রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


(বাঁদিকে) বন জুঁইয়ের ফুলসহ শাখা। (ডান দিকে) বন জুঁইয়ের পাকা ফল। ছবি: সংগৃহীত।

 

বাবুর (Cerbera manghas)

সুন্দরবনের যে গাছটির কথা এখন বলতে চাইছি সে গাছটি দু’টি স্থানীয় নামে পরিচিত। অনেকের মুখে বলতে শুনেছি বাবুর। আবার বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনবাসীদের মুখে ডাকুর নাম বেশি প্রচলিত। তা বাবুর হোক বা ডাকুর গাছটি কিন্তু পুরোপুরি ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ নয়, বরং ম্যানগ্রোভ সহযোগী উদ্ভিদ। এই গাছটিকে আমি কখনও দেখিনি। আসলে সুন্দরবনের পশ্চিমাংশে এই গাছটি সম্ভবত আর পাওয়া যায় না। বাবুর গাছটি বেশি লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে না। সম্ভবত এটাই সুন্দরবনের পশ্চিম অংশ থেকে এই গাছের অবলুপ্তির প্রধান কারণ। অবশ্য বাংলাদেশ অংশে খুলনা, সাতক্ষীরা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, কক্সবাজার ইত্যাদি জেলায় বাবুর গাছ যথেষ্ট পরিমাণে দেখা যায়।

বাবুর হল মাঝারি আকারের চিরহরিৎ বা আধা চিরহরিৎ বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ। এরা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এই গাছের উচ্চতা ১৫ থেকে ৪৫ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। গাছের নিচের অংশে পাতার পরিমাণ কম থাকে কিন্তু উপরের দিক পত্রবহুল। ডিম্বাকার পাতাগুলির উপরিতল গাঢ় সবুজ রঙয়ের হলেও নিচের দিক ফ্যাকাশে সবুজ রঙের হয়। পাতাগুলি বেশ লম্বা ১৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার। যে কোনও শাখার আগার দিকে পাতাগুলো গুচ্ছাকারে এবং বেশি সংখ্যায় থাকে। এর বাকলের রং ধূসর এবং খুবই অমসৃণ প্রকৃতির হয়। শাখার ওপর ঝরে যাওয়া পাতার ক্ষত দাগ স্পষ্ট বোঝা যায়।

এই গাছের বাকল বেশ পুরু। বাকলের ভিতর দিকের রঙ সাদা, কিন্তু বাকল সরালে হালকা সবুজ রঙের কাঠ দেখা যায়। বাকলে অসংখ্য ছোট ছোট ছিদ্র বা লেন্টিসেল থাকে। পাতার কক্ষ থেকে মাঝারি আকারের সাদা রঙয়ের ফুল গোছা হয়ে ফোটে। এক একটি গোছায় ২০ থেকে ৩০টি ফুল ফোটে। ফুলগুলি উভয়লিঙ্গ ও সুগন্ধযুক্ত। তাই ফুল ফুটলে মৌমাছি ও প্রজাপতিদের আনাগোনা বেড়ে যায়। বাবুর গাছের ফলের আকার বেশ বড়, ডিম্বাকার, অনেকটা ফজলি আমের সাইজ। কাঁচা অবস্থায় ফলের রং সবুজ। পাকলে কিন্তু ফলের রঙ হয় টুকটুকে লাল। আমের সাথে এর আকৃতিগত সাদৃশ্য থাকায় একে ইংরেজিতে বলে Sea mango অর্থাৎ ‘সমুদ্র আম’।

বাবুর ফলের মধ্যে রসালো শাঁস থাকে। প্রতি ফলে বীজের সংখ্যা একটি। অনেক বছর আগে আমার এক ছাত্র কোথাও থেকে এই বাবুর গাছের একটি ফল এনে আমাকে দেখিয়েছিল। তখন ফল দেখে গাছটি সনাক্ত করতে না পারলেও পরে সনাক্ত করতে পেরেছিলাম। বীজ ছাড়াও শাখার সাহায্যে এর বংশবিস্তার সম্ভব। তবে বাবুর গাছের সবথেকে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল বট, অশ্বত্থ, আকন্দ, করবি ইত্যাদি গাছের মতো এই গাছেও সাদা রঙয়ের তরুক্ষীর রয়েছে। পাতা ভাঙ্গলে বা গাছের গায়ে কোনও ক্ষত তৈরি হলে প্রচুর পরিমাণে সাদা রঙের তরুক্ষীর নির্গত হয়। এই সাদা তরুক্ষীর বা আঠা খুবই বিষাক্ত। এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উল্লেখ মনে হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বন লেবু ও টাগরি বানি

মুভি রিভিউ: মির্জাপুর সিজন ৩: সেই চমকে আর ধার নেই

অষ্টাদশ শতকে মাদাগাস্কার দ্বীপের শাসক ছিলেন রানি রানাভালোনা-১। তার স্বামী ও রাজা রাদামা-১ অল্প বয়সে প্রয়াত হলে রানী রানাভালোনা ১৮২৮ সালে সিংহাসনে বসেন। তার ৩৩ বছরের রাজত্বকাল অনেক কুখ্যাত ঘটনার জন্য স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। এসবের মধ্যে অন্যতম হল ‘Tangena trial’ অর্থাৎ দোষী ও নির্দোষ সনাক্তকরণের জন্য যন্ত্রণাদায়ক বিচার ব্যবস্থা। এই বিচার ব্যবস্থায় সম্ভাব্য অপরাধীদের বাবুর গাছের বীজ মিশিয়ে রান্না করা তিন টুকরো মাংস প্রত্যেককে খেতে দেওয়া হতো। এই মাংস খেয়ে যে বমি করবে না তাকে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করা হত এবং প্রাণদণ্ড দেওয়া হত। এই অবৈজ্ঞানিক ও অমানবিক বিচারের বলি হয়েছিল অসংখ্য নিরীহ মানুষ। এই কারণে তাঁর শাসনকালের প্রথম ৬ বছরে মাদাগাস্কারের জনসংখ্যা ৫০ লক্ষ থেকে ২৫ লক্ষে নেমে এসেছিল।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৫: সঙ্গীত অনুরাগিণী মা সারদা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বন লেবু ও টাগরি বানি

কম লবণ ও বেশি আলোকিত জায়গা বাবুর গাছের জন্য উপযুক্ত। আরণ্যক পরিবেশে গাছটিকে সুন্দরী, গেঁওয়া ইত্যাদি গাছের সাথে জন্মাতে দেখা যায়। যেসব জায়গায় সচরাচর জোয়ারের জল পৌঁছায় না সেই সব অঞ্চলেই বাবুর গাছ জন্মায়। বাবুর গাছের কাঠ খুব একটা শক্ত পোক্ত না হওয়ায় অলংকরণের জন্য, দেশলাই কাঠি তৈরির জন্য বহুল ব্যবহার করা হয়। বাবুর ফলের বীজ থেকে প্রাপ্ত তেল অতীতে সুন্দরবনের মানুষ আলো জ্বালানোর কাজে ব্যবহার করত। বর্তমানে এই তেল মাছ ধরার সময় মাছের বিষ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

 

লৌকিক চিকিৎসা

শোনা যায় সুন্দরবনের মানুষ একসময় এই গাছের বীজ থেকে প্রাপ্ত তেল চর্মরোগ নিরাময়ে ব্যবহার করা হত। মাথার উকুন মারার জন্যও এই তেল সুন্দরবনবাসী ব্যবহার করত।

(বাঁদিকে) বাবুর গাছ। (ডান দিকে) বাবুর গাছে কাঁচা ও পাকা ফল। ছবি: সংগৃহীত।

 

বন জুঁই (Clerodendrum inerme)

বন জুঁই গাছকে আমরা ছোট থেকে বলে এসেছি বন ঝাঁপি। আমাদের গ্রামের বাড়ির সামনে দিয়ে জোয়ার ভাটা খেলা যে খাল প্রবাহিত ছিল তার দু’পারে কিছুদূর অন্তর এই গাছটির ঝোপ দেখা যেত। কোথাও কোথাও ঝোপগুলো এত বড় হত যে ছোটখাট জঙ্গলে পরিণত হত। অনেকে এই গাছের শাখা কেটে এনে বাস্তুর সীমানার মাটিতে পুঁতে দিয়ে বেড়া তৈরি করত। সাদা রঙের সুগন্ধি ফুল ফুটলে সেই বেড়ার সৌন্দর্য যেমন বেড়ে যেত তেমনই সৌরভে আমোদিত হত চতুর্দিক। এখন আর কেউ বন জুঁই গাছের বেড়া দেয় না।

বন জুঁইয়ের আরও কয়েকটি স্থানীয় নাম রয়েছে। যেমন বত্রাজ বা বাড়ি ঝাঁপি। বহুবর্ষজীবী ও চিরহরিৎ গুল্ম জাতীয় এই গাছটি প্রায় ৯-১০ ফুট লম্বা হয়। এই গাছের প্রচুর শাখা প্রশাখা হয়, আর খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। হালকা বাদামি রঙের বাকল বেশ মসৃণ। বাকলের ভেতরের দিকের রঙ ধূসর। কান্ডের গায়ে অসংখ্য সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ছিদ্র থাকে যা লেন্টিসেল নামে পরিচিত। দুই থেকে পাঁচ সেন্টিমিটার লম্বা পাতাগুলো ডিম্বাকার, আর ওপরের দিকের রং ঝকঝকে সবুজ। পাতার কক্ষ থেকে ফুল জন্মায়। ফুলগুলি ছোট কিন্তু লম্বাটে ও সাদা রঙের হয়।

আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৩: টলস্টয় ও সোফিয়া—সে কি কেবলই যাতনাময়…/৩

নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসের মধ্যে গাছে ফুল আসে। ফুল থেকে অনেকটা বাইরে বেরিয়ে থাকে লম্বা চারটে পুংকেশর। ফুল সুগন্ধি হওয়ায় মৌমাছি-সহ নানা ধরনের পতঙ্গের আনাগোনা থাকে ফুলের ওপর। সাধারণত এক জায়গা থেকে তিনটে ফুলের গোছা তৈরি হয়। ফলগুলো হয় প্রায় ডিম্বাকার। কাঁচা অবস্থায় ফলগুলো সবুজ রঙের হলেও পাকলে তা ধূসর রঙের হয়। ফলগুলো এক থেকে দুই সেন্টিমিটার লম্বা হয়। ফলের ত্বক বেশ শক্ত। আর পেকে যাওয়ার পর ফল চার খণ্ডে বিদীর্ণ হয়।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-২: অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া দুলিছে যেন?

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-৯: ফেরেন্তস পুসকাস: দুটি দেশের হয়েই বিশ্বকাপ খেলেছেন

বন জুঁই গাছ সম্পূর্ণ ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ নয়। এ হল ম্যানগ্রোভ সহযোগী উদ্ভিদ। তবে এই গাছ তীব্র লবণ সহ্য করতে পারে। বিভিন্ন ধরনের মাটিতে এই গাছ জন্মাতে সক্ষম। সুন্দরবন অঞ্চলে এই গাছ নদী, খাঁড়ি, খাল ইত্যাদির দু’পাশে জোয়ার ও ভাটার সীমারেখায় কাদার উপর দিব্যি জন্মাতে পারে। এরা একসঙ্গে অনেক গাছ মিলে যেমন বিশাল ঝোপ তৈরি করতে পারে তেমনই সুন্দরী, গেঁওয়া, ভোলা, করঞ্জা, সিঙ্গরা, চাঁদি ইত্যাদি গাছের সঙ্গে একসঙ্গে জন্মাতে পারে। সুন্দরবন অঞ্চল জুড়ে নদীর ধারে বাঁধের উপর, নদীর চড়ায় ও সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে অর্থাৎ প্রায় সর্বত্র বন জুঁই গাছ ঝোপের আকারে দেখতে পাওয়া যায়।

বন জুঁই গাছের শাখা দিয়ে মাছ ধরার ছিপ খুব সুন্দর বানানো যায়। এই গাছের শাখা দিয়ে যে বাস্তুর চৌহদ্দিতে বেড়া দেওয়া যায় তা আগেই বলেছি। এর ফুল নারকেল তেলকে সুগন্ধী করতে ব্যবহার করা হয়।

(বাঁদিকে) বাবুর গাছে ফুল ও ফল। (ডান দিকে) বন জুঁই ঝোপ। ছবি: সংগৃহীত।

 

লৌকিক চিকিৎসা

বন জুঁই গাছ সুন্দরবন এলাকার মানুষের নানা ধরনের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। অতীতে খিঁচুনিযুক্ত জ্বর, ত্বকে সংক্রমণ, বেরিবেরি ও টিউমার রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হত। বিষাক্ত সামুদ্রিক মাছ বা প্রাণীর দংশনে যন্ত্রণা কমাতে বন জুঁই বীজ বা মূল বেটে দংশিত স্থানে লাগিয়ে দিলে যন্ত্রণার উপশম হয়। বর্তমানে অবশ্য এলোপ্যাথি চিকিৎসার অভূতপূর্ব উন্নতি হওয়ায় লৌকিক চিকিৎসা পদ্ধতিগুলি ক্রমশ ক্ষীয়মান। —চলবে।

* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content