ছবি: প্রতীকী।
সেবার বোধিসত্ত্ব স্বর্গের ইন্দ্র হয়েছেন। বারাণসীতে তখন রাজত্ব করছেন ব্রহ্মদত্ত। সেই সময় এই রাজা দুঃশীল, মহাদুষ্ট ছিলেন। তিনি অশক্ত পশুপাখিকে কষ্ট দিয়ে নিষ্ঠুর আমোদ পেতেন। জীর্ণ হস্তী কিংবা জীর্ণ শকট দেখলে তাকে উত্পাটিত করতেন। রাজপথে বৃদ্ধ মানুষকে দেখলেও তিনি শারীরিক কষ্ট দিয়ে উত্পীড়ন করতেন, সংবাদ পেলে গৃহস্থের গৃহ থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ডেকে আনিয়ে নানাভাবে বিড়ম্বিত করতেন।
অবাক লাগছে? মনে হচ্ছে কি যে রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান এমন হলেই তো ভালো হতো? কিন্তু মান মানে কচু হলে?
অবাক লাগছে? মনে হচ্ছে কি যে রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান এমন হলেই তো ভালো হতো? কিন্তু মান মানে কচু হলে?
ধর্মশাস্ত্রে অনেক বিধিনিষেধ আর পরামর্শ রাজার জন্য বরাদ্দ হয়েছে বটে, এমনকী রাজা বিপত্গামী হলে তাঁর অমাত্যগণ তাঁকে নানা উপায়ে পথে আনার চেষ্টা করবেন এমন পরামর্শ আছে অর্থশাস্ত্রে। কিন্তু পাত্র-মিত্র-অমাত্যরাও যদি তথৈবচ হয়! তাঁরাও উত্পীড়ক, তাঁরাও প্রবঞ্চক, শঠ, ধূর্ত অমানুষ।
সে যাই হোক, দেশের লোক রাজার এমন আচরণে লজ্জিত হয়ে পিতা মাতাকে রাজ্যের বাইরে পাঠিয়ে দিতে লাগল। এতে সমস্যা হল বিস্তর। ধাক্কা গিয়ে লাগল সোজা স্বর্গে। কী করে?
পিতা মাতার সেবা শুশ্রূষা না করে দেশের লোকজন অধোগামী হল। নরকে লোক বাড়তে লাগল, স্বর্গে নতুন দেবতা কমে গেল। এখন উপায়? ইন্দ্র তদন্ত করে দেখলেন ও জানলেন ব্যাপারখানা কী, তারপর উচিত শিক্ষা দিতে পৃথিবীতে এলেন।
সে যাই হোক, দেশের লোক রাজার এমন আচরণে লজ্জিত হয়ে পিতা মাতাকে রাজ্যের বাইরে পাঠিয়ে দিতে লাগল। এতে সমস্যা হল বিস্তর। ধাক্কা গিয়ে লাগল সোজা স্বর্গে। কী করে?
পিতা মাতার সেবা শুশ্রূষা না করে দেশের লোকজন অধোগামী হল। নরকে লোক বাড়তে লাগল, স্বর্গে নতুন দেবতা কমে গেল। এখন উপায়? ইন্দ্র তদন্ত করে দেখলেন ও জানলেন ব্যাপারখানা কী, তারপর উচিত শিক্ষা দিতে পৃথিবীতে এলেন।
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৫৭: বাথটাব/৯
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০১: খামখেয়ালির গিরীন্দ্রনাথ
সেদিন আবার রাজা শোভাযাত্রা করে নগরে ঘুরছেন। চোখে পড়ল এক শতছিন্ন বস্ত্রধারী এক জীর্ণ বৃদ্ধ ততোধিক জীর্ণ বলদের শকট নিয়ে চলেছে কোথায় যেন। গাড়িতে ঘোলের হাঁড়ি। যেমন দেখা তেমন কাজ। রাজার আদেশে পাত্র-মিত্র, সেপাই-ভৃত্য ছুটে শকট অপসারণ করতে গিয়ে কাউকেই দেখতে পেল না। পাবেও বা কী করে, ইন্দ্র তাঁরা মায়া অবলম্বন করে কেবল রাজাকেই তো দর্শন দিয়েছেন। অন্যরা দেখতে না পেলেও সেই গাড়ি গড়গড় করে এগিয়ে এল, সেই বৃদ্ধ রাজার মাথায় পরপর দুই হাঁড়ি ভাঙলেন। ঘোলের স্রোতে রাজা ভেসে গেলেন যেন। লোকে ছি ছি করল, হাসলো। রাজা নিতান্ত উত্পীড়িত, লজ্জিত, ঘৃণিত হলেন।
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯১: নুনিয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৫: ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা এবং চলচ্চিত্র
মনে পড়ে, রাজা শুদ্ধোদনের পুত্র বারংবার প্রেরিত হচ্ছেন উপবনে, আর পথে দেখছেন জরা, ব্যাধি, মৃত্যুর বিভীষিকা। জন্মমরণক্লিষ্ট অসার সংসারে আসা যাওয়ার মাঝে দুঃখ আর অবশ্যম্ভাবী ব্যাধি-জরার দুর্লঙ্ঘ্য বন্ধন ছিন্ন করে তারপর জন্ম নিল বোধি, সিদ্ধার্থ হলেন বুদ্ধ। জরার কালপ্রকোপ দেহকে গ্রাস করে, তবে এই দেহ সর্বোত্তম নয়, তা রোগগ্রস্ত হয় পার্থিব নিয়মেই। তবে এই দেহ কিংবা সম্পদ অথবা ব্যাধি কিংবা জরা, মৃত্যুই কি অমোঘ? এই ব্যাকুলতা থেকেই একদিন কি জেগে উঠেছিল প্রকৃত পুরুষকার? জেগেছিল অহিংসার আর্তি? তবে সে অনেক অনেক পরে, এই কাহিনির শেষে কী হল?
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’
যা হয় আর কী! শকট বেবাক অদৃশ্য হল। ইন্দ্র বজ্র ধারণ করে রাজাকে সচেতন করে দিলেন। শুভ কর্মে হানি ঘটায় স্বর্গ জনহীন, মৃত্যুর পর মানুষ অধোগামী হচ্ছে। মাতা পিতার সেবা না করে মানুষ দুর্গত হচ্ছে, এই রাজা কি কখনও বৃদ্ধ জরাগ্রস্ত হবেন না, এমন গর্হিত আচরণ ও হিংসা উত্পীড়ন করে তিনি যে উত্কট সুখ লাভ করছেন তা ভবিষ্যতে ঘটলে বজ্রের আঘাতে তাঁর মাথা বিদীর্ণ হবে। বলাবাহুল্য, রাজার চৈতন্য হল। তিনি ইন্দ্রের কাছে মাতা পিতা বয়োবৃদ্ধগণের মাহাত্ম্য শুনে এমন অশিষ্ট আচরণ থেকে বিরত হলেন।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৫: টাকা না থাকলে নির্ধন ব্যক্তির বন্ধুও শত্রু হয়
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৪: শ্রীমার গৃহী ভক্তদের সন্ন্যাসদীক্ষা
আজ থেকে বহুযুগ আগের এই জাতকের কাহিনীতে আধুনিক মনোবিকলনের চিত্রণ দেখে স্তম্ভিত হতে হয়। জীবের প্রতি সমবেদনা, তার সত্তাকে, প্রাণকে সম্মান দিতে পারার মতো মনোভাব অর্জনেই মনুষ্যত্বের উদ্বোধন ঘটে। আজকের দুনিয়া আর দুনিয়াদারির জগতে, ধরি ধরি করে প্রাণপণে ছুটে চলার বিশ্বে, ধরাকে সরা ভাবার আত্মকেন্দ্রিক সংকীর্ণতা আর বিপুল অহং-এর পৃথিবীতে এই প্রাচীন গল্পটাও থেকে গেছে, মানুষের উত্তরণের চিরকালীন আশা বুকে নিয়ে।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।