শুক্রবার ২৯ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

বোধিসত্ত্ব সেবার এক গৃহস্থের ঘরে জন্ম নিয়েছেন। যথাকালে প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাঁর বিবাহ হল সুজাতার সঙ্গে। না, এই সুজাতা তাঁকে পায়সভক্ষণ করাননি। কিন্তু তিনি সুজাতা, সুকুলোদ্ভবা। রূপ-লাবণ্যে ও চরিত্রবলে তিনি শ্বশুরালয়ে সকলের মন জয় করেছিলেন। বোধিসত্ত্ব তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে আনন্দে কালযাপন করছিলেন। একদিন সুজাতা পিতৃগৃহে যাওয়ার মনোবাসনা করলেন। বোধিসত্ত্ব পাথেয় আহার্যাদি নিয়ে গোশকটে সস্ত্রীক যাত্রা করলেন। পথে তাঁরা বিশ্রাম নিলেন। গরুগুলিকে মুক্ত করে বিশ্রাম দিলেন। আবার চললেন।
সেদিন রাজা হাতিতে চড়ে নগরভ্রমণে বেরিয়েছেন। সুজাতাকে দেখে তাঁর কামার্ত হৃদয়ে দুষ্প্রবৃত্তি জেগে উঠল। তিনি জানতে পারলেন, গোশকটের চালকটিই তার স্বামী। তিনি ভৃত্যকে সংগোপনে মাথার চূড়ামণিটি দিয়ে কর্তব্য বুঝিয়ে দিলেন। ভৃত্যটি অতি সাবধানতায় গোশকটের একস্থানে মণিটি রেগে দিয়ে এল। এরপর রাজা চূড়ামণি হারিয়ে গিয়েছে এমন ভাণ করে হইচই বাঁধিয়ে দিলেন। পাত্রমিত্র, অমাত্য-পার্ষদ, মন্ত্রী-সান্ত্রী ততোধিক হট্টগোল কলরব করে পথঘাট আটকে তদন্ত-তল্লাশ শুরু করল। সেই ভৃত্য বোধিসত্ত্বের শকটের কাছে গিয়ে তাদের পথরোধ করল, গাড়িটিতে তল্লাশির ছলে যথাস্থান থেকে মণিটি বের করে ধৃতকে সদলে মারতে মারতে রাজার কাছে নিয়ে এল। তারপর অতি তৎপরতায় তার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল। জল্লাদরা তাকে হত্যা করার জন্য নগরের দক্ষিণে বধস্থানে আনলো।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১১: ক্যাথেরিন ম্যান্সফিল্ড ও মিডলটন মারে: এক আশ্চর্য বিবাহিত সম্পর্ক

অভিজ্ঞান-শকুন্তলের নাট্যকার কালিদাস/১

সুজাতা স্বামীর এই দুর্ভাগ্যের জন্য নিজেকেই দায়ী করে শকট ত্যাগ করে কাঁদতে কাঁদতে স্বামীর অনুগমন করলেন, মনে মনে হাহাকার করলেন এই ভেবে যে, চরিত্রবান বিপন্ন মানুষের দুঃখের কারণ যে দুরাচারীর দল, তাদের বিনাশে কি কোনও দৈবশক্তি জেগে ওঠে না?

সুজাতার বিলাপে দেবরাজ ইন্দ্রের আসন তপ্ত হল। ইন্দ্র শঙ্কিত হয়ে অনুসন্ধানে জানলেন, দুঃশীল এক রাজার দুরাচারে শীলসম্পন্না সুজাতা ক্লিষ্ট হয়েছে। ইন্দ্র অবতীর্ণ হয়ে ইন্দ্রজালের আশ্রয় নিলেন। তখন ধর্মগণ্ডিকা বা হাড়িকাঠে শীলবান মানুষটি মৃত্যুমুখী, ইন্দ্রের মায়ায় সেস্থানে গজপৃষ্ঠারূঢ় রাজা স্থান নিল। বোধিসত্ত্ব সর্বালঙ্কারভূষিত হয়ে রাজবেশে গজারূঢ় হলেন সকলের অলক্ষ্যে। কেউ জানলো না, জল্লাদের উদ্যত খড়্গ রাজার শিরশ্ছেদ করল নিমেষে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০০: ঠাকুরবাড়ির রূপবান, ঠাকুরবাড়ির গুণবান

দশভুজা, দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৪: আনন্দী—এক লড়াইয়ের নাম

তারপর?
তারপর আর কী! সকলে জানলো দুঃশীল রাজা হত হয়েছে। জানলো ইন্দ্র স্বয়ং ধার্মিক রাজাকে অভিষিক্ত করেছেন। রাজার পাপে রাজ্য নাশ। রাজা অধার্মিক হলে রাজ্য বিপন্ন হয়। দুর্ভিক্ষ, মহামারী, অনাবৃষ্টি কিংবা দস্যুর উপদ্রবে অশান্ত হয় জীবন।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৩৮: পুত্র বীরেন্দ্রর বিয়েতে রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানান মহারাজ রাধাকিশোর

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৬: ঘোড়ার ডিম

দুষ্যন্ত ভেবেছিলেন, আশঙ্কসে যদগ্নিং তদিদং স্পর্শক্ষমং রত্নম্। শকুন্তলা অগ্নি নয়, রত্নস্বরূপা। রত্ন কখনও কখনও অগ্নি হয়ে দেখা দেয় বটে। রাজার চূড়ামণি তাহলে অগ্নি হয়েই দেখা দিল বুঝি তার জীবনে, আর শীল বা চরিত্র-ই মানুষের গুণরাজির শিরোমণি হয়ে ওঠে। তাই সুজাতা কিংবা তার স্বামী মানুষের মাঝে ধর্মে, শীলে, চরিত্রের দার্ঢ্যে হয়ে ওঠে রত্নতুল্য জ্যোতির্ময়।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৯: মাথার কান

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭১: মা সারদার নলিনীর মানভঞ্জন

জীবনের চতুর্বর্গে ধর্মের থেকে মহত্তর আর কিছু নেই। ধর্ম রক্ষিত হলে সেই ধর্মপথে অর্থ, কামের পরিপালন, এভাবেই ক্রমে মোক্ষের পথ উন্মুক্ত হয়। অথচ ধর্ম নষ্ট হলে অনর্থ অকাম জীবনকে ধ্বস্ত করে। সুজাতার ধর্মাসক্তি কিংবা দুঃশীল রাজার পরিণতি সেই কথাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। বোধিসত্ত্বের জন্মে জন্মে শুদ্ধতর হওয়ার যাত্রাপথে এই কাহিনি সুজাতার মতো মানুষদের প্রতিষ্ঠা দেয়। এরা থাকে বলেই, পৃথিবী সুন্দর হয়।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।।

Skip to content