কি মিষ্টি মেলোডি! শুধু তাই নয়, এই গানে পঞ্চম ফিরে গিয়েছেন তাঁর সেই পুরোনো জমানায়। আলাদা করে নবপ্রজন্মের কথা ভাবতে হয়নি তাঁকে। কারণ তিনি জানতেন, এই গানের মেলোডি এবং রিদম তাদের আকর্ষণ করবেই। আর আশা এবং শৈলেন্দ্র সিং তো আছেনই। বাকি কাজটি তাঁরাই করে দিয়েছেন।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরার রাজ পরিবারে হোলি উৎসব

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৬: রামায়ণে রামচন্দ্রের যাত্রাপথ সুগম হওয়ার কারণেই কি সীতার উপস্থিতি?

এত সাফল্যের পরও বিগত বছর গুলির তুলনায় ছবির সংখ্যা যেন কিছুটা কমে আসছিল। অর্থাৎ, আশির দশকের প্রথম দিকের তুলনায় শেষ দিকে কিছুটা হলেও উপেক্ষিত থাকছিলেন পঞ্চম। সেই সময় নতুন নতুন প্রযোজক এবং নির্দেশকদের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে বলিউডে। সেই সঙ্গে, মিউজিকের ট্রেন্ডও বদলাতে শুরু করেছে। এ সবের মধ্যেও পঞ্চম ডাক পাচ্ছিলেন ঠিকই। কিন্তু সংখ্যায় অনেক কম। এই সময় থেকেই পঞ্চমের কপালে একটু হলেও চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করেছিল। তাঁর মতো একজন সফল মানুষ তো দ্বারে দ্বারে ঘুরবেন না কাজের জন্য। তাই কিছুটা নিজের মতো করেই দিন কাটাতেন তিনি। সুর তৈরি করে রাখতেন। তাঁর মিউজিক রুমে নিজের দলের সঙ্গে বসে সেরে নিতেন খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনা। দিনগুলি কেটে যাচ্ছিল এই ভাবেই।—চলবে।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content