সোমবার ২ জুন, ২০২৫


সত্যজিৎ রায়।

ততক্ষণে দর্শকরা হাল্লার পুতুল রাজা আর শয়তান মন্ত্রী, দেশ-বিদেশের সমাগত কেষ্ট-বিষ্টু গণ্যি-মান্যিদের নাচ দেখেছেন। প্রথমে তালে তালে, পরে নাচার হয়েও নাচতে হচ্ছে। সঙ্গে নাচছে অক্লান্ত জল্লাদ, নাচ থামলেই গর্দান যাবে। কাল যুদ্ধ।

রাত ঘনিয়েছে। নাচ চলছে। সকলে বিবশ অবশ শরীরে নাচছে। রাজার হুকুম বলে কথা! কাল যুদ্ধ। এমন সময় কারাগার থেকে পাগল হাওয়ার মতো ছুটে আসে গান। এক যে ছিল দুঃখী রাজা। তার দুঃখ কেন? কেমন করেই বা কাটবে সে দুঃখ?

কাজ হয়, ওষুধে যেমন বিষ মরে, তেমন করেই রাজার মুখে জোর করে লাগিয়ে রাখা অত্যাচারের মুখোশটা খসে যায় নিমেষে, রাজা ছুটি চায়। মন্ত্রী রাজাকে ছুটি দেওয়ার লোভ দেখায়, কিন্তু দেয় না। ছুটে যায় কারাগারে, চোখ পাকিয়ে বন্দি গুপী ও বাঘাকে ধমকায়, জোর করে খেতে বাধ্য করে অখাদ্যটুকু। সে সব তো সকলেই জানেন।
কী আশ্চর্য, এমন এক দেশ যেখানে রাজা চলে মন্ত্রীর ইঙ্গিতে, গণতান্ত্রিক দেশে অবশ্য মন্ত্রীই সর্বেসর্বা হন বটে। সে দেশে লোকের মুখে কথা নেই, পেটে খাবার নেই, রাজার মনে সুখ নেই।
সত্যজিৎ রায়ের লেন্সের ওপারে সেই ক্ষুধার্ত হাল্লা যুদ্ধে বাজিমাৎ করতে চায়।

অথচ আমরা দেখতে চাইছি ওই খাদ্যের আকুতিটুকুকেই। বেদের মন্ত্রে ঋষিরা অন্নকে যে উচ্চতায় স্থাপন করেছেন, সেখানে তা দীপ্ত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা হয়ে ভাস্বর, বেদব্যাখ্যাতা বলবেন মন্ত্রে ছত্রে ছত্রে ক্ষুধার্ত মানুষের আকুতিও যেন শুনতে পাওয়া যায়। পায়সটুকু গ্রহণ করেই সিদ্ধার্থের বোধি জাগে, পৃথিবী অন্নচিন্তা চমত্কারা বলেই জেনেছে, না হলে পূর্ণিমার চাঁদের আলোও ক্ষীণ লাগে, তার সঙ্গে ঝলসানো রুটির খুব একটা দূরত্ব থাকে না বোধহয়।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯৯: সারদা মায়ের রোগ নিরাময়ের প্রচেষ্টা

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১৬: বিপদে মোরে রক্ষা করো

বাঘা রেগে রেগে বলেছিল, খেতে দেবে না, না খাইয়ে মেরে দিয়ে গর্দান কেটে নেবে। কী ভয়ানক শয়তান! অথচ খাবার এল বেশ পরে, সে নাকি ইঁদুরের খাদ্য, তাই জোর করে গিলিয়ে দিল তাদের, গান গাওয়ার শাস্তি। এরপর রাত আরো গভীর হল বুঝি।

কারাগারের লৌহকপাটের বাইরে বসে রক্ষী ঘুমে ঢুলছিল। শীর্ণ পাকানো চেহারা, মাথায় ভারি উষ্ণীষ, নাকের নিচে ঝোলা গোঁফ, দাড়িও আছে বোধহয়, তালপাতার সেপাইয়ের মতো হাবভাব, বোবা মুখে দুটি দুর্ভেদ্য চোখ কাঁচের গুলির মতো ঘুরছে, কখনও স্তিমিত হয়ে, আবারও জেগে উঠছে। এই একটু আগেই মন্ত্রীর কথায় কথায় খোনা গলার বোবা আওয়াজ তুলে অযাচিত সমর্থন জোগাচ্ছিল, এখন সে ঘুম ভেঙে দেখল এক বিচিত্র দৃশ্য।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১৭: রবীন্দ্রনাথ ব্যারিস্টার হতে চেয়েছিলেন

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫৮: হেলিকপ্টারে সওয়ার হয়ে চূড়ার কাছাকাছি গিয়ে পাহাড় দেখার রোমাঞ্চটাই আলাদা

ছোট্ট রোল, ভূমিকায় নৃপতি চট্টোপাধ্যায়।
সে দেখল, জেলের মধ্যে বসে থাকা হাঘরে হতভাগা বন্দীদুটো এখন সোনার থালায় রাজভোগ খাচ্ছে। ভূতের রাজার বরে পাওয়া স্বেচ্ছাভোজনের লাইসেন্স। তার চোখ জ্বলে উঠল, লোক দুটো নিয়ম ভেঙেছে বলে নয়, খিদেয়। টেনিদার যেমন খিদে পেত, নিমেষে সাবড়ে দিতো ডজন ডজন, এ খিদে তেমন নয়, এ খিদে লেলিহান আগুনের মতো, দেখা যায় না রক্ত মাংসে পুষ্ট মানুষের চোখে। তার সব বাঁধ ভেঙে যায়, তার ক্ষুধিত অকাব্যিক পৃথিবীটা চুরমার হয়ে ভাঙতে থাকে, তার নির্বাক গলা চিরে আর্তনাদ হয়ে বেরিয়ে আসতে চায় যেন দুর্ভিক্ষের দিনে নিরন্ন মানুষের একটু ভাতের ফেনের জন্য ফেনিল আকুতি, তার নিরন্ন পেট এতদিন যে একনিষ্ঠ রাজভক্তি ও রাজকর্তব্যের ছলনায় নিজেকে ভুলিয়ে রেখেছিল, তা নিমেষে সর্বগ্রাসী হয়ে জেগে ওঠে, সে কারাগার খুলে দেয়, সে খাবে, খেতে পারবে, সব খেতে পারবে। তার পেটে সইবে, স–ব সইবে, অন্ন ব্যঞ্জন, পোলাও মাংস, পটলের দোলমা, চর্ব্য চোষ্য লেহ্য পেয় সব সে খেয়ে নেবে, তোমরা এসো তো বাপু।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭৯: সময় বুঝে প্রত্যাঘাতের জন্য রাজনীতিতে অনেক সময় পিছিয়েও দাঁড়াতে হয়

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১১৫: অগ্নির কি শুধুই দহনজ্বলা? মহর্ষি মন্দপালের অগ্নিস্তুতিতে অগ্নির কোন সদর্থকতার ইঙ্গিত?

সকলেই তো দেখেছেন এ দৃশ্য। একদিকে সবাক, অন্যদিকে নির্বাক জীবন। যারা কথা বলতে পারে তারা গারদের ওপারে। সেই গারদ পাহারা দেয় সে, যার মুখে বুলি নেই। অথচ, সে কি আদৌ মুক্তজীবন যাপন করে? এই হল পরিহাস। দুদিকের পেটেই খাবার লাগে। অভুক্ত বন্দী যখন কারাগারের অখাদ্য দেখে নাক শিঁটকোয়, তখন সেই একপেট খিদে নিয়ে বেঁচে থাকা রক্ষীটি তোষামোদের হাসি হাসে নিশ্চয়ই। সেও তো তা-ই খায়, দেশসুদ্ধ লোকজন ওই খেয়ে না মরে বেঁচে আছে তখন কোন লাটসাহেব এসেছো হে! মন্ত্রী বলেছিল তো। কিন্তু সামনে যখন থরে থরে সুখাদ্য, হোক না উচ্ছিষ্ট, সেই রক্ষীটিই ঝাঁপিয়ে পড়ে। কুয়োর ব্যাঙ একবার সাগরের গন্ধ পেলে কুয়োর দিকে ফিরে তাকায় না।

সত্যজিৎ রায়ের ছবির ‘ফ্রেম’গুলোর মধ্যেই আরও কতশত ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, বৃত্ত কিংবা অনন্ত সমান্তরাল। সুকুমার রায় এককালে জীবনজুড়ে নানাবিধ খাবারের কথা বলেছিলেন ‘খাই খাই’তে। তাঁর ছেলের তৈরি চলচ্চিত্রগুলিকে দেখতে বসে প্রথমেই চোখ পড়ে গেল ওই দিকেই। খাদ্য আর তার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কথা উঠলে ‘অশনি সংকেত’ থেকে ‘শাখাপ্রশাখার’র টেবিলে বিস্তীর্ণ ভাতের গন্ধটুকু থেকে রকমারি খাদ্যের এটা ওটার মাঝেও সহসা টেবিলে তালে তালে সেই অদ্ভুত লোকটার চাপড় মনে পড়ে?
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-২৩: বন্ধু হে আমার…

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১০১: ছিট ঘুঘু

ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
সেই লোকটাও খাবার পায়নি, পাশের জন-ই যখন কব্জি ডুবিয়ে পরচর্চাসহ উদরপূর্তিতে ব্যস্ত তখন সে অটুট নীরবতায় দেখছিল সবটাই। সে ক্ষুধার্ত, ইচ্ছে করলে কি ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতো? তার নাগরিক বোধ তাতে সায় দেয় না। অথবা উঠে যেতে পারতো? তার পেট সায় দেয় না যে। সে কেবল দেখাচ্ছিল শূন্য প্লেটটা। কোন সে কালের জনৈক কারারক্ষীর উন্মাদনা থেকে আধুনিক নগরজীবনে বন্দি এক তথাকথিত ‘উন্মাদ’ খাবারের আসক্তিটুকু নিয়ে এক একটা চরিত্র, দোষে গুণে পুষ্ট মানুষ থেকে জীবন হয়ে যেন এসে দাঁড়ায়।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content